ইসলামে অসিয়তের নীতিমালা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অসিয়ত করা না করা দুটোই জায়েজ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসিয়ত করে যাওয়া উত্তম। এক-তৃতীয়াংশ অর্থ বা সম্পত্তিতে অসিয়ত বাস্তবায়ন করা ওয়ারিশদের ওপর ওয়াজিব। যেমন যদি মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনের খরচ, অন্যান্য ওয়াজিব অধিকার এবং ঋণ পরিশোধের পর ৯ লাখ টাকা বা সমপরিমাণ সম্পত্তি উদ্বৃত্ত থাকে, তাহলে তিন লাখ পর্যন্ত অসিয়ত কার্যকর করা ওয়ারিশদের জন্য জরুরি। এক-তৃতীয়াংশের অধিক সম্পদে অসিয়ত কার্যকর করা না করা ওয়ারিশদের এখতিয়ারভূক্ত। কোনো ওয়ারিশ বা সব ওয়ারিশকে বঞ্চিত করার জন্য অসিয়ত
করলে তা কবিরা গোনাহ।

অসিয়ত কী? অসিয়ত হলো মৃত্যুপরবর্তী সময়ে কার্যকর করার নির্দেশ-সংবলিত বিশেষ উপদেশ। অর্থাৎ ওই কাজের বাস্তবায়ন করা হবে মৃত্যুর পর, জীবদ্দশায় নয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ মৃত্যুর সময় বলল, আমার মৃত্যুর পর আমার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে এই পরিমাণ সম্পদ অমুক ব্যক্তি বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা এতিমখানায় দান করবে। একে বলা হয় অসিয়ত। অসিয়ত দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে লিপিবদ্ধ করা জরুরি। যাতে পরবর্তী সময়ে কোনো মতবিরোধ বা জটিলতার সৃষ্টি না হয়। ইসলামী শরিয়তে অসিয়তের নির্দিষ্ট আইন করা হয়েছে। যেসব আত্মীয়স্বজন উত্তরাধিকার আইনে মিরাস পায় না, অথচ সাহায্য পাওয়ার হকদার, যেমন : এতিম নাতি-নাতনি বা মৃত ছেলের বিধবা স্ত্রী, অথবা কোনো ভাই বা বোন বা কোনো আত্মীয় সাহায্যের মুখাপেক্ষী, তাহলে অসিয়তের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা যায়।

অসিয়ত করা না করা দুটোই জায়েয। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসিয়ত করে যাওয়া উত্তম। এক-তৃতীয়াংশ অর্থ বা সম্পত্তিতে অসিয়ত বাস্তবায়ন করা ওয়ারিশদের উপর ওয়াজিব। যেমন যদি মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফনের খরচ, অন্যান্য ওয়াজিব অধিকার এবং ঋণ পরিশোধের পর ৯ লাখ টাকা বা সমপরিমাণ সম্পত্তি উদ্বৃত্ত থাকে, তাহলে তিন লাখ পর্যন্ত অসিয়ত কার্যকর করা ওয়ারিশদের জন্য জরুরি। এক-তৃতীয়াংশের অধিক সম্পদে অসিয়ত কার্যকর করা না-করা ওয়ারিশদের এখতিয়ারভুক্ত। কোনো ওয়ারিশ বা সমস্ত ওয়ারিশকে বঞ্চিত করার জন্য অসিয়ত করলে তা কবিরা গোনাহ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ওয়ারিশকে মিরাস থেকে মাহরুম করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত থেকে মাহরুম করবেন।’ (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী) ইন্তেকালের পর রেখে যাওয়া সম্পদ বা অর্থের বণ্টন হবে একমাত্র উত্তরাধিকার আইনে। ইসলামের প্রথম যুগে যত দিন মিরাসের হিস্যা নির্ধারিত ছিল না, ততদিন প্রত্যেক ব্যক্তির উপর অসিয়তের মাধ্যমে ওয়ারিশদের হিস্যা নির্ধারণ করা আবশ্যক ছিল। যাতে তার মৃত্যুর পর বংশধরদের মধ্যে ঝগড়া না হয় এবং হকদারদের হক নষ্ট না হয়। যখন মিরাস বণ্টনের জন্য আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসা অবতীর্ণ করে নিয়মনীতি বলে দিলেন তখন অসিয়তের আবশ্যকতা থাকে না। অবশ্য দুটি বুনিয়াদি শর্তের সঙ্গে তার মুস্তাহাব বিধান অটুট থাকে।

এক. যে ব্যক্তি মিরাসি সম্পদে নির্দিষ্ট হিস্যা পাবে তার জন্য অসিয়ত করা যাবে না। যেমন মা, বাবা, স্ত্রী, স্বামী এবং সন্তান-সন্ততি। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের সামনে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ওয়ারিশের হিস্যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং এরপর কোনো ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করার বৈধতা নেই।’ (তিরমিজি) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মিরাস সেসব লোকদের অসিয়ত রহিত করে দিয়েছে মিরাসে যাদের হিস্যা নির্ধারিত রয়েছে। অন্যান্য আত্মীয়, মিরাসে যাদের হিস্যা নেই, তাদের জন্য এখন অবধি অসিয়তের বিধান বাকি আছে।

দুই. অসিয়তের বাস্তবায়ন কমপক্ষে মোট মিরাসের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে হতে পারে। তবে ওয়ারিশরা সমুদয় সম্পত্তির উপর অসিয়ত বাস্তবায়নে রাজি হলে ভিন্ন কথা। এ ব্যাপারে ফকিহদের ঐকমত্য রয়েছে যে, মিরাসের মধ্যে যেসব আত্মীয়ের হিস্যা নির্ধারিত নেই, তাদের জন্য অসিয়ত করা এখন আর ফরজ বা জরুরি নয়। কারণ অসিয়ত ফরজ হওয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে। (তাফসিরে জাসসাস, তাফসিরে কুরতুবী)
যেসব বিষয়ে অসিয়ত ওয়াজিব : এক. যে ব্যক্তির ওপর ঋণ আছে তার জন্য অসিয়ত করা ওয়াজিব।
দুই. জীবদ্দশায় ফরজ হজ আদায় করে যেতে না পারলে তার জন্য অসিয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব।
তিন. জাকাত ফরজ হয়েছিল, কিন্তু আদায় করতে পারেনি। তার জন্য অসিয়ত করা ওয়াজিব।
চার. রোজা রাখতে পারেনি। তার ফিদিয়া আদায় করার অসিয়ত করা ওয়াজিব।

পাঁচ. যদি কোনো নিকটাত্মীয় আইনমতে মিরাস না পায়, যেমন এতিম নাতি-নাতনি এবং তাদের প্রয়োজনও খুব বেশি, তাদের জন্য অসিয়ত করা ওয়াজিব না হলেও নিজের নাতি-নাতনিদের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত। কোনো কোনো আলেম বলেছেন, এ অবস্থায় অসিয়ত করা ওয়াজিব। মুস্তাহাব অসিয়ত : ইসলামী শরিয়ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই অধিকার দিয়েছে যে, সে তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ কারও প্রয়োজনে অথবা মসজিদ বা মাদরাসা বা মুসাফিরখানা বা এতিমখানার নামে অসিয়ত করে যেতে পারে। যাতে করে এটা তার জন্য সদকায়ে  জারিয়া হয়ে যায় এবং তার মৃত্যুর পরেও সওয়াব জারি থাকে।

মাকরুহ অসিয়ত : সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আমি অসুস্থ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে দেখতে এলেন। তখন আমি ছিলাম মক্কা মোকাররমায়। (বিদায় হজ বা মক্কা বিজয়ের সময়) তিনি ওই অঞ্চলে মৃত্যু পছন্দ করতেন না যেখান থেকে কেউ হিজরত করেছে। তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা ইবনে আফরার (সা’দ) ওপর রহম করুন। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি কি আমার সমস্ত ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করার অসিয়ত করব? তিনি বললেন, না। আমি পুনরায় আরজ করলাম, অর্ধেকের জন্য কি অসিয়ত করব? তিনি বললেন, না। আমি আরজ করলাম, তাহলে এক-তৃতীয়াংশের জন্য করবো?

তিনি বললেন, এক-তৃতীয়াংশের জন্য করতে পার। তবে এটাও অনেক বেশি। যদি তুমি নিজের আত্মীয়দের সম্পদশালী রেখে যাও তাহলে এটা তাদের মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তোমার জন্য ভালো। মুখাপেক্ষী হলে তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে। এতে কোনো সন্দেহ পোষণ করো না যে, যখনই তুমি কোনো জিনিস জায়েয তরিকায় খরচ করবে তা হবে সদকা। যে লুকমা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দেবে তা-ও সদকা। আর (এখনই কোনো অসিয়ত করার দরকারও নেই, কারণ) আল্লাহ তোমাকেও আরোগ্য দান করতে পারেন এবং তোমার দ্বারা অনেক মানুষের ফায়দাও হতে পারে। ( বোখারি ও তিরমিজি)

মোটকথা, সন্তান-সন্ততি ও ওয়ারিশরা সম্পদের বেশি হকদার হলে অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে অসিয়ত করা মাকরুহ। উল্লেখ্য যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) রোগমুক্তির দোয়া করার পর হজরত সা’দ বিন আবি  ওয়াক্কাস (রা.) প্রায় পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকেন এবং তিনি অনেক বড় বড় দ্বীনী খেদমত আনজাম দেন। নাজায়েজ অসিয়ত : এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করা, ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করা; এরকম অসিয়ত বাস্তবায়ন করা যাবে না। সন্তান-সন্ততি বা দ্বিতীয় কোনো ওয়ারিশকে বঞ্চিত করার উদ্দেশে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে অসিয়ত করা জায়েজ নয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিছু কিছু লোক এমনও আছে ষাট বছর পর্যন্ত আল্লাহর আনুগত্যে জীবন অতিবাহিত করে।

কিন্তু মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তখন অসিয়তের মাধ্যমে নিজের ওয়ারিশদের ক্ষতিসাধন করে। যে কারণে এসব লোকেদের উপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়। (তিরমিজি) অসিয়ত সম্পর্কিত কতিপয় মাসয়ালা : এক. কোনো সুস্থ ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় নিজের সন্তানের শিক্ষা, বাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি কাজে কম বা বেশি খরচ করতে পারে। তেমনিভাবে স্বাভাবিক জীবনে সন্তানাদির মধ্যে সম্পদ বণ্টনে কম-বেশি করতে পারে। তারপরও তার জন্য উচিত হলো সন্তান-সন্ততির ব্যয় ও সম্পদে সমতা রক্ষা করা। সাধারণ সুস্থ জীবনে অসিয়ত বা উত্তরাধিকার আইন বাস্তবায়ন হয় না। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে সন্তান বা আত্মীয়স্বজনকে প্রদত্ত অর্থ বা সম্পদকে শরিয়তের পরিভাষায় হেবা (দান) বলা হয়। মোটকথা, স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে পিতা যদি নিজের সন্তানদের মধ্যে কাউকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অনুভব করে, অথবা নিজের এতিম নাতি-নাতনিকে নিজের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে কিছু অংশ দিতে চায় দিতে পারে।

দুই. ঋণের বিষয়কে অসিয়তের আগে রাখতে হবে। হজরত আলী (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসিয়তের আগে ঋণ আদায় করার হুকুম দিয়েছেন। তিন. শরিয়তের বিধানমতে, ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করা যায় না। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি কোনো ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করে দেয় এবং সব ওয়ারিশ মাইয়্যেতের ইন্তেকালের পর তার অসিয়ত কার্যকর করার অনুমতি দেয়, তাহলে ওই অসিয়ত কার্যকর হয়ে যাবে। তেমনিভাবে যদি কেউ তার এক-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদে অসিয়ত করে দেয় এবং সব ওয়ারিশ তা কার্যকর করার অনুমতি দিয়ে দেয় তাহলে তা কার্যকর হয়ে যাবে। চার. লিখিত অসিয়তনামায় পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ যদি কেউ অসিয়ত লিপিবদ্ধ করে নিজের কাছে জমা রাখে, তারপর তার জীবদ্দশাতেই তা পরিবর্তন করতে চায় তা করতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর