নাগরিক তালিকা থেকে বাদ ৪০ লাখ মানুষ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ গেল সপ্তাহে ১৯৫১ সালের পর এই প্রথমবার ভারতের আসাম রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো রাজ্যে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করা। এই তালিকা প্রকাশের পর এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে দাবি বা আপত্তি জানানোর জন্য। সেসব দাবি খতিয়ে দেখার পর পূর্ণ নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা হবে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর আগে যারা আসামে এসেছেন বলে নথি প্রমাণ পেশ করতে পারেননি, তাদের নাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ গেছে।

অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই নাগরিকপঞ্জি চূড়ান্ত করা হয়, যার কারণে নথি প্রমাণ পেশ না করতে পেরে নিজ ভূমিতেও পরবাসী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। চূড়ান্ত তালিকায় নাম উঠবে কি না, এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার মধ্যে আছেন বাংলাভাষী মুসলমানরা। নিজেদের নাম নাগরিকপঞ্জিতে থাকা নিয়ে অনিশ্চিত বহু বাঙালি হিন্দু পরিবারও।

শিলচরের দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গের সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী বলছিলেন, ‘যেভাবে গোটা প্রক্রিয়াটি চালানো হয়েছে, তা দেখে সন্দেহ হওয়ার অবকাশ আছে যে, বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত হচ্ছে। যাতে আসামে থাকতে গেলে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রভুত্ব মেনেই থাকতে হয়, সেই প্রক্রিয়া চলছে। আসলে গত কয়েকটি জনগণনায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বহু বাংলাভাষী মুসলমান, আগে যারা নিজেদের মাতৃভাষা অসমিয়া বলে উল্লেখ করতেন, তারা এখন বাংলাকে মাতৃভাষা বলে জনগণনায় জানিয়েছেন। তাই আসামে বাঙালিদের সংখ্যাটা বেড়ে গেছে।’

তবে যে শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা ‘আসু’র নেতৃত্বে আশির দশকে রক্তক্ষয়ী আসাম আন্দোলন হয়েছিল এবং যার পরিণতিই ১৯৮৫ এর আসাম চুক্তিতে সরকার সম্মত হয় জাতীয় নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদ করতে। সেই সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘আমরা কখনই বাঙালিবিরোধী নই, আর এই প্রক্রিয়াটাও হিন্দুবিরোধী বা মুসলমানবিরোধী নয়। এটা অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার একটা প্রক্রিয়া। বহু অসমিয়া মানুষেরও নাম প্রাথমিক তালিকা থেকে বাদ গেছে।’

কোনো ব্যক্তি বা তার পূর্বপুরুষ যে সত্যিই ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের আগে থেকে আসামে বসবাস করছেন, তা প্রমাণের জন্য ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জি যেমন দেখা হচ্ছে, তেমনি ১৪-১৫টি নথি চাওয়া হচ্ছে। তথ্য মেলানো হয়েছে ভোটার তালিকার সঙ্গেও। পুরানো ভোটার তালিকা ধরে তৈরি হয়েছে ‘লিগ্যাসি ডেটা’ আর বংশবৃক্ষ। নানা সময়ে একেকটি কর্তৃপক্ষের তৈরি করা ওইসব একাধিক তালিকায় সমন্বয় না থাকার অভিযোগ করছেন বহু মানুষ। যেমন ভোটার তালিকায় কোনো ব্যক্তির নামের বানান ভুল থেকে গেছে, তাই তিনি যে তার মা-বাবার সন্তান, সেটা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

‘আমার দাদুর নাম ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জিতে আছে, ১৯৬৬’র ভোটার তালিকায়ও আছে। আমাদের জায়গাজমির দলিল, ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা দেওয়ার রশিদ সব আছে। তবু আমাদের গোটা পরিবারের কারও নাম ডিসেম্বরে প্রকাশ হওয়া আংশিক নাগরিকপঞ্জিতে নেই’, বলছিলেন বাকসা জেলার বাসিন্দা ছাত্র ইব্রাহিম আলী।
বিপুলসংখ্যক বিবাহিত নারী এই কারণে শঙ্কিত যে, তাদের অনেকেরই জন্ম সার্টিফিকেট নেই। স্কুলেও পড়েননি, তাই নেই সেই নথিও।

দরিদ্র পরিবারের এসব নারীর নেই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। আবার বিয়ের পরে পদবি পরিবর্তন করেছেন অথচ ‘লিগ্যাসি ডেটা’ অনুযায়ী তার বাবার পদবি আলাদা। এদিকে বাবারও মৃত্যু হয়েছে, তাই এখন প্রমাণ করাই কঠিন যে, ওই নারীরা সত্যিই তার মা-বাবার সন্তান এবং সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিক। এরই সঙ্গে তাদের ভোটার তালিকায় ‘ডি-ভোটার’ বা সন্দেহজনক ভোটার বলে চিহ্নিত করেছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। একটা সময়ে যদিও অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো দাবি করত যে, রাজ্যে লাখ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি বসবাস করছেন এবং ভোটার তালিকায় নামও তুলে ফেলেছে।

১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হয় ‘ডি-ভোটার’ চিহ্নিতকরণ। নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার দায়িত্বে রয়েছেন আসামের যে কর্মকর্তা, সেই প্রতীক হাজেলা বিবিসিকে চূড়ান্ত খসড়া তালিকার ব্যাপারে কিছু তথ্য দিয়েছেন

১. প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার আবেদন জানিয়েছিলেন। সঙ্গে জমা পড়ছে সাড়ে ৬ কোটিরও বেশি নথি। সব নথিই স্ক্যান করে ডিজিটাইজড করা হয়েছে।

২. ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যাচাইয়ের জন্য ৫ লাখ ৭৭ হাজার নথি পাঠানো হয়েছে। ৩৭টি দেশেও নথি গেছে তথ্য যাচাইয়ের জন্য।

৩. ৪৮ হাজার কর্মী-অফিসার ২০১৫ সাল থেকে এই নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতের কাজ করছেন।

৪. বৈধ নাগরিকদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য ৫৯টি ভিন্ন ভিন্ন সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে।

৫. নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ নিয়ে অশান্তি ছড়াতে পারে, সেই আশঙ্কা করছে পুলিশ।

তাই ২২০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে রাজ্যজুড়ে। সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। রয়েছে পুলিশি নজরদারিও। তবে গত কয়েকদিনে কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য সরকার বারবার প্রচার করছে যে, নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়ায় নাম না থাকা মানেই কাউকে বিদেশি অথবা অবৈধ বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা নয়।

নিজেদের নাগরিকত্বের দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করার আরও এক মাস সময় পাওয়া যাবে। আর এখনই কাউকে বিদেশি বলে আটক করা হবে না। কেউ পরপর বেশ কয়েকবার ভোট না দিলে অথবা অন্য গ্রামে চলে গিয়ে থাকলে তাদের ‘ডি-ভোটার’ বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের নামের তালিকা সীমান্ত পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং মামলা রুজু হয় ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ বা বিদেশি চিহ্নিতকরণের ট্রাইব্যুনালে। সেখানে নিজেকেই তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি সত্যিই বৈধ ভারতীয় নাগরিক।

সূত্র : বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর