ভোটের হাওয়া: নেত্রকোনা-৪ আওয়ামী লীগে কোন্দলের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওর অধ্যুষিত মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলা নিয়ে গঠিত নেত্রকোনা-৪ আসন। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী নির্বাচনী মাঠে তৎপর রয়েছেন। তিন উপজেলা সদর থেকে শুরু করে ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে শোভা পাচ্ছে দলীয় প্রধানসহ মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ছবি সংবলিত পোস্টার, বিলবোর্ড ও ব্যানার। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসন ধরে রাখতে চায় দলটি। তবে দলীয় কোন্দল চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে হলেও যিনিই দলীয় প্রার্থী হন, তাকে জয়ী করতে একাট্টা সবাই।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন আবদুল খালেক। তার মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হলে উপনির্বাচনে আবদুল মমিন এমপি নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও খাদ্যমন্ত্রীর  দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির দেওয়ান শাহজাহান ইয়ার চৌধুরী এমপি হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন লুৎফুজ্জামান বাবর। ১৯৯৬ সালে ফের জয়ী হন আওয়ামী লীগের আবদুল মমিন। ২০০১ সালে বিএনপির লুৎফুজ্জামান বাবর দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে প্রয়াত আবদুল মমিনের সহধর্মিণী রেবেকা মমিন বিজয়ী হন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রেবেকা মমিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও এমপি নির্বাচিত হন।

আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন বর্তমান এমপি রেবেকা মমিন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফি আহমেদ, জেদ্দা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ হোসেন চৌধুরী, খালিয়াজুরী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুজ্জামান তালুকদার সোয়েব সিদ্দিকী এবং ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনজুরুল হক।

অন্যদিকে বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনাজ্জামান শ্রাবণী, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-কৃষিবিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-ফারুক, জেলা বিএনপি নেতা শিল্পপতি কেএম জহির ফারুক ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা চৌধুরী।

আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মোহনগঞ্জ-মদন-খালিয়াজুরী উপজেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই রেবেকা মমিন ও শফি আহমেদ সমর্থিত দুটি গ্রুপ সক্রিয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মোহনগঞ্জ উপজেলায় নেতাকর্মীদের বিরোধের অবসান হলেও মদন ও খালিয়াজুরীতে দ্বন্দ্ব এখনও বিদ্যমান। স্থানীয় রাজনীতিতে রেবেকা মমিনের সঙ্গে শফি আহমেদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে এ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হতে পারে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।

দলীয় দ্বন্দ্বের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে রেবেকা মমিন সাংবাদিককে বলেন, বর্তমানে তিন উপজেলায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গত সাড়ে ৯ বছরে এ এলাকায় কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। আমি সাধারণ জনগণের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, দল আবারও আমাকে মনোনয়ন দেবে।

‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম রূপকার বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফি আহমেদ বলেন, ২০০৬ সালে দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। দুই বছরের জরুরি অবস্থার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পান তিনি। কিন্তু একান্ত ‘পারিবারিক কারণে’ রেবেকা মমিনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর পরও কোনোদিন দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। মনোনয়নবঞ্চিত হয়েও দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করছেন। তার বিশ্বাস, দলীয় হাইকমান্ড বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।

জেদ্দা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মদন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ হোসেন চৌধুরী ২০০৬ সাল থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আসছেন। এবারও তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে এলাকায় এসে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদান দিচ্ছেন। সমকালকে তিনি জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেন। দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তার বিশ্বাস, দল তাকেই মনোনয়ন দেবে। মনোনয়ন না পেলেও দলের হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করবেন।

খালিয়াজুরী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সামছুজ্জামান তালুকদার সোয়েব সিদ্দিকীও মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে মাঠে নেমেছেন। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এ কারণে বিগত উপজেলা নির্বাচনে মোহনগঞ্জ ও মদন তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উপজেলা নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি বলেন, খালিয়াজুরীতে হাইব্রিড নেতাদের আগমনে আওয়ামী লীগে এখন আর কোনো পরীক্ষিত নেতা নেই। এলাকায় জলমহাল ব্যবসার সুবাদে বিএনপির নেতারা পুনর্বাসিত হয়েছেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দলীয় প্রার্থীর পরিবর্তন দরকার। তিনি বলেন, তার বাবা মরহুম সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন জাতির পিতার অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এসব বিবেচনায় দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলে তিনি আশা করেন।

দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে রয়েছেন ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনজুরুল হকও। বিগত তিনটি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে তিনি পাননি। এবার পাবেন বলে আশা করছেন। সাংবাদিককে তিনি বলেন, দলের হয়ে কাজ করছি। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।

এদিকে এ আসনে বিএনপিতে অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও দলে বড় ধরনের কোনো কোন্দল বা মতবিরোধ নেই। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে সবাই একাট্টা হয়ে কাজ করবেন। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনাজ্জামান শ্রাবণী। জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন খান বলেন, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই পরিবার থেকেই কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়দের প্রথম পছন্দ তাহমিনাজ্জামান শ্রাবণী।

নেত্রকোনা বিসিকের সভাপতি ও জেলা বিএনপি নেতা শিল্পপতি কেএম জহির ফারুক বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন। সাংবাদিককে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এলাকার বেকার যুবকদের দেশ-বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। আশা করি দলীয় হাইকমান্ড বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে মনোনয়ন দেবে। মনোনয়ন না পেলেও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন।

সুপ্রিম কোর্ট জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট এবিএম রফিকুল হক তালুকদার রাজাও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি জানান, জেলার দলীয় নেতাকর্মীদের অনেক সময় বিনা টাকায় আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। অবহেলিত এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে চান। দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলেই তিনি মনে করেন।

কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-কৃষিবিষয়ক সম্পাদক চৌধুরী আবদুল্লাহ-আল ফারুকও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তার পক্ষে জেলা সদরসহ নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছেন কর্মী-সমর্থকরা। জেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট মাসুদ রানা চৌধুরীও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে কাজ করছেন। মাসুদ রানা চৌধুরী সাংবাদিককে বলেন, দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মামলা-মোকদ্দমায় আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলে তার বিশ্বাস রয়েছে।

এ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে পার্টির জেলা আহ্বায়ক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী খান এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

সূত্রঃ সমকাল

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর