আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখার গুরুত্বপূর্ণ আমল

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসমাঈলকে জনমানবহীন মক্কায় রেখে ফিরে যাওয়ার সময় বারবার বিবি হাজেরা বলেছিল, ‘আমাদের একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি ফিরে তাকাননি। হাজেরা বলেন, এটা কি আল্লাহর আদেশ? তিনি বলেন, হ্যাঁ। বিবি হাজেরা বলেন, তাহলে তিনি আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ (বোখারি)। এ সুধারণার সুন্দর পরিণতি হলো জমজমের পানি, বায়তুল্লাহর আবাদ, চিরন্তন স্মৃতিরক্ষা, নবী ইসমাঈলের বংশ থেকে
শেষ নবীর জন্ম।

আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা বান্দার ওপর আল্লাহর অধিকার। তিনি তাওহিদের বার্তা দিয়েই নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন এবং সব আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। তাওহিদের মূল মর্ম হলো ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারণ করা। আল্লাহ বাহ্যিক ও আত্মিক যেসব কাজকর্ম ও কথাবার্তা ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন, সেসবের সামগ্রিক নামই হলো ইবাদত।

অন্তর বা হৃদয়ের বিশেষ ইবাদত আছে। হৃদয়ের নিবেদন ও দাসত্ব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিবেদনের চেয়ে বড় ও অধিক স্থায়ী। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে হৃদয়ের আমলগুলোর উপস্থিতি শারীরিক আমলগুলোর চেয়ে উত্তম। হৃদয়ের বিশ্বাস দিয়ে জেনে ও মেনে প্রতিষ্ঠিত ধর্মই প্রকৃত কাম্য, বাহ্যিক আমল সেটার পরিপূরক ও অনুগামী। হৃদয়ের আমলের মধ্যস্থতা ছাড়া বাহ্যিক আমল সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হয় না। কেননা তা ইবাদতের প্রাণ ও মূল বিষয়। হৃদয়ের আমলবিহীন বাহ্যিক আমল প্রাণহীন দেহের মতো। হৃদয়ের শুদ্ধতা দ্বারা পুরো দেহ বিশুদ্ধ হয়। রাসুসুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখ, দেহে এমন একটি মাংসখ- আছে, যা পরিশুদ্ধ হলে গোটা দেহ পরিশুদ্ধ হয়, যা নষ্ট হলে গোটা দেহ নষ্ট হয়, আর তা হলো হৃদয়।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

হৃদয়ে যা আছে তার শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখেই ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব ও তার আমলের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হয়। বান্দার হৃদয় হলো পালনকর্তার দৃষ্টির কেন্দ্রস্থল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের দেহ ও বাহ্যিক অবয়বের দিকে তাকান না, বরং তিনি তাকান তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে।’ (মুসলিম)।

অন্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা। এটি ইসলামের একটি আবশ্যিক বিষয়। তাওহিদের একটি অপরিহার্য দাবি, কর্তব্য ও হক। আল্লাহর প্রতি সুধারণার সামগ্রিক মানে হলো, তাঁর সত্তা, সব নাম ও গুণাবলির পূর্ণাঙ্গতার সঙ্গে মানানসই ধারণা পোষণ করা। আল্লাহকে চেনা ও জানার শাখা এটা। আল্লাহর বিশাল অনুগ্রহ, দয়া, মর্যাদা, ক্ষমতা, জ্ঞান ও তাঁর সুন্দর ইচ্ছা সম্পর্কে অবগত থাকলে আল্লাহর প্রতি সুধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ে অবগতি সম্পন্ন হলে রবের প্রতি বান্দার অবশ্যই সুধারণার জন্ম হবে। আল্লাহর নাম ও গুণগুলো পর্যবেক্ষণ করার দ্বারাও এটা তৈরি হয়।

যার অন্তরে আল্লাহর নাম ও গুণের আসল তাৎপর্য সাধিত হবে তার মধ্যে সেসব নাম ও গুণগুলোর প্রতি উপযুক্ত সুধারণাও তৈরি হবে। কেননা আল্লাহর প্রতিটি গুণের সঙ্গে আলাদা ইবাদত ও বিশেষ ইতিবাচক ধারণা জড়িয়ে আছে। আল্লাহর অপার মহিমা, বিপুল প্রতাপ, গোটা সৃষ্টিজগতের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণ করাকে আবশ্যক করে তোলে। এ বিষয়ে তিনি বান্দাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা সুন্দরতম আচরণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর আচরণকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)।

সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর প্রতি ধারণা সুন্দর করো।’ সুধারণা রাখার অনেক গুরুত্ব থাকায় নবী করিম (সা.) তাঁর মৃত্যুর আগে এ বিষয়টির প্রতি অনেক জোর দিয়ে গেছেন। জাবের (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর তিন দিন আগে তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা ছাড়া মৃত্যুবরণ না করে।’ (মুসলিম)। রবের প্রতি সুধারণা রেখে যেসব বান্দা বিনম্র হয় আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন।

আগাম সুসংবাদ হিসেবে ইবাদতকে তাদের জন্য সহজ ও সহযোগী বানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। বিনম্র লোকদের ছাড়া এটা সবার জন্য কঠিন কাজ, যারা ধারণা করে তারা তাদের পালনকর্তার সামনাসামনি হবে এবং তারা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সূরা বাকারা : ৪৫-৪৬)।

আল্লাহকে চেনার ক্ষেত্রে তাঁর রাসুলরা উচ্চতর স্তর অর্জন করেছিলেন। তাদের প্রতিপালকের প্রতি সুধারণা রেখে তাদের সব বিষয় আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করে দিতেন। ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসমাঈলকে জনমানবহীন মক্কায় রেখে ফিরে যাওয়ার সময় বারবার বিবি হাজেরা বলেছিল, ‘আমাদের একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি ফিরে তাকাননি। হাজেরা বলেন, এটা কি আল্লাহর আদেশ? তিনি বলেন, হ্যাঁ। বিবি হাজেরা বলেন, তাহলে তিনি আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ (বোখারি)। এ সুধারণার সুন্দর পরিণতি হলো জমজমের পানি, বায়তুল্লাহর আবাদ, চিরন্তন স্মৃতিরক্ষা, নবী ইসমাঈলের বংশ থেকে শেষ নবীর জন্ম।

ইয়াকুব (আ.) দুই পুত্র হারিয়ে ধৈর্য ধরেন। সব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার দুঃখ-বেদনা ও শোকের কথা শুধু আল্লাহর কাছেই ব্যক্ত করি।’ (সূরা ইউসুফ : ৮৬)। আল্লাহর প্রতি সুধারণায় তার হৃদয় ভরপুর ছিল। তিনি বলতেন, আশা করি আল্লাহ তাদের সবাইকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা ইউসুফ : ৮৩)। মুসা (আ.) স্বজাতির চরম দুর্দশায় আল্লাহর প্রতি সুধারণা রেখে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো, ধৈর্য ধরো। নিশ্চয়ই পৃথিবী আল্লাহর, তিনি তাঁর বান্দার যাকে ইচ্ছা তাঁকে তার উত্তরাধিকারী বানাবেন। শুভ পরিণতি তো খোদাভীরুদের জন্য।’ (সূরা আরাফ : ১২৮)।

আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর প্রতি সুধারণার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিলেন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। তিনি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও সাহায্যের প্রতি আস্থা রেখে অবিচল থাকেন। পাহাড়ের ফেরেশতা তাঁকে বলেছিল, ‘আপনি চাইলে আমি তাদের ওপর দুটি পাহাড় চাপা দিতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, বরং আমি আশা করি, আল্লাহ তাদের ঔরস থেকে এমন লোকের জন্ম দেবেন, যে আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করবে না।’ (বোখারি ও মুসলিম)। গারে সওরে তিনি সঙ্গীকে বলেন, ‘দুশ্চিন্তা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।

(সূরা তওবা : ৪০)। আবু বকর (রা.) বলেন, সওর পর্বতের গুহায় আমি নবী করিম (সা.) কে বললাম, তাদের কেউ যদি নিজের পায়ের দিকে তাকায় তাহলে তো পায়ের নিচে আমাদের দেখে ফেলবে! তখন তিনি বলেন, ‘ওই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার কি ধারণা যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ?’ (বোখারি ও মুসলিম)। নবীদের পরে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সুধারণার ক্ষেত্রে সব মানুষের মধ্যে সেরা ছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘লোকেরা যাদের বলত, শত্রুরা তোমাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রস্তুত করেছে, তোমরা তাদের ভয় করো। তখন তাদের ঈমান বেড়ে যেত এবং তারা বলত, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৭৩)।

আবু বকর (রা.) আল্লাহর পথে সব সম্পদ দান করতে এলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বলেন, ‘তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে রেখে এসেছি।’ (আবু দাউদ)। পরবর্তী সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা এ পথেই চলেছেন। তাই মোমিনের উচিত সবসময় আল্লাহর প্রতি সুধারণা বজায় রাখা। আল্লাহ তাঁর প্রতি সুধারণা থাকলে তওবা কবুল করেন, অপরাধ ক্ষমা করেন, বিপদ ও সংকট দূর করেন। আল্লাহর প্রতি সুধারণা বান্দার সৎকর্মে প্রতিফলিত হবে। বান্দা আল্লাহর প্রতি যা ধারণা রাখে তা পায়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার প্রতি আমার বান্দার ধারণার কাছাকাছি থাকি।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

১৮ রবিউস সানি ১৪৩৯ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর