ঢাকা ০৭:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফসলের মাঠে কৃষকের বিষন্ন মুখ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৮:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০১৬
  • ৪৮৫ বার

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিজ উৎপাদনে কিছু অঞ্চল বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। নদী বিধৌত ও অসংখ্য খাল-বিল বেষ্টিত উত্তরের জনপদ নাটোর তারই একটি।

বহুকাল ধরে জলজ প্রকৃতির সাহচর্যে বছরের সিংহভাগ সময় ঘনিষ্ট থাকা উর্বর এই জনপদের মানুষদের জীবন-জীবিকা আবর্তিত কৃষির উৎপাদন আর মৎস্য আহরণে। সুজলা-সুফলা বাংলার যে পরিচয় বিধৃত সর্বত্র তা আসলে এমনসব জনপদেরই কারণেই।

বৈশাখের এই ভরা মৌসুমে ধান কাটার উৎসবে নাটোর তার প্রকৃত ঐশ্বর্য মেলে ধরে। এখানকার বিস্তৃত সোনালী ফসলের মাঠ আর পাকা ধানের মন মাতানো ঘ্রাণ যে কাউকেই আকূল না করে ছাড়ে না।

নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার বৃহত্তর চলনবিলের অংশবিশেষ পাটুল বিল। ভরা বর্ষায় এবিল যেন রূপ নেয় সমুদ্রে। বর্ষা শেষে পলি সমৃদ্ধ বিশাল সমতল উর্বর ভূমি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে কৃষি উৎপাদনের। বছরে একটি মাত্র ফসল আবাদ করতে পারেন স্থানীয় কৃষিজীবীরা, বলা যায় এতেই সারা বছরের বেঁচে থাকবার সঞ্চয় সংগ্রহ করতে হয় তাদের।

শুক্রবার সত্যিকারের ‘কৃষি পর্যটন’এর এই জনপদে এসে দেখা গেল, সেচ দেয়ার জন্য বিদ্যুতচালিত গভীর নলকূপের সুবিধাও আছে এখানে। রাজধানী ঢাকা থেকে চরম তাপদাহকে সঙ্গী করে যখন পাটুলে পৌছাই ততক্ষণে বেলা দুপুর।

মাঠ থেকে কষ্টের সোনার ফসল ঘরে তোলার কৃষকের আনন্দের যে উৎসব দেখতে সেখানে যাওয়া-প্রচন্ড দাবদাহে তা অনেকটাই উৎসাহে কমিয়েছে। কিন্তু সেখানে পৌছে খোলা আকাশের নীচে সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপকে উপেক্ষা করে কৃষকদের ধান কাটা, মাড়াই আর ফসল উঠিয়ে নেয়ার ব্যাপক উৎসাহ-আয়োজন দেখে বিস্ময় মানতে হয়!

অসংখ্য মানুষের কলরবে মুখরিত পাটুলের খোলাবাড়ীয়াতে ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকেই কথা হয় স্থানীয় কৃষক ও ধান কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে। কৃষকদের মলিন মুখের দিকে চাইলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না ভাল নেই তারা।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিনকেদিন বেড়ে চলা সার-বীজের দাম, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি অপরদিকে বাজারে ধানের নিন্মমূল্য কৃষিজীবীদের বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জকে আরও প্রবল করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ উঠিয়ে আনাও দুরূহ হয়ে পড়ছে তাদের।

পুরোপুরি কৃষি নির্ভরশীল এখানকার বিপুল সংখক অধিবাসীর চোখেমুখে তাই হতাশার ছাপ। বাজারে নিত্যপণ্যের উর্ধ্বমূল্য, সন্তানদের লেখাপড়া-চিকিৎসার খরচ কিংবা মেয়ের বিয়ে দেয়া-এর সবই তাদের কাছে এখন চরম দুশ্চিন্তার।

তবে উল্টোচিত্র দেখা গেল মাঠে ধান কাটতে আসা কৃষি শ্রমিকদের মাঝে, তারা বেশ উৎফুল্ল। তারা দিনে গড়ে চারশ’ থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা মজুরি পাচ্ছেন, মিলছে ফ্রি তিনবেলা খাওয়ার সুযোগও।

কৃষি শ্রমিকের সংকটের কালে তারা বেশ কদরে থাকলেও মলিন মুখে কৃষকরা। তারা গভীর মনযোগে ধান পরিমাপের সময় চোখ রাখছেন বিঘায় ক’মণ ধান ফলেছে, পারবেন তো খরচ উঠিয়ে খানিকটা রাখতে?

কৃষকদের এমন মলিন-বিবর্ণ মুখ দেখে বিষন্ন মনে যখন পাটুলকে বিদায় জানাব তখন দিগন্ত বিস্মৃত নীলাকাশ আর কিচির-মিচিরে মুখর পাখির দলের অভ্যর্থনা মানুষের চিরকালের জীবনসংগ্রামের এই বিষাদ অলক্ষ্যেই কিছুটা ভুলিয়ে দিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে সূর্য তখনও পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়নি। সংগ্রামী এসব মানুষদের প্রতি নীরব ভালোবাসা জানিয়ে যান্ত্রিক ঢাকার পথে যাত্রা…

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ফসলের মাঠে কৃষকের বিষন্ন মুখ

আপডেট টাইম : ১২:৪৮:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিজ উৎপাদনে কিছু অঞ্চল বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। নদী বিধৌত ও অসংখ্য খাল-বিল বেষ্টিত উত্তরের জনপদ নাটোর তারই একটি।

বহুকাল ধরে জলজ প্রকৃতির সাহচর্যে বছরের সিংহভাগ সময় ঘনিষ্ট থাকা উর্বর এই জনপদের মানুষদের জীবন-জীবিকা আবর্তিত কৃষির উৎপাদন আর মৎস্য আহরণে। সুজলা-সুফলা বাংলার যে পরিচয় বিধৃত সর্বত্র তা আসলে এমনসব জনপদেরই কারণেই।

বৈশাখের এই ভরা মৌসুমে ধান কাটার উৎসবে নাটোর তার প্রকৃত ঐশ্বর্য মেলে ধরে। এখানকার বিস্তৃত সোনালী ফসলের মাঠ আর পাকা ধানের মন মাতানো ঘ্রাণ যে কাউকেই আকূল না করে ছাড়ে না।

নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার বৃহত্তর চলনবিলের অংশবিশেষ পাটুল বিল। ভরা বর্ষায় এবিল যেন রূপ নেয় সমুদ্রে। বর্ষা শেষে পলি সমৃদ্ধ বিশাল সমতল উর্বর ভূমি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে কৃষি উৎপাদনের। বছরে একটি মাত্র ফসল আবাদ করতে পারেন স্থানীয় কৃষিজীবীরা, বলা যায় এতেই সারা বছরের বেঁচে থাকবার সঞ্চয় সংগ্রহ করতে হয় তাদের।

শুক্রবার সত্যিকারের ‘কৃষি পর্যটন’এর এই জনপদে এসে দেখা গেল, সেচ দেয়ার জন্য বিদ্যুতচালিত গভীর নলকূপের সুবিধাও আছে এখানে। রাজধানী ঢাকা থেকে চরম তাপদাহকে সঙ্গী করে যখন পাটুলে পৌছাই ততক্ষণে বেলা দুপুর।

মাঠ থেকে কষ্টের সোনার ফসল ঘরে তোলার কৃষকের আনন্দের যে উৎসব দেখতে সেখানে যাওয়া-প্রচন্ড দাবদাহে তা অনেকটাই উৎসাহে কমিয়েছে। কিন্তু সেখানে পৌছে খোলা আকাশের নীচে সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপকে উপেক্ষা করে কৃষকদের ধান কাটা, মাড়াই আর ফসল উঠিয়ে নেয়ার ব্যাপক উৎসাহ-আয়োজন দেখে বিস্ময় মানতে হয়!

অসংখ্য মানুষের কলরবে মুখরিত পাটুলের খোলাবাড়ীয়াতে ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকেই কথা হয় স্থানীয় কৃষক ও ধান কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে। কৃষকদের মলিন মুখের দিকে চাইলেই বুঝতে অসুবিধে হয় না ভাল নেই তারা।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিনকেদিন বেড়ে চলা সার-বীজের দাম, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি অপরদিকে বাজারে ধানের নিন্মমূল্য কৃষিজীবীদের বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জকে আরও প্রবল করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ উঠিয়ে আনাও দুরূহ হয়ে পড়ছে তাদের।

পুরোপুরি কৃষি নির্ভরশীল এখানকার বিপুল সংখক অধিবাসীর চোখেমুখে তাই হতাশার ছাপ। বাজারে নিত্যপণ্যের উর্ধ্বমূল্য, সন্তানদের লেখাপড়া-চিকিৎসার খরচ কিংবা মেয়ের বিয়ে দেয়া-এর সবই তাদের কাছে এখন চরম দুশ্চিন্তার।

তবে উল্টোচিত্র দেখা গেল মাঠে ধান কাটতে আসা কৃষি শ্রমিকদের মাঝে, তারা বেশ উৎফুল্ল। তারা দিনে গড়ে চারশ’ থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা মজুরি পাচ্ছেন, মিলছে ফ্রি তিনবেলা খাওয়ার সুযোগও।

কৃষি শ্রমিকের সংকটের কালে তারা বেশ কদরে থাকলেও মলিন মুখে কৃষকরা। তারা গভীর মনযোগে ধান পরিমাপের সময় চোখ রাখছেন বিঘায় ক’মণ ধান ফলেছে, পারবেন তো খরচ উঠিয়ে খানিকটা রাখতে?

কৃষকদের এমন মলিন-বিবর্ণ মুখ দেখে বিষন্ন মনে যখন পাটুলকে বিদায় জানাব তখন দিগন্ত বিস্মৃত নীলাকাশ আর কিচির-মিচিরে মুখর পাখির দলের অভ্যর্থনা মানুষের চিরকালের জীবনসংগ্রামের এই বিষাদ অলক্ষ্যেই কিছুটা ভুলিয়ে দিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে সূর্য তখনও পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়নি। সংগ্রামী এসব মানুষদের প্রতি নীরব ভালোবাসা জানিয়ে যান্ত্রিক ঢাকার পথে যাত্রা…