জাতিসত্তার বিকাশে মানুষে মানুষে সংযোগের প্রধান বাহন ভাষা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মানুষে মানুষে সংযোগের প্রধান বাহন ভাষা। নিজেকে ব্যক্ত করার অপরিমেয় ক্ষমতার আধার ভাষা একান্তই একটি মানবিক প্রপঞ্চ। মানুষের এ সহজাত বৈশিষ্ট্য জীবজগতে অনন্য।

অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় মানুষের এ বৌদ্ধিক অভিব্যক্তি সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় একটি জনগোষ্ঠী প্রাত্যহিক ভাষা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে। এভাবেই বেড়ে ওঠে ভাষা, তিলে তিলে সমৃদ্ধ হয়।

জনপদের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, উৎপাদনব্যবস্থা, শারীরিক গড়ন, মানসিক ধাঁচ, জীবনচর্যা এমনকি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্পর্শ সমাজ মননের আদল গঠনে প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রবল ভূমিকা রেখে চলে ভাষা। ভাষা বিকাশের পেছনে কাজ করে একটি সমাজের বহু শ্রম, বহু ত্যাগ, বহু সাধনা। সৃষ্টিলগ্ন থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ভাষার লক্ষণীয় বিবর্তনই সেই সাক্ষ্য বহন করে চলে।

পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। ১১টি ভাষা সর্বাধিক ব্যবহৃত। চীনা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, স্পেনীয়, আরবি, রুশ, বাংলা, জার্মান, জাপানি, ফরাসি- বিভিন্ন ক্ষুদ্র-বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠী এ ভাষাগুলো ব্যবহার করে। আগামী ১০০ বছরে প্রায় ৩ হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

বিশ্ব মানচিত্রের আনাচে-কানাচে ভাষাবৈচিত্র্যের এমন নানা খণ্ডচিত্র ভেসে উঠে। দাপুটে ভাষার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে এমন ভাষার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আর ভাষার মৃত্যু একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, বিশ্বাস- সবকিছু বিস্মৃতির অতল গহিনে ঠেলে দেয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণেই ভাষাগোষ্ঠীগুলোর বিলোপ ঘটতে শুরু করে। ভাষাতাত্ত্বিকরা উদ্বিগ্ন- এ শতকের শেষে প্রচলিত অর্ধেক ভাষার মৃত্যু প্রায় সুনিশ্চিত।

সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ভাষাবোধ। বাঙালির প্রাত্যহিকতায় এখন সাহিত্যচর্চার পরিসর সংকীর্ণ। ভাষার সৃষ্টি ভাব থেকে। আর ভাবপ্রকাশের বাহন ভাষাই। তাই ভাব ও ভাষার সম্পর্ক গভীর। বিবর্তনের চিহ্ন বহন করে ভাষা।

ভাষা বিশ্লেষণ করেই একটি সমাজ বা গোষ্ঠীর চরিত্র, মানসগঠন ও আচরণ সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। মানবকুলের মতোই ভাষাও নানা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিশীলন ও আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে নিজে সমৃদ্ধ হয়। যে কোনো শক্তিশালী ভাষার এটাই ধর্ম। ভাষার আরেকটি সহজাত প্রবণতা হল- যে কোনো উৎস থেকে শব্দগ্রহণ করা। বিদেশি শব্দের অস্তিত্ব সব সময় সব ভাষায় ছিল, আছে ও থাকবে। মুশকিল ঘটে তখনই, যখন ব্যক্তি মাতৃভাষার প্রতি তার মমত্ব হারিয়ে ফেলে।

অন্যের ভাষায় গরিমার সন্ধান পায়। আর শহর বা শহরতলির নব্য একটি এলিট প্রজন্ম জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। সেখানে প্রবলতর ভাষার আধিপত্যের বিষয়টি গৌণ।

দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষায় সাবলীল হতে পারলে, সোজা কথায়, শুদ্ধভাবে বলতে কিংবা লিখতে পারলে তাতে দোষের কিছু থাকে না। কিন্তু ভাষায় শব্দের যথেচ্ছ ও বেহিসেবি অনুপ্রবেশ ভাষার লালিত্য, মাধুর্যকে নষ্ট করে। মনগড়া বিকৃত বাংলার ব্যবহার ভাষার বিপন্নতার একটা অসহায় চিত্র মেলে ধরে। আসলে ভাষার সঙ্গে থাকে আবেগ, যাকে আঘাত করলে ভাষায় ছন্দপতন ঘটে, ভাষা নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।

ভাষার বিকাশ ঘটে মানুষের দৈনন্দিনতায়, সামাজিকতায়। বলা ও শোনার মধ্য দিয়ে। কথ্য ভাষার এ চর্চাকে সংকেতের মধ্য দিয়ে লেখ্য ভাষায় রূপান্তর করা হয়। প্রায় হাজার বছর যাবৎ বাঙালি লিখিত ভাষার এ চর্চা করে আসছে। ১৮ শতকের আগে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র পরিচিতি ছিল না। পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত, সাধারণের কাছে লৌকিক ভাষা গ্রাহ্য ছিল। কথ্য ভাষার গঠনশৈলী বিচিত্র।

বাক্যগঠনের বিভিন্নতা, শব্দে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব ও ধর্ম-জাতি-জীবনাচরণের ছাপ উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলা ভাষার কলেবর তৈরি করেছে। ভাষা রাজনৈতিক সীমা মানে না। ভাষার ঐতিহ্য বহমানতা। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন অঞ্চল ও সময়ের নানা মিশ্রস্রোত ভাষার মূলধারায় মিশেছে। এভাবেই বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি ও উৎকর্ষ ঘটেছে। ১৯ শতকে গৌড়ীয় ভাষায় ব্যাকরণ প্রণীত হয়।

উইলিয়াম কেরির ব্যাকরণ মূলত সাধু ভাষার ব্যাকরণ। রাজা রামমোহন রায়, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের কাঠামো প্রণয়ন ও ভাষার প্রমিতকরণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরী ভাষার কথ্যরূপের আদর্শ কাঠামো দাঁড় করিয়ে বাংলাকে বিশ্বমানের ভাষায় উন্নীত করেন।

১৮ শতক থেকেই এ জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে জাতি হিসেবে বাঙালি, আর তাদের মুখোচ্চারিত ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শুধু রাষ্ট্র পরিচালনায় নিছক কোনো দল বা ব্যক্তির বদল হয়নি, রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ-দর্শনও পাল্টে যায়। মুক্তিযুদ্ধের অবলম্বন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উৎখাত করে সাম্প্রদায়িক বিষযুক্ত জাতীয়তাবাদের ধারণাকে জনমানসে কৌশলে সংক্রমিত করা হয়। রাষ্ট্রের মদদে চলতে থাকে সামাজিক বিভাজন প্রক্রিয়া।

ড. কুদরাত-ই-খুদার বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য থেকে দেশ কক্ষচ্যুত হয়। সমাজকাঠামোয় বিভেদ, বৈষম্য ও কৃত্রিম বিভাজন তৈরি হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন বিশ্বজনীন শিক্ষা অধরা থেকে যায়। রাষ্ট্রের সমর্থনে বেড়ে ওঠা নব্য এলিট শ্রেণির সেবায় রাতারাতি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো গজিয়ে উঠতে শুরু করে।

নতুন কর্পোরেট বেনিয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় এরা তৎপর হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নব্য এ গোষ্ঠীর কাছে তাচ্ছিল্য ও অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আশ্রয় হয় মাদ্রাসা, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ভাষাশিক্ষার সুযোগ অপ্রতুল। নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য অবশিষ্ট থেকে যায় মানহীন সাধারণ শিক্ষা।

সমস্বত্ব একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্য সামাজিক বিভক্তির এ আয়োজন পাকিস্তানি ভাবধারা ও নব্য ঔপনিবেশবাদের একটি অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত। অর্থনৈতিকভাবে সম্পন্ন পরিবারের জন্য ইংরেজি। প্রান্তিক পরিবারের অবলম্বন বাংলা কিংবা আরবি। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজনের এ ধারা জাতিসত্তা বিকাশের পথে স্পষ্ট অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল এবং অনেকেই সদ্য স্বাধীন এ দেশের মুক্ত আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ করেছিলেন।

বাংলা ভাষা ক্ষমতাহীনদের কাছে শুধু সীমিত বা আঞ্চলিকতায় পীড়িত হয়ে পড়ছে তা নয়, ভাষাটি ইংরেজি, হিন্দি বা আরবির অনিয়ন্ত্রিত ও যথেচ্ছ অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।

আসলে বাংলা ভাষা ক্ষয়ের একটা পর্যায় অতিক্রম করছে। ২১ শতকের প্রজন্ম ইংরেজির প্রতি যতটা যত্নশীল, বাংলার প্রতি ততটা নয়। ভুল বানান শিশুকে বিভ্রান্ত করে। সেখান থেকে জন্ম নেয় মাতৃভাষার প্রতি অনীহা আর সৃষ্টি হয় মানসিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব। প্রথম প্রজন্ম অথবা নিম্নবিত্তের মানুষের মাঝে এখনও বেঁচে আছে বাংলা।

মাতৃভাষার সাবলীল রূপ এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে গ্রামবাংলায়। উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চমধ্যবিত্তের কাছে বাংলা বলতে না পারাটা গর্বের। ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। শহর বা শহরতলিতে তো বটেই, এমনকি গ্রামেগঞ্জেও গজিয়ে উঠছে নিম্নমানের ইংলিশ মিডিয়াম কেজি বা আরবি ব্রান্ডে ইসলামী ক্যাডেট স্কুল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কর্পোরেট শিল্প, বিজ্ঞাপন, বিপণিবিতানের নামকরণ এমনকি অফিস-আদালতে পর্যন্ত ইংরেজির একচেটিয়া দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত। বাংলা সেখানে প্রায় ব্রাত্য।

শ্রেণি, পেশা, ধর্র্ম, আদর্শ নির্বিশেষে নতুন প্রজন্ম ছুটছে ইংরেজির দুর্নিবার আকর্ষণে। দেশের সন্তানরা নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি পড়ছে না। কোরিয়া, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের ভাষাপ্রেম ও সামাজিক উন্নয়নের মডেলকে তারা আমলে নিচ্ছে না। গবেষকদের থিসিসও অভিজাত হয়ে যাচ্ছে যদি কিনা তা ইংরেজিতে লেখা হয়। অবচেতন মনে বাংলার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা বা কুলীন সাজার লালসা বাংলাকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

একটি জাতির অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে তার ভাষার সঙ্গে। রক্তের দামে কেনা এ ভাষা বিশ্ব দরবারে প্রাপ্য সম্মান, উপযুক্ত মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে। গর্বিত এ নাগরিক সমাজের বাংলার প্রতি এমন অবহেলা খুবই বেমানান। আসলে বিপন্ন ও বিলীন ভাষাগোষ্ঠী পরিচর্যার অভাবে ধ্বংসের কাছে পৌঁছে যায়।

নিজের ভাষার প্রতি মমত্বই মানুষকে অন্যের ভাষার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। অভিভাবকের নির্লিপ্ততা বা কৌলীন্যের ভ্রান্তধারণা সংকটকে দীর্ঘায়িত করে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে না পারলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না, মাটি ও শিকড় ঠিক রেখে ফসল ফলানোই গৌরবের। কল্পনার পরিচর্যা, ভাবনার পরিশীলন মায়ের ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল, বিশ্বের যেখানেই চিন্তাশক্তির উৎকর্ষ ঘটেছে, সেখানেই নিয়ামক হয়ে উঠেছে মাতৃভাষা।

৩০ কোটি বাংলাভাষী বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাংলাকে জীবন্ত করে রেখেছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিচারে বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম ভাষা বাংলা। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা- সর্বত্রই বাংলার সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। সাহিতচর্চা, রাজনীতি, অর্থনীতি বা আধ্যাত্মিকতা সবখানে বাংলাভাষাই বাহন হয়েছিল বিশ্বজয়ের।

বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যজিৎ, রবিশঙ্কর, অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ, ইউনুস, বিবেকানন্দ, সত্যেন বোস, সৌরভ বা সাকিব- সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে বিশ্ববাসীর সমীহ আদায় করে নিয়েছে। বাবুর্চিখানা থেকে নাসা- সবখানেই বাঙালির স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত, মেধার স্ফুরণ দৃষ্টিগ্রাহী।

জাতিসত্তা গঠনে ভাষার ভূমিকা অগ্রগণ্য। জাতিগঠনেও ভাষার অবদান অসামান্য। ভারতীয় ভাষাগুলো আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। চারপাশে অনার্য-অস্ট্রো এশিয়াটিক, দ্রাবিড়ীয়, চীনা-তিব্বতি। স্বাধীন সুলতানি আমল ছিল হিন্দু-মুসলমান মিলিত শাসনের সুবর্ণ যুগ। ষোড়শ শতকে মোগল প্রভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজে এক ধরনের সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি হয়।

কৌলীন্য ও আভিজাত্যের ধারণা মানসজগতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। যে জনগোষ্ঠী নিজেদের আশরাফ ভেবেছে তারা উর্দুকেই মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। গবেষকরা মনে করেন, কালের বিবর্তনে মুসলমান সম্প্রদায়ও বাংলাকে শুধু মাতৃভাষা নয়, জাতীয় ভাষা হিসেবে মান্যতা দিয়েছে। উর্দু না বাংলা- এমন উদ্ভট প্রশ্নের মুখে বাঙালিকে বারবার পড়তে হয়েছে।

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন বা ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ্র ভাষানীতি বাঙালি সমাজের মধ্যে ভীতি ও নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করলেও দ্বিধা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। ড. শহীদুল্লাহ বাঙালির জাতিগত পরিচয় ও মাতৃভাষা সংক্রান্তে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ছিলেন।

জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বাংলামুখী করা যাবে না। বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অনেকদিন ধরেই আবহমান সংস্কৃতি নানা বিকৃতি, বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের আত্মঘাতী ধারায় প্রবাহিত।

ইংরেজি মাধ্যমের লেবাসধারী বেনিয়াগোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রাষ্ট্রীয় নীতির আদর্শিক অস্থিরতা বা দুর্বলতার সুযোগগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছে। ভাষাহীন, সংস্কৃতিবিবর্জিত, শিকড়মুক্ত একটি প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা সহজ। সমাজ এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। দেশপ্রেমহীন কর্পোরেট ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র, অদূরদর্শী রাজনীতি, স্বল্পদর্শী অভিভাবক- কেউই এ দায় এড়াতে পারে না।

ভাষাকে মূলমন্ত্র করে যে দেশের অভ্যুদয় ঘটে, সে দেশে আদর্শের এমন স্ববিরোধ, নীতির এমন স্খলন, দৃষ্টির এত অস্পষ্টতা-কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বাঙালিত্বের প্রধান বাহক ও প্রতীক ভাষা। সে ভাষাই আজ সীমাহীন লাঞ্ছনা ও অবজ্ঞার মুখে। আত্মপরিচয়ের প্রধানতম স্মারক ভাষা যখন বিপন্ন হয়, তখন বাঙালির সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনচর্যা- এক কথায় জাতিগত অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। ভাষার মর্যাদা রক্ষা, সর্বস্তরে প্রয়োগ, প্রচার, প্রসার ও গুণগত মানরক্ষাই বৌদ্ধিক সমাজের প্রধান দাবি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যম যাতে বাংলা হয় সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু আমাদের বারবার পথ দেখিয়েছেন। যুক্তি, তর্ক ও বুদ্ধির সহযোগে প্রমাণ করেছিলেন যে, মেধার অপচয় রোধ করে মায়ের ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা আমাদের লক্ষ্যের সৌধে পৌঁছে দিতে পারে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাঙালি অসাধারণ মেধার সাক্ষ্য রেখেছে।

প্রযুক্তিনির্ভর সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। বাংলাভাষায় অনেক মৌলিক গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। এ অনুবাদ শিল্পকে আমাদের সমৃদ্ধ করতে হবে যাতে করে বিশ্বজনীন জ্ঞানভাণ্ডারে আমাদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হয়, অন্যদিকে বাংলাভাষার উৎকর্ষ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে।

বাঙালিরা নিছক একটি জনসমষ্টি নয়। বাঙালিত্ব একটি ধারণা যা উদারবাদে দীক্ষিত, নবজাগরণের আলোয় স্নাত। সমস্বত্ব জাতির বিভাজন কখনই প্রত্যাশিত নয়। আদর্শিক শূন্যতা থেকে দুর্নীতি, নৃশংসতা এমনকি জঙ্গিবাদের উত্থান পর্যন্ত ঘটতে পারে। শিকড় নড়বড়ে থাকায় মিথ্যা তথ্য সহজেই মগজে ঠাঁই পায়, জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকরা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিষ্পাপ শিশুদের মগজ ধোলাইয়ের সুযোগ পায়। আরবি, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি সব ভাষাই গ্রাহ্য, শুধু বাংলাই আজ ব্রাত্য।

পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা- সর্বত্রই বিজাতীয় সংস্কৃতির দাপট। পাঠ্যপুস্তক, কারিকুলাম-সবখানেই আপস। জাতি দৃশ্যত লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীন। মনোজগতে ঔপনিবেশিক দাসত্ব, আদর্শিক দেউলিয়াত্ব। এভাবেই তৈরি হচ্ছে বৈরী একটি সামাজিক মনস্তত্ত্ব। চেতনার আধিপত্য কখনই শাশ্বত নয়, তা পরিবর্তনের সম্ভাবনায় সদা জাগ্রত। দ্বিধাবিভক্ত সমাজ কারও কাম্য নয়। উদার, বহুত্ববাদী, জনকল্যাণকর রাজনীতির নবনির্মাণ জরুরি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর