ঢাকা ০৫:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিপিএমের কৌশলে আওয়ামী লীগ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১৪:৫০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৫
  • ৩৬৮ বার

দুই বিদেশী হত্যাকান্ড নিয়ে যখন দেশ-বিদেশে তোলপাড়, ঠিক তখনই হঠাৎ করে বিতর্ক শুরু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচন নিয়ে। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অরাজনৈতিকভাবে হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। হঠাৎ দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান-মেয়র প্রার্থীরা রাজনৈতিক দলের নৌকা-ধানের শীষ-লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হবে, এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সব দলের সঙ্গে আলোচনা আবশ্যক। অথচ সংবিধান স্থগিত করে ক্ষমতায় আসা সেনা শাসকদের হঠাৎ হঠাৎ প্রজ্ঞাপন জারি করে জনগণের ওপর সিদ্ধান্ত-আইন চাপিয়ে দেয়ার মতোই হঠাৎ মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দলীয় ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচনের। মন্ত্রিসভার এ সিদ্ধান্তের পর এ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ হচ্ছে; বিতর্ক যুক্তিতর্ক চলছে। বিএনপি এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ‘বাকশালের’ ছায়া দেখতে পারছেন। আওয়ামী লীগ ও তাদের স্তাবকরা দলের ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচন ইস্যুতে ‘বাবু যাহা কহেন; পারিষদ কহেন তার শতগুণ’-এর মতো দলীয় ব্যানারে নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তাদের এই সাফাই অনেকটা হাটে-বাজারে ‘শালসা’ ও ‘শ্রীপুরের বড়ি’ বিক্রী করা হকারদের গলাবাজির মতোই। এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুবিধা-অসুবিধাগুলো তুলে ধরছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বর্তমান সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ‘রসায়ন’ কৌশল হিসেবে নিচ্ছে। স্থানীয় সরকার নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, ‘এই উদ্যোগ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে এবং ক্ষমতাসীন দলই স্থানীয় সরকার গ্রাস করে ফেলবে। এছাড়া প্রভাবশালী, বিত্তবান ও রাজনৈতিক দাপটে থাকা খারাপ লোকের নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ প্রশস্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারীর মতে, সরকার গণবিচ্ছিন্ন এটা তারা ভালভাবেই জানে। প্রশাসনকে তারা দলীয়করণ করেছে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এখন সিপিএমের মতো স্থানীয় সরকারগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে গণতন্ত্রের বদলে ক্ষমতাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সিপিএমের নেতৃত্বে যে কৌশল খাটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল; আওয়ামী লীগ সে পথেই হাঁটতে চাচ্ছে। সত্যিই কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের নেতৃত্বাধীন ‘বামফ্রন্টের থিউরি’ বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে চায়? কি সেই বামফ্রন্টের থিউরি? কোন যাদুমন্ত্রে কংগ্রেসের মতো দলকে ধরাশায়ী করে বামফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমেই দীর্ঘ ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ছিল? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ বলেছেন, হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্তে মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলছে; তবে সাফল্য পেতে হলে নির্বাচনী পদ্ধতিতে আমূল সংস্কার করতে হবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে। কারণ, মানুষ নিকট অতীত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের স্টাইল দেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস এক নিবন্ধে লিখেছেন,‘তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন আনছে দুগ্ধপোষ্য শিশুও তা বিশ্বাস করবে না।’ ড. তুহিন মালিক লিখেছেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হলে বিএনপিকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হবে, তার গ্যারান্টি কোথায়?’জনগণের ভোটে ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। কয়েকটি বাম দলের সমন্বয়ে সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয় বামফ্রন্ট সরকার। দীর্ঘ ৩৪ বছর তারা ক্ষমতায় ছিল। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বার বার বামেরা নির্বাচিত হয়েছেন। গোটা ভারতে যখন কংগ্রেস আর বিজেপির দুর্দান্ত দাপট, তখন পশ্চিমবঙ্গে বামদের এতো জনপ্রিয়তার নেপথ্যের রসায়ন কি? পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ মানুষ কি বামদের উন্নয়ন সাফল্যের কারণে বার বার তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে? নাকি এর ভিতরে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে ছিল? মূলতঃ বামফ্রন্ট নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে বেশ কিছু রাজ-চালাকি পদক্ষেপ নেয়। আর দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার সুবাদে দলের নেতাদের স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচিতের মাধ্যমে ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন গ্রাস করে নেয়। ওপর-নীচে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে আজ্ঞাবহ করে। গ্রাম পর্যায়ে জনসমর্থন কমে গেলেও কৃষক সভার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা করে নিজেদের ‘জনপ্রিয়’ হিসেবে মিডিয়ায় প্রচার করে। স্থানীয় প্রশাসনকে ভ্যানগার্ডের মতো ব্যবহার করা হয়। গ্রাম পর্যায়ে সুবিধাভোগী চক্র সৃষ্টি করায় তৃণমূলে দলের কর্মী তৈরি করা হয়। আর নির্বাচন যেভাবেই হোক জনগণ যাদের ভোট দিক না কেন শেষ বিকেলে প্রশাসনের সাফল্যে(!) বামফ্রন্টের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়। কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনে দলীয় লোক নিয়োগ দেয়া হতো। জনগণ যতই প্রতিবাদী হোক মিডিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্ত অবস্থান সবাইকে জানান দেয়া হতো। আর জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনের বদলে ‘বামফ্রন্টের স্তুতি’ গাওয়ার জন্য রাজ্যের একঝাঁক বুদ্ধিজীবী, সুশীল, সাংস্কৃতিক কর্মী সৃষ্টি করা হয় প্রচুর অর্থব্যয়ে। মিডিয়ার পিছনেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হতো। মিডিয়ার ‘নিত্য ভয়েস’ আর বুদ্ধিজীবী সুশীলদের ‘আওয়াজে’ সাধারণ মানুষের কণ্ঠ চাপা পড়ে যেত। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বামফ্রন্ট দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকে। প্রশাসন দল অনুগত হলে নির্বাচনে জনগণ যাকেই ভোট দিন না কেন দিনের শেষে তার হিসেব হতো বামফ্রন্টের প্রার্থীদের ঝুড়িতেই যেত। অবশ্য তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বামপন্থীদের এই ‘নীল নকশা’ আর ‘রাজ চালাকির’ মুখোশ খুলে দেয়ার কারণে বামফ্রন্ট এখন বিপর্যস্ত। ঢাকার বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বামফ্রন্টের সে পথেই হাঁটছে। দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো তৃণমূলের প্রশাসনে দলীয় প্রতিনিধি বসিয়ে ‘কেন্দ্র থেকে তৃণমূল’ প্রশাসনকে গ্রাস করতে চান? প্রশাসনকে ব্যবহার এবং তথাকথিত উন্নয়নের জিকির তুলে জন অসন্তোষ, ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র চাপা দিয়ে ক্ষমতাতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান? এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক চলছে।পশ্চিবঙ্গের সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের মতোই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোট বর্তমানে ক্ষমতায়। তাদের সঙ্গে রয়েছে বামনেতা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, দীলিপ বড়ুয়া। প্রশাসনে দলীয়করণের মাধ্যমে এমন পর্যায়ে নেয়া হয়েছে যে জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কার্যতঃ ‘আওয়ামী লীগের অনুগত’ কর্মচারীতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, পুলিশকে ব্যবহার করে হামলা-মামলা-নির্যাতনের মাধ্যমে সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মার্জিনালাইজড করার চেষ্টাও হচ্ছে। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের ক্ষমতায় আসার পর এবং বিগত ৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ কি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? তৃণমূলে গণতন্ত্র চর্চার প্রীতি থাকলে দীর্ঘদিন থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অনির্বাচিত কেন? উপজেলা চেয়ারম্যানকে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছে কেন? আইনের অজুহাত তুলে বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান) বরখাস্ত করা হচ্ছে কেন? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ, সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের হঠাৎ সিদ্ধান্তে ‘অবাক’ হলেও তারা এর বিরোধিতা করেন নি। তবে নির্বাচনে যাতে মানুষ ভোট দিতে পারে এবং ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ভোটের মতো গ্রাস করা হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে তারা সকলেই প্রশ্ন তুলেছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে না জানিয়ে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় মানুষের মধ্যে সন্দেহ হচ্ছে। রোবায়েত ফেরদৌস লিখেছেন ‘সরকার থেকে প্রচার করা হচ্ছে দলীয় ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন এবং দেশে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করবে। কিন্তু আসলেই কি তাই? যেখানে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন দেশে বিদেশের অধিকাংশ মানুষ অসুষ্ঠু, একতরফা ও পক্ষপাতযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে; সেখানে শাসকবর্গ নামকাওয়াস্তে ‘মহাবিতর্কিত’ ওই নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে। সেখানে তারা তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরিবর্তন এনেছেন, দুগ্ধপোষ্য শিশুও সরকারের এহেন সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। ড. তুহিন মালিক লিখেছেন, সংশোধিত এ আইনটি অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, জরুরী ভিত্তিতে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। আসলে সংসদেই সব আইন পাস করার কথা। একমাত্র সংসদ অধিবেশন না থাকলেই এবং অতি জরুরীভাবে কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেই প্রেসিডেন্ট তখন সংবিধানে প্রদত্ত তার ক্ষমতাবলে জরুরী ভিত্তিতে অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে এবং দলের প্রতীকে করতে হবে- আইন প্রণয়ন করা এতটা জরুরী কেন হলো? রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা না বলে হঠাৎ করেই এ রকম গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। যাদের সঙ্গে খেলতে যাবেন সেই দলগুলোকে না জানিয়ে, তাদের ছলনা করে খেলার মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে একতরফা বিজয়ী হওয়ার মধ্যে তো কোনো গৌরব থাকতে পারে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হলে বিএনপিকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা সিটি নির্বাচনে খালেদা জিয়ার মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়ে পুলিশের সামনেই অনবরত হামলা করা হলো তাতে আগামীতে স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা ছাড়া অন্যসব প্রতীকের প্রার্থীদের কী অবস্থা দাঁড়াবে বলা মুশকিল। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপিরা দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালালে ভোটে নিরপেক্ষতা থাকবে? আওয়ামী লীগ আসলেই কি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করে? কারণ, কোনোরকম নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে জেলা পরিষদগুলো পরিচালনা করানো হচ্ছে। সরকার যাদের এমপি-মন্ত্রী করতে পারেনি এমন ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্যই জেলা পরিষদগুলোয় বসিয়ে রাখা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৮৮টি উপজেলা পরিষদ, ৬৪টি জেলা পরিষদ, ৩২৩টি পৌরসভা ও ১১টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মতো স্থানীয় এই প্রশাসনগুলো গ্রাস করে দলীয় লোকজন বসাতেই সিপিএমের মতো কৌশল নিচ্ছে সরকার- এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সবার কাছে পরিষ্কার আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক ধারায় থাকতে চায় না। দেশের জনগণ কাছে তাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সে রিপোর্ট তাদের হাতে রয়েছে। এ জন্য গণতন্ত্রের লেবাসে এখন ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম করতে চাচ্ছে। সে জন্য তারা প্রশাসন, পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণের পর পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের মতোই কৌশল নিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনগুলোতে নিজেদের লোকদের তথাকথিত ভোটের মাধ্যমে (ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন যে ভাবে হয়েছে) বসিয়ে প্রশাসনকে কব্জা করতে। মানুষ যতই বিক্ষুব্ধ হোক তৃণমূলের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে থাকলে সরকারের সুবিধা। এভাবে তারা আরো দফায় দফায় ক্ষমতায় থাকার নীল নকশার অংশ হিসেবে সেনা শাসকদের মতোই হঠাৎ করে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই দলীয় ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে খুব সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক নয়। বামফ্রন্টের পরিণতিও মানুষ দেখেছে।-ইনকিলাব

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সিপিএমের কৌশলে আওয়ামী লীগ

আপডেট টাইম : ১১:১৪:৫০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৫

দুই বিদেশী হত্যাকান্ড নিয়ে যখন দেশ-বিদেশে তোলপাড়, ঠিক তখনই হঠাৎ করে বিতর্ক শুরু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচন নিয়ে। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অরাজনৈতিকভাবে হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। হঠাৎ দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান-মেয়র প্রার্থীরা রাজনৈতিক দলের নৌকা-ধানের শীষ-লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হবে, এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সব দলের সঙ্গে আলোচনা আবশ্যক। অথচ সংবিধান স্থগিত করে ক্ষমতায় আসা সেনা শাসকদের হঠাৎ হঠাৎ প্রজ্ঞাপন জারি করে জনগণের ওপর সিদ্ধান্ত-আইন চাপিয়ে দেয়ার মতোই হঠাৎ মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দলীয় ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচনের। মন্ত্রিসভার এ সিদ্ধান্তের পর এ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ হচ্ছে; বিতর্ক যুক্তিতর্ক চলছে। বিএনপি এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ‘বাকশালের’ ছায়া দেখতে পারছেন। আওয়ামী লীগ ও তাদের স্তাবকরা দলের ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচন ইস্যুতে ‘বাবু যাহা কহেন; পারিষদ কহেন তার শতগুণ’-এর মতো দলীয় ব্যানারে নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তাদের এই সাফাই অনেকটা হাটে-বাজারে ‘শালসা’ ও ‘শ্রীপুরের বড়ি’ বিক্রী করা হকারদের গলাবাজির মতোই। এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুবিধা-অসুবিধাগুলো তুলে ধরছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বর্তমান সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ‘রসায়ন’ কৌশল হিসেবে নিচ্ছে। স্থানীয় সরকার নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, ‘এই উদ্যোগ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে এবং ক্ষমতাসীন দলই স্থানীয় সরকার গ্রাস করে ফেলবে। এছাড়া প্রভাবশালী, বিত্তবান ও রাজনৈতিক দাপটে থাকা খারাপ লোকের নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ প্রশস্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারীর মতে, সরকার গণবিচ্ছিন্ন এটা তারা ভালভাবেই জানে। প্রশাসনকে তারা দলীয়করণ করেছে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এখন সিপিএমের মতো স্থানীয় সরকারগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে গণতন্ত্রের বদলে ক্ষমতাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সিপিএমের নেতৃত্বে যে কৌশল খাটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল; আওয়ামী লীগ সে পথেই হাঁটতে চাচ্ছে। সত্যিই কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের নেতৃত্বাধীন ‘বামফ্রন্টের থিউরি’ বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে চায়? কি সেই বামফ্রন্টের থিউরি? কোন যাদুমন্ত্রে কংগ্রেসের মতো দলকে ধরাশায়ী করে বামফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমেই দীর্ঘ ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ছিল? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ বলেছেন, হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্তে মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলছে; তবে সাফল্য পেতে হলে নির্বাচনী পদ্ধতিতে আমূল সংস্কার করতে হবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত মানুষকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে। কারণ, মানুষ নিকট অতীত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের স্টাইল দেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস এক নিবন্ধে লিখেছেন,‘তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন আনছে দুগ্ধপোষ্য শিশুও তা বিশ্বাস করবে না।’ ড. তুহিন মালিক লিখেছেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হলে বিএনপিকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হবে, তার গ্যারান্টি কোথায়?’জনগণের ভোটে ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। কয়েকটি বাম দলের সমন্বয়ে সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয় বামফ্রন্ট সরকার। দীর্ঘ ৩৪ বছর তারা ক্ষমতায় ছিল। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বার বার বামেরা নির্বাচিত হয়েছেন। গোটা ভারতে যখন কংগ্রেস আর বিজেপির দুর্দান্ত দাপট, তখন পশ্চিমবঙ্গে বামদের এতো জনপ্রিয়তার নেপথ্যের রসায়ন কি? পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ মানুষ কি বামদের উন্নয়ন সাফল্যের কারণে বার বার তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে? নাকি এর ভিতরে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে ছিল? মূলতঃ বামফ্রন্ট নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে বেশ কিছু রাজ-চালাকি পদক্ষেপ নেয়। আর দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার সুবাদে দলের নেতাদের স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচিতের মাধ্যমে ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন গ্রাস করে নেয়। ওপর-নীচে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে আজ্ঞাবহ করে। গ্রাম পর্যায়ে জনসমর্থন কমে গেলেও কৃষক সভার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা করে নিজেদের ‘জনপ্রিয়’ হিসেবে মিডিয়ায় প্রচার করে। স্থানীয় প্রশাসনকে ভ্যানগার্ডের মতো ব্যবহার করা হয়। গ্রাম পর্যায়ে সুবিধাভোগী চক্র সৃষ্টি করায় তৃণমূলে দলের কর্মী তৈরি করা হয়। আর নির্বাচন যেভাবেই হোক জনগণ যাদের ভোট দিক না কেন শেষ বিকেলে প্রশাসনের সাফল্যে(!) বামফ্রন্টের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়। কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনে দলীয় লোক নিয়োগ দেয়া হতো। জনগণ যতই প্রতিবাদী হোক মিডিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্ত অবস্থান সবাইকে জানান দেয়া হতো। আর জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনের বদলে ‘বামফ্রন্টের স্তুতি’ গাওয়ার জন্য রাজ্যের একঝাঁক বুদ্ধিজীবী, সুশীল, সাংস্কৃতিক কর্মী সৃষ্টি করা হয় প্রচুর অর্থব্যয়ে। মিডিয়ার পিছনেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হতো। মিডিয়ার ‘নিত্য ভয়েস’ আর বুদ্ধিজীবী সুশীলদের ‘আওয়াজে’ সাধারণ মানুষের কণ্ঠ চাপা পড়ে যেত। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বামফ্রন্ট দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকে। প্রশাসন দল অনুগত হলে নির্বাচনে জনগণ যাকেই ভোট দিন না কেন দিনের শেষে তার হিসেব হতো বামফ্রন্টের প্রার্থীদের ঝুড়িতেই যেত। অবশ্য তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বামপন্থীদের এই ‘নীল নকশা’ আর ‘রাজ চালাকির’ মুখোশ খুলে দেয়ার কারণে বামফ্রন্ট এখন বিপর্যস্ত। ঢাকার বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বামফ্রন্টের সে পথেই হাঁটছে। দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো তৃণমূলের প্রশাসনে দলীয় প্রতিনিধি বসিয়ে ‘কেন্দ্র থেকে তৃণমূল’ প্রশাসনকে গ্রাস করতে চান? প্রশাসনকে ব্যবহার এবং তথাকথিত উন্নয়নের জিকির তুলে জন অসন্তোষ, ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র চাপা দিয়ে ক্ষমতাতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান? এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক চলছে।পশ্চিবঙ্গের সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের মতোই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোট বর্তমানে ক্ষমতায়। তাদের সঙ্গে রয়েছে বামনেতা রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, দীলিপ বড়ুয়া। প্রশাসনে দলীয়করণের মাধ্যমে এমন পর্যায়ে নেয়া হয়েছে যে জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কার্যতঃ ‘আওয়ামী লীগের অনুগত’ কর্মচারীতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, পুলিশকে ব্যবহার করে হামলা-মামলা-নির্যাতনের মাধ্যমে সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মার্জিনালাইজড করার চেষ্টাও হচ্ছে। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের ক্ষমতায় আসার পর এবং বিগত ৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ কি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? তৃণমূলে গণতন্ত্র চর্চার প্রীতি থাকলে দীর্ঘদিন থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অনির্বাচিত কেন? উপজেলা চেয়ারম্যানকে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছে কেন? আইনের অজুহাত তুলে বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান) বরখাস্ত করা হচ্ছে কেন? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ, সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন দলীয় ব্যানারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের হঠাৎ সিদ্ধান্তে ‘অবাক’ হলেও তারা এর বিরোধিতা করেন নি। তবে নির্বাচনে যাতে মানুষ ভোট দিতে পারে এবং ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ভোটের মতো গ্রাস করা হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে তারা সকলেই প্রশ্ন তুলেছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে না জানিয়ে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় মানুষের মধ্যে সন্দেহ হচ্ছে। রোবায়েত ফেরদৌস লিখেছেন ‘সরকার থেকে প্রচার করা হচ্ছে দলীয় ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন এবং দেশে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করবে। কিন্তু আসলেই কি তাই? যেখানে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন দেশে বিদেশের অধিকাংশ মানুষ অসুষ্ঠু, একতরফা ও পক্ষপাতযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে; সেখানে শাসকবর্গ নামকাওয়াস্তে ‘মহাবিতর্কিত’ ওই নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে। সেখানে তারা তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরিবর্তন এনেছেন, দুগ্ধপোষ্য শিশুও সরকারের এহেন সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। ড. তুহিন মালিক লিখেছেন, সংশোধিত এ আইনটি অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, জরুরী ভিত্তিতে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। আসলে সংসদেই সব আইন পাস করার কথা। একমাত্র সংসদ অধিবেশন না থাকলেই এবং অতি জরুরীভাবে কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেই প্রেসিডেন্ট তখন সংবিধানে প্রদত্ত তার ক্ষমতাবলে জরুরী ভিত্তিতে অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে এবং দলের প্রতীকে করতে হবে- আইন প্রণয়ন করা এতটা জরুরী কেন হলো? রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা না বলে হঠাৎ করেই এ রকম গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। যাদের সঙ্গে খেলতে যাবেন সেই দলগুলোকে না জানিয়ে, তাদের ছলনা করে খেলার মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে একতরফা বিজয়ী হওয়ার মধ্যে তো কোনো গৌরব থাকতে পারে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ব্যানারে হলে বিএনপিকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা সিটি নির্বাচনে খালেদা জিয়ার মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়ে পুলিশের সামনেই অনবরত হামলা করা হলো তাতে আগামীতে স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা ছাড়া অন্যসব প্রতীকের প্রার্থীদের কী অবস্থা দাঁড়াবে বলা মুশকিল। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপিরা দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালালে ভোটে নিরপেক্ষতা থাকবে? আওয়ামী লীগ আসলেই কি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করে? কারণ, কোনোরকম নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে জেলা পরিষদগুলো পরিচালনা করানো হচ্ছে। সরকার যাদের এমপি-মন্ত্রী করতে পারেনি এমন ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্যই জেলা পরিষদগুলোয় বসিয়ে রাখা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৮৮টি উপজেলা পরিষদ, ৬৪টি জেলা পরিষদ, ৩২৩টি পৌরসভা ও ১১টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মতো স্থানীয় এই প্রশাসনগুলো গ্রাস করে দলীয় লোকজন বসাতেই সিপিএমের মতো কৌশল নিচ্ছে সরকার- এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সবার কাছে পরিষ্কার আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক ধারায় থাকতে চায় না। দেশের জনগণ কাছে তাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সে রিপোর্ট তাদের হাতে রয়েছে। এ জন্য গণতন্ত্রের লেবাসে এখন ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম করতে চাচ্ছে। সে জন্য তারা প্রশাসন, পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণের পর পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের মতোই কৌশল নিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনগুলোতে নিজেদের লোকদের তথাকথিত ভোটের মাধ্যমে (ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন যে ভাবে হয়েছে) বসিয়ে প্রশাসনকে কব্জা করতে। মানুষ যতই বিক্ষুব্ধ হোক তৃণমূলের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে থাকলে সরকারের সুবিধা। এভাবে তারা আরো দফায় দফায় ক্ষমতায় থাকার নীল নকশার অংশ হিসেবে সেনা শাসকদের মতোই হঠাৎ করে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়েই দলীয় ব্যানারে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে খুব সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক নয়। বামফ্রন্টের পরিণতিও মানুষ দেখেছে।-ইনকিলাব