সৈকতে ওরা ভয়ংকর ছিনতাইকারী, পর্যটন এলাকার ত্রাস

ওরা ভয়ংকর ছিনতাইকারী। ওরা পুরো পর্যটন এলাকার ত্রাস। সংখ্যায় অন্তত একশ’। কেউ চা বিক্রি করে। কেউ তাদের অভিভাবকদের কাছে সৈকতে ভ্রাম্যমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি। কেউ বা আবার শার্ট প্যান্ট পরিহিত খেতাদরস্ত ভদ্রলোক। চলনে বলনে আশাকে পোশাকে যাই হোক মতলব কিন্তু ওদের একটাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জিম্মি করে মালামাল লুট করে নেয়া।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যে লিলাভুমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত একটি মায়াবী ও রূপময়ী সমুদ্র সৈকত। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এর রূপ পরিবর্তন করে। শীত-বর্ষা-বসন্ত-গ্রীস্ম এমন কোন মৌসুম নেই সমুদ্র সৈকতের চেহারা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যুষে এক রকম তো মধ্যাহ্নে এর রূপ অন্য রকম। গোধুলি বেলার সৈকতের হাওয়া-অবস্থা আর রাতের বেলার আবহাওয়া-অবস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই তো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য ক্যাপ্টেন কক্স এর সমুদ্র সৈকত এত কদরের, এত পছন্দের।
এই সমুদ্র সৈকতে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে একাধিক ছিনতাইকারি গ্রুপ। ইয়াবা পাচার সংশ্লিষ্ট হোটেল মোটেলে মাদক ও নারী সরবরাহসহ এমন কোন অপরাাধ নেই এখন তারা করছে না। এসব ছিনতাইকারি দলে সমাজ সর্দারসহ পেশাদার খুনিও রয়েছে। বিভিন্ন হোটেলে রহস্যজনক হত্যার সাথেও এদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয় থাকায় তারা এতই বেপরোয়া যে বর্তমানে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। ভেতরে ভেতরে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠেছে যে পুলিশও এখন নিরাপদে নেই। আবার এসব ছিনতাইকারি গ্রুপের সাথে সৈকতে দায়িত্বরত ট্যুরিস্ট পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের সাথে সখ্যতারও অভিযোগ উঠেছে।
গত ২৩ জুলাই বৃহস্পতিবার পুলিশের কনস্টেবল পারভেজ হোসেন ছিনতাইকারির ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান। ২৯ আগস্ট সৈকতের ডায়াবেটিস পয়েন্টে মোজাফ্ফর আহমদ (২৫) নামের এক টমটম চালককে জবাই করে হত্যা করা হয়। পর এসব বিষয় বারবার আলোচনায় উঠে আসছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবিয়ে তুলে পুলিশের উর্ধ্বতন মহলসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে।
গত ১৪ অক্টোবর সৈকতের লাবণী পয়েন্ট হতে আটক ৬ ছিনতাইকারীকে আটকের পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত এসব ছিনতাইকারীকে ৩ মাসের কারাদন্ড দেন। একই দিন আরেক ছিনতাইকারীকে আটকের পর ২ হাজার টাকা অর্থদন্ড দেয়া হয়। ১১ জানুয়ারি বিকেলে একজন ছিনতাইকারীকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোজাম্মেল হক রাসেল ও একই দিন অপর তিনজনকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তুষার আহমেদ। এরপরেও উৎপাত চলছে ছিনতাইকারী চক্রের।
সৈকতে ভিক্ষুক ও ভ্রাম্যমাণ চিপস-পানি বিক্রেতারা পর্যটকদের বিরক্ত করে। আইনগতভাবে নিষেধ থাকলেও ভিক্ষুক ও ভ্রাম্যমান বিক্রেতারা তা মানছে না। আইন অমান্যের কারণে দুই নারী ভিক্ষুক, সাত ভ্রাম্যমাণ চিপস ও পানি বিক্রেতা শিশু এবং দুই বাদাম বিক্রেতাকে দণ্ডবিধির ৮৮/২৯১ ধারায় ১৫ দিনের বিনাশ্রম জেল দেয় নির্বাহি ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত।
সংশ্লিষ্ট সকলের প্রশ্ন, পুলিশ যেখানে ছিনতাইকারির হাতে নিহত, সেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা কোথায়? হোটেল মোটেল ও গেষ্ট হাউস মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, এসব চিহ্নিত অপরাধি সম্পর্কে পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়না। ফলে ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দ করে না। কয়েকবছর আগেও ছিনতাইকারীরা এতো বেপরোয়া ছিলনা। কতিপয় অসাধু কটেজ মালিক ও গেষ্ট হাউস তাদের আস্তানা। তবে কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, মোহাজেরপাড়া, বাদশাঘোনা,লাইটহাউস পাড়া, সৈকতপাড়া, সাহিত্যিকা পল্লী, দরিয়ানগর, সমিতিপাড়া, কলাতলি বাইপাস সড়কস্থ পালস স্কুলের পেছনে ও দক্ষিণ আর্দশগ্রামসহ কয়েকটি এলাকা হচ্ছে তাদের মূল আস্তানা। এসব এলাকায় তারা রাজনৈতিক নেতা কর্মী হিসেবে পরিচিত। এমনকি তাদের অভিভাবকদের কাছে সৈকতে ভ্রাম্যমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি হিসেবে পরিচিত ছিনতাইকারীরা। এসব কিছুর আড়ালে তারা কক্সবাজার সৈকতের পর্যটনকেন্দ্রীক এলাকাগুলোতে করে ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম। বর্তমানে কলাতলি হতে কেন্দ্রিয় বাসটার্মিনাল পর্যন্ত বাইপাস সড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গত কোরবানের দিন হতে সন্ধ্যার পর পুরো সপ্তাহ জুড়ে এই বাইপাস সড়কেই ছিনতাইকারীর হাতে ৫ ব্যক্তিগুরুতর আহত ও এক ব্যক্তি নিহতের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশী অভিযানে বিভিন্ন সময় ছিনতাইকারী আটক হয়। সাজাও দেন ভ্রাম্যমান আদালত। কিন্তু ছিনতাইকারীর সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েই চলেছে।
সূত্র মতে, কক্সবাজার সৈকতে আগে পর্যটক স্পট ছিল শুধু লাবণি পয়েন্ট কেন্দ্রিক। বর্তমানে সুগন্ধা, ওশান প্যারাডাইস পয়েন্ট, কলাতলি, দরিয়ানগর, হিমছড়ি ও ইনানী পাথুরে সৈকত পর্যন্ত অনেক স্পটে পর্যটকরা আনাগোনা করে। এছাড়া সাফারী পার্ক, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী সোনাদিয়া, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন প্যাগুডা, ক্যাং, বৌদ্ধ মন্দির, রামু বৌদ্ধ মন্দিরসহ অসংখ্য স্পটে ঘুরে যাচ্ছেন পর্যটকরা। শীত মৌসুম শুধু নয়,বর্ষায়ও ব্যাপকহারে দেশিয় পর্যটকরা ছুটে আসছেন। এমতাবস্থায় টুরিস্ট পুলিশের দেড়শসদস্য তাদের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,আধুনিক সব যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ করে ট্যুরিস্ট পুলিশকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। সৈকতে পুলিশের কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সর্ম্পকে তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। সৈকতে ছিনতাইকারিদের সাথে সংশ্লিষ্টার অভিযোগ পুলিশ ভালভাবে খতিয়ে দেখছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার কাজটি আগে সাধারণ পুলিশ বিভাগে ছিল। পরে অধিকতর নিরাপত্তার জন্য গঠিত হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ। তাই ট্যুরিস্ট পুলিশকে এখন পর্যটকদের কাছে নিরাপত্তার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সৈকতে একাধিক ব্যবসায়ি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছিনতাইকারিরা রাজনৈতিক আশ্রিত এবং পুলিশ তাদের অনেককে চিনেন। সদিচ্ছা থাকলে এসব ছিনতাইকারি নির্মুল করা পুলিশের পক্ষে কয়েক ঘন্টার কাজ বলে মনে করেন তারা।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেষ্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব আবুল কাশেম সিকদার জানান,পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে কতখানি ভয়াবহ হয়েছে তা ছিনতাইকারীর হাতে পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার মাধ্যমে কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছে।
তিনি বলেন এই ঘটনা বিদেশি পর্যটকদের কাছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই কেন পুলিশ ছিনতাইকারির হাতে প্রাণ দিল কেনইবা পরিস্থিতি এরকম হলো তা পর্যটন শিল্পের বিকাশের স্বার্থে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সৈকতে উদ্ধার কর্মী দল রবি লাইফ গার্ডের ইনচার্জ মোঃ ছৈয়দ নুর বলেন, সৈকতে ভ্রমন নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে হলে আগে ইয়াবাসহ সব মাদক ঠেকাতে হবে । কারণ ছিনতাইকারিরা এ সবের সাথে জড়িত।
কয়েকজন পর্যটন ব্যবসায়ি জানান, ছিনতাইকারির হাতে একজন পুলিশ সদস্য ও টমটম চালক এবং পথচারী নিহত হওয়ার এই দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না। কোন কোন গেষ্ট হাউস ও কটেজে অপকর্ম চলে এবং কারা ছিনতাইকারী সেই তথ্য পুলিশের রয়েছে বলেও তারা দাবী করেন।
এ ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশি নজরদারি বৃ্িদ্ধ করা হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর