ঢাকা ১০:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রবীন্দ্রনাথ ও টেকসই উন্নয়ন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:০১:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ মার্চ ২০১৯
  • ৪০৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বজুড়েই রবীন্দ্রনাথ পরিচিত তাঁর অনবদ্য নান্দনিক অবদানের জন্য। সবাই জানেন, তিনি ছিলেন একজন সফল কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোট গল্পকার, চারুশিল্পী ও দার্শনিক। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন সাহিত্য জগতের এক অতুলনীয় দিকপাল। এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও পশ্চিমের দুই সভ্যতা আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। একইভাবে এ কথাটিও সত্য যে, তিনি উনিশ ও কুঁড়ি- এই দুই শতাব্দীরও মানুষ। এই দুই শতাব্দীর বিরাট আশা, হতাশা, সম্ভাবনা ও বিপর্যয় তিনি তাঁর আশি বছরের এক দীর্ঘ জীবনে নিবিড়ভাবে অনুভব করেছেন ও দেখেছেন।

বিশেষ করে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা ও সমাজ অর্থনীতিতে তার পরিণতি তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। এর ফলে তিনি দারুণভাবে উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্তবোধ করতেন। সভ্যতার সংকট তাঁকে তাঁর জীবনের শেষ বেলাতেও শঙ্কিত করেছে। অবশ্য, শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস হারাননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রশ্ন করতে পারি : ওই সময় থেকে আজকের বিশ্বের এই সময়ের জন্য রবীন্দ্র-ভাবনার আলোকে আমরা কী শিখতে পারি? আজকের পৃথিবী কি রবীন্দ্রনাথের দেখা পৃথিবী থেকে খুবই আলাদা? সময় কি আসলেই বদলায়নি? বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির বিকাশ সত্ত্বেও কেন তিনি এখনও এতটা গুরুত্বপূর্ণ?

তবে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, তিনি ছিলেন মাটিঘেঁষা এক বাস্তববাদী মানুষ। শুধু জমিদার হিসেবেই নয়, একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবেও সমাজের পাটাতনে থাকা দুঃখী মানুষগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নানাধর্মী উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে যেসব বিষয় (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সংস্কৃতি), সেসব নিয়ে তাঁর ভাবনা ও কর্মোদ্যোগগুলো ছিল খুবই গভীর অন্তর্দৃষ্টিমূলক ও সুদূরপ্রসারী। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সমকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো অনেক কিছুই জানতে পারি।খুব কাছ থেকে তিনি এসব মানুষকে দেখেছেন। তাদের দুঃখ-দৈন্য তাঁর চোখে স্পষ্ট করে ধরা পড়েছে। নগরে জন্মেও তিনি পল্লীর দুঃখ-বঞ্চনা তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন। আর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের এই দুঃখ ও দৈন্য মোচন করার। আর সে কারণেই আজও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্ম এতটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর ভাবনাগুলো ছিল খুবই মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

তিনি তাঁর সময়কে অতিক্রম করে সভ্যতার সংকটকে অনুধাবন করতে পারতেন বলেই কালজয়ী সব ভাবনা রেখে গেছেন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য। বরাবরই তিনি সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকে সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর করার কথা বলতেন। শুধু কথা নয়, বিশ্বভারতীর মতো আধুনিক শিক্ষায়তন গড়ার পাশাপাশি শ্রীনিকেতনও গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর পতিসর ও শিলাইদহে সমাজ সংস্কার ও কৃষির আধুনিকায়ন সম্পর্কিত তাঁর তৃণমূলের সামাজিক উদ্যোগগুলোর কথা নাই-বা বললাম। মূলত আজীবন তিনি ভালো মানুষ, উদ্যমী মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।তিনি যেভাবে ভাবতেন, তা ছিল তাঁর সময়ের প্রায় শতবর্ষ পরের সংকট ও সম্ভাবনার মুখোমুখি হওয়ার যোগ্য। আজকের পৃথিবী নানা প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে নিমজ্জিত। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটে বিশ্ব আজ নাস্তানাবুদ হচ্ছে। শরণার্থী, জঙ্গিবাদ, বাণিজ্যযুদ্ধসহ নানা সংকটের চাপে বিশ্বের নৈতিক কাঠামো আজ নড়বড়ে।

কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তা আজকাল বোঝাই মুশকিল। কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক, সেটিও বোঝা মুশকিল। বিশ্ব যেন দিকহারা। পালহারা। একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে বিশ্বে খানিকটা মনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে আজকের প্রজন্মের অনেকেই আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করছেন। সেটিও-বা কম কী। অথচ রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই এসব সংকটের আন্দাজ করেছেন এবং এসব থেকে মুক্তির দিশা দিয়ে গেছেন। এসব কারণেই আজকের টেকসই উন্নয়নের মূল ভাবনার আলোকে তাঁকে এতটা প্রাসঙ্গিঁক মনে হয়। এসডিজির মূল স্লোগান, ‘কাউকে ফেলে রেখে এগোনো যাবে না’কে এখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘পশ্চাতে রেখেছো যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’ কথাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি- তখনই এই প্রাসঙ্গিকতার মর্ম অনুধাবন করতে পারি।

অন্ধকারে ঢাকছি যাদের, তারা যে অন্ধকারের ব্যাপ্তি আরও বাড়াবে- এ কথা রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই অনুভব করেছিলেন। আর তাই মনের কালো ঘোচানোর জন্য শিক্ষা বিস্তারে তাঁর কতই না প্রচেষ্টা চোখে পড়ে।মানবসভ্যতা নদীর মতো অনন্তকাল বয়ে যাচ্ছে, এমন কথা তিনি মানতে চাননি। বরং তিনি মনে করতেন যে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তা ওঠানামা করে। আজকের পৃথিবীও রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীর মতোই পরিবর্তনের শিকার। একইভাবে ওই পরিবর্তন ওঠানামা করছে। তাই আজকের দিনে তাঁর সৃজনশীল ভাবনা ও কর্ম আমাদের জন্য এতটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তিনি বরাবরই অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে ভেবেছেন যে, পরিবর্তনকে মোকাবেলা করতে হলে মানুষকে বাস্তববাদী হতে হবে।

সর্বদাই আদর্শের ঘোরে বন্দি না থেকে অভিজ্ঞতার জারক-রসে ভাবনাগুলোকে সমন্বিত করতে হবে। স্বদেশি ও বৈশ্বিক দুই ভাবনাই এই সমন্বয়কে জোরদার করবে। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ একাধারে বাঙালি ও বৈশ্বিক নাগরিক হতে পেরেছিলেন। আর এই কারণে তিনি আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এতটা প্রাসঙ্গিক হতে পারছেন। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনার সময় বারবার রবীন্দ্রনাথের উদ্ভাবনীমূলক ভাবনা থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সামাজিক দায়বদ্ধ উদ্যোগ নেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বিশেষ করে তাঁর গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা আমাকে দারুণ উজ্জীবিত করেছে।রবীন্দ্রনাথের সময়ের মতোই আজকের পৃথিবীও খুবই পরিবর্তনশীল। বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বৈষম্য, প্রযুক্তির প্রসারে নানা সুযোগ সৃষ্টি হলেও বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সারাবিশ্বকেই উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের পৃথিবী একশ’ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারত।

একই বিশ্বকে আজ সাতশ’ কোটি মানুষের খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। মুক্তবাজারনির্ভর পুঁজিবাদের বৈষম্য সৃজনকারী প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বায়নের সহজ-সরল ব্যাখ্যা। এর কারণে যে বৈষম্য বাড়ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, সেসব কথা মানুষ একসময় গুরুত্ব দিয়ে মনেই করত না। কিন্তু বিশ্ব আর্থিক সংকট সৃষ্টির পরে মানুষের খানিকটা বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয়। পুরো অর্থনীতি ও সমাজে যে বিভাজন বাড়ছে, সে কথাটি এখন অনেকেই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে এর ফাঁক দিয়ে ট্রাম্পের মতো অনেক জনতুষ্টিবাদীরা ঢুকে পড়েছেন রাজনীতিতে ও সমাজে। বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিকগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কট্টরপন্থি নীতিমালা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন তারা। শুরু করছেন বাণিজ্যযুদ্ধ। এর কুফল সারাবিশ্বের মানুষকেই হজম করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার।

মোবাইল ফোন, সামাজিক গণমাধ্যম, স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও র্আর্থিক ভঙ্গুরতাকে আরও জটিল করে তুলছে। প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো সত্ত্বেও সামাজিক এই ভারসাম্যহীনতা আসলেই বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এসবের কারণে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বিপন্ন হওয়ার মুখে। সনাতনী অর্থনীতির মইয়ের ধাপগুলো আজ আর সহজগম্য নয়। বৈষম্যের কারণে সমাজের বন্ধন দ্রুতই আলগা হয়ে যাচ্ছে। সমাজে তাই চাপ ও তাপ-দুই-ই বাড়ছে। আগামী দশকগুলোতে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের চেহারা প্রযুক্তির এই প্রভাবের ফলে কেমন যে হবে, তা বলা মুশকিল। তার মানে, আগামী দিনের পৃথিবী আরও চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপ্তি আরও বাড়বে।

জলবায়ু শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়বে। নগরায়ণ ও অভিবাসন আরও জটিল থেকে জটিলতর হবে বলে মনে হয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সমাধান খুঁজে পেতে আমাদের সবাই মিলে সৃজনশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের নিজেদের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিখতে হবে এবং প্রয়োজনে ভুল শুধরে নতুন করে এগোনোর মতো মানসিকতা অর্জন করতে হবে। এসব সমস্যার উৎস এক জায়গায় নেই। নানা উৎস থেকে এসব সমস্যার উৎপত্তি হয়ে থাকে। তাই সমস্যার উৎস খুঁজে সামগ্রিকভাবে সেসবের মোকাবেলা করার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ ও পৃথিবীকে ঘিরেই আমাদের টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে পেতে হবে। আর বিশ্বজনীন এই সমাধানের সূত্র আমরা রবীন্দ্রভাবনা থেকে নিশ্চয় খুঁজে নিতে পারি।

তিনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই গ্রামীণ সমাজের বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা ও কর্ম অনেক সৃজনশীল ও বহুমাত্রিক। প্রযুক্তির ভালো ও মন্দ দিক নিয়ে তিনি ভেবেছেন। তিনি বরাবরই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুফল পুরো সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এমনকি সাহিত্য ও বিজ্ঞানকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে নেওয়ার কথা তিনি বলে গেছেন। আইনস্টাইন, সত্যেন বসু ও জগদীশ বসুর মতো বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষের স্বপ্নকে তিনি উসকে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আর সেই স্বপ্নকে সর্বদাই মানবিকতার জারক-রসে সিক্ত করতেন। সামগ্রিক আন্তঃসম্পর্কীয় সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি গ্রামীণ উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।জনশ্রুতি রয়েছে যে, যতই পরিবর্তন হোক না কেন, বিষয়গুলো কিন্তু একই থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের সময়ে যেমন বিপুল পরিবর্তনের বাতাস বইতে দেখেছি, এখনও তা তেমনি বইছে।

বিশ্বের দারিদ্র্য নিরসনে বড় ধরনের সাফল্য আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। ফলে মানুষের আশা করার ক্ষেত্রও বড় হচ্ছে। বিশ্বজুড়েই মানুষের আরও সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে নানামাত্রিক উদ্যোক্তা গড়ে উঠতে দেখছি। কিন্তু এই সাফল্যের অনেক মূল্যও সমাজ ও প্রকৃতিকে দিতে হচ্ছে। আর সে কারণেই বিশ্বায়ন ও শিল্পায়নকে ঘিরে অনেক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাও নানা দেশে বাসা বাঁধছে। ভালো ও মন্দের এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের চলমান উন্নয়ন ভাবনাকেও জটিল করে ফেলছে। অনেকদিন পরে অর্থনীতির ভারকেন্দ্র পশ্চিম থেকে পূর্বের বিশ্বে সরে আসছে। আর সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলতে চাইছেন, উন্নয়ন শুধুই ভালো বা মন্দের বিষয় নয়। ভালো-মন্দ মিলেই আমাদের সামনের দিকে হাঁটতে হবে। রবীন্দ্রনাথ এই দ্বৈত বাস্তবতাকে খুব ভালো করে বুঝতেন। তাই তীব্র হতাশা সত্ত্বেও তিনি বরাবরই আশার বার্তা ছড়িয়ে গেছেন। আর বলতেন, ভরসার বিষয়টিই বড় কথা। আশার ক্ষেত্রকে বড় করাই বড় বিষয়।

চলমান বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের এই সময়ে দারিদ্র্য নিরসন, প্রকৃতির সংরক্ষণ এবং মানুষের মঙ্গল নিশ্চিত করার এই নয়া পথচলায় সম্মিলিত চিন্তা ও কর্মের কোনো বিকল্প নেই। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকভাবে এসে পড়েন। কেননা তিনি মনে করতেন, একলা মানুষ টুকরা মাত্র। আরও বলতেন, একা খেলে পেট ভরে; পাঁচজনে মিলে খেলে আত্মীয়তা বাড়ে। সারা জীবন তাই তিনি সৃজনশীল ও সম্মিলিত চিন্তা ও কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। মানবিকতাও তাঁর চলার পথে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথের চোখ, মন ও হৃদয় দিয়ে যদি ফের বিশ্বকে দেখতে পাই এবং মানুষের চিরন্তন চাওয়া-পাওয়াকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখে সমাধানের সূত্র খুঁজে পাই, তাহলেই এই পৃথিবী নিশ্চয় আরও একটু বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। আর তাহলেই রবীন্দ্রনাথ বরাবরই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

রবীন্দ্রনাথ ও টেকসই উন্নয়ন

আপডেট টাইম : ০৬:০১:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ মার্চ ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বজুড়েই রবীন্দ্রনাথ পরিচিত তাঁর অনবদ্য নান্দনিক অবদানের জন্য। সবাই জানেন, তিনি ছিলেন একজন সফল কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোট গল্পকার, চারুশিল্পী ও দার্শনিক। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন সাহিত্য জগতের এক অতুলনীয় দিকপাল। এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও পশ্চিমের দুই সভ্যতা আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। একইভাবে এ কথাটিও সত্য যে, তিনি উনিশ ও কুঁড়ি- এই দুই শতাব্দীরও মানুষ। এই দুই শতাব্দীর বিরাট আশা, হতাশা, সম্ভাবনা ও বিপর্যয় তিনি তাঁর আশি বছরের এক দীর্ঘ জীবনে নিবিড়ভাবে অনুভব করেছেন ও দেখেছেন।

বিশেষ করে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা ও সমাজ অর্থনীতিতে তার পরিণতি তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। এর ফলে তিনি দারুণভাবে উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্তবোধ করতেন। সভ্যতার সংকট তাঁকে তাঁর জীবনের শেষ বেলাতেও শঙ্কিত করেছে। অবশ্য, শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস হারাননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রশ্ন করতে পারি : ওই সময় থেকে আজকের বিশ্বের এই সময়ের জন্য রবীন্দ্র-ভাবনার আলোকে আমরা কী শিখতে পারি? আজকের পৃথিবী কি রবীন্দ্রনাথের দেখা পৃথিবী থেকে খুবই আলাদা? সময় কি আসলেই বদলায়নি? বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির বিকাশ সত্ত্বেও কেন তিনি এখনও এতটা গুরুত্বপূর্ণ?

তবে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, তিনি ছিলেন মাটিঘেঁষা এক বাস্তববাদী মানুষ। শুধু জমিদার হিসেবেই নয়, একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবেও সমাজের পাটাতনে থাকা দুঃখী মানুষগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নানাধর্মী উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে যেসব বিষয় (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সংস্কৃতি), সেসব নিয়ে তাঁর ভাবনা ও কর্মোদ্যোগগুলো ছিল খুবই গভীর অন্তর্দৃষ্টিমূলক ও সুদূরপ্রসারী। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সমকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো অনেক কিছুই জানতে পারি।খুব কাছ থেকে তিনি এসব মানুষকে দেখেছেন। তাদের দুঃখ-দৈন্য তাঁর চোখে স্পষ্ট করে ধরা পড়েছে। নগরে জন্মেও তিনি পল্লীর দুঃখ-বঞ্চনা তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন। আর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের এই দুঃখ ও দৈন্য মোচন করার। আর সে কারণেই আজও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্ম এতটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর ভাবনাগুলো ছিল খুবই মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

তিনি তাঁর সময়কে অতিক্রম করে সভ্যতার সংকটকে অনুধাবন করতে পারতেন বলেই কালজয়ী সব ভাবনা রেখে গেছেন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য। বরাবরই তিনি সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকে সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর করার কথা বলতেন। শুধু কথা নয়, বিশ্বভারতীর মতো আধুনিক শিক্ষায়তন গড়ার পাশাপাশি শ্রীনিকেতনও গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর পতিসর ও শিলাইদহে সমাজ সংস্কার ও কৃষির আধুনিকায়ন সম্পর্কিত তাঁর তৃণমূলের সামাজিক উদ্যোগগুলোর কথা নাই-বা বললাম। মূলত আজীবন তিনি ভালো মানুষ, উদ্যমী মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।তিনি যেভাবে ভাবতেন, তা ছিল তাঁর সময়ের প্রায় শতবর্ষ পরের সংকট ও সম্ভাবনার মুখোমুখি হওয়ার যোগ্য। আজকের পৃথিবী নানা প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে নিমজ্জিত। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটে বিশ্ব আজ নাস্তানাবুদ হচ্ছে। শরণার্থী, জঙ্গিবাদ, বাণিজ্যযুদ্ধসহ নানা সংকটের চাপে বিশ্বের নৈতিক কাঠামো আজ নড়বড়ে।

কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তা আজকাল বোঝাই মুশকিল। কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক, সেটিও বোঝা মুশকিল। বিশ্ব যেন দিকহারা। পালহারা। একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে বিশ্বে খানিকটা মনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে আজকের প্রজন্মের অনেকেই আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করছেন। সেটিও-বা কম কী। অথচ রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই এসব সংকটের আন্দাজ করেছেন এবং এসব থেকে মুক্তির দিশা দিয়ে গেছেন। এসব কারণেই আজকের টেকসই উন্নয়নের মূল ভাবনার আলোকে তাঁকে এতটা প্রাসঙ্গিঁক মনে হয়। এসডিজির মূল স্লোগান, ‘কাউকে ফেলে রেখে এগোনো যাবে না’কে এখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘পশ্চাতে রেখেছো যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’ কথাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি- তখনই এই প্রাসঙ্গিকতার মর্ম অনুধাবন করতে পারি।

অন্ধকারে ঢাকছি যাদের, তারা যে অন্ধকারের ব্যাপ্তি আরও বাড়াবে- এ কথা রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই অনুভব করেছিলেন। আর তাই মনের কালো ঘোচানোর জন্য শিক্ষা বিস্তারে তাঁর কতই না প্রচেষ্টা চোখে পড়ে।মানবসভ্যতা নদীর মতো অনন্তকাল বয়ে যাচ্ছে, এমন কথা তিনি মানতে চাননি। বরং তিনি মনে করতেন যে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তা ওঠানামা করে। আজকের পৃথিবীও রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীর মতোই পরিবর্তনের শিকার। একইভাবে ওই পরিবর্তন ওঠানামা করছে। তাই আজকের দিনে তাঁর সৃজনশীল ভাবনা ও কর্ম আমাদের জন্য এতটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তিনি বরাবরই অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে ভেবেছেন যে, পরিবর্তনকে মোকাবেলা করতে হলে মানুষকে বাস্তববাদী হতে হবে।

সর্বদাই আদর্শের ঘোরে বন্দি না থেকে অভিজ্ঞতার জারক-রসে ভাবনাগুলোকে সমন্বিত করতে হবে। স্বদেশি ও বৈশ্বিক দুই ভাবনাই এই সমন্বয়কে জোরদার করবে। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ একাধারে বাঙালি ও বৈশ্বিক নাগরিক হতে পেরেছিলেন। আর এই কারণে তিনি আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এতটা প্রাসঙ্গিক হতে পারছেন। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনার সময় বারবার রবীন্দ্রনাথের উদ্ভাবনীমূলক ভাবনা থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সামাজিক দায়বদ্ধ উদ্যোগ নেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বিশেষ করে তাঁর গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা আমাকে দারুণ উজ্জীবিত করেছে।রবীন্দ্রনাথের সময়ের মতোই আজকের পৃথিবীও খুবই পরিবর্তনশীল। বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বৈষম্য, প্রযুক্তির প্রসারে নানা সুযোগ সৃষ্টি হলেও বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সারাবিশ্বকেই উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের পৃথিবী একশ’ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারত।

একই বিশ্বকে আজ সাতশ’ কোটি মানুষের খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। মুক্তবাজারনির্ভর পুঁজিবাদের বৈষম্য সৃজনকারী প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বায়নের সহজ-সরল ব্যাখ্যা। এর কারণে যে বৈষম্য বাড়ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, সেসব কথা মানুষ একসময় গুরুত্ব দিয়ে মনেই করত না। কিন্তু বিশ্ব আর্থিক সংকট সৃষ্টির পরে মানুষের খানিকটা বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয়। পুরো অর্থনীতি ও সমাজে যে বিভাজন বাড়ছে, সে কথাটি এখন অনেকেই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে এর ফাঁক দিয়ে ট্রাম্পের মতো অনেক জনতুষ্টিবাদীরা ঢুকে পড়েছেন রাজনীতিতে ও সমাজে। বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিকগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কট্টরপন্থি নীতিমালা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন তারা। শুরু করছেন বাণিজ্যযুদ্ধ। এর কুফল সারাবিশ্বের মানুষকেই হজম করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার।

মোবাইল ফোন, সামাজিক গণমাধ্যম, স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও র্আর্থিক ভঙ্গুরতাকে আরও জটিল করে তুলছে। প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো সত্ত্বেও সামাজিক এই ভারসাম্যহীনতা আসলেই বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এসবের কারণে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বিপন্ন হওয়ার মুখে। সনাতনী অর্থনীতির মইয়ের ধাপগুলো আজ আর সহজগম্য নয়। বৈষম্যের কারণে সমাজের বন্ধন দ্রুতই আলগা হয়ে যাচ্ছে। সমাজে তাই চাপ ও তাপ-দুই-ই বাড়ছে। আগামী দশকগুলোতে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের চেহারা প্রযুক্তির এই প্রভাবের ফলে কেমন যে হবে, তা বলা মুশকিল। তার মানে, আগামী দিনের পৃথিবী আরও চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপ্তি আরও বাড়বে।

জলবায়ু শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়বে। নগরায়ণ ও অভিবাসন আরও জটিল থেকে জটিলতর হবে বলে মনে হয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সমাধান খুঁজে পেতে আমাদের সবাই মিলে সৃজনশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের নিজেদের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিখতে হবে এবং প্রয়োজনে ভুল শুধরে নতুন করে এগোনোর মতো মানসিকতা অর্জন করতে হবে। এসব সমস্যার উৎস এক জায়গায় নেই। নানা উৎস থেকে এসব সমস্যার উৎপত্তি হয়ে থাকে। তাই সমস্যার উৎস খুঁজে সামগ্রিকভাবে সেসবের মোকাবেলা করার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ ও পৃথিবীকে ঘিরেই আমাদের টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে পেতে হবে। আর বিশ্বজনীন এই সমাধানের সূত্র আমরা রবীন্দ্রভাবনা থেকে নিশ্চয় খুঁজে নিতে পারি।

তিনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই গ্রামীণ সমাজের বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা ও কর্ম অনেক সৃজনশীল ও বহুমাত্রিক। প্রযুক্তির ভালো ও মন্দ দিক নিয়ে তিনি ভেবেছেন। তিনি বরাবরই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুফল পুরো সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এমনকি সাহিত্য ও বিজ্ঞানকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে নেওয়ার কথা তিনি বলে গেছেন। আইনস্টাইন, সত্যেন বসু ও জগদীশ বসুর মতো বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষের স্বপ্নকে তিনি উসকে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আর সেই স্বপ্নকে সর্বদাই মানবিকতার জারক-রসে সিক্ত করতেন। সামগ্রিক আন্তঃসম্পর্কীয় সমাধান খুঁজতে গিয়ে তিনি গ্রামীণ উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।জনশ্রুতি রয়েছে যে, যতই পরিবর্তন হোক না কেন, বিষয়গুলো কিন্তু একই থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের সময়ে যেমন বিপুল পরিবর্তনের বাতাস বইতে দেখেছি, এখনও তা তেমনি বইছে।

বিশ্বের দারিদ্র্য নিরসনে বড় ধরনের সাফল্য আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। ফলে মানুষের আশা করার ক্ষেত্রও বড় হচ্ছে। বিশ্বজুড়েই মানুষের আরও সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে নানামাত্রিক উদ্যোক্তা গড়ে উঠতে দেখছি। কিন্তু এই সাফল্যের অনেক মূল্যও সমাজ ও প্রকৃতিকে দিতে হচ্ছে। আর সে কারণেই বিশ্বায়ন ও শিল্পায়নকে ঘিরে অনেক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাও নানা দেশে বাসা বাঁধছে। ভালো ও মন্দের এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের চলমান উন্নয়ন ভাবনাকেও জটিল করে ফেলছে। অনেকদিন পরে অর্থনীতির ভারকেন্দ্র পশ্চিম থেকে পূর্বের বিশ্বে সরে আসছে। আর সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলতে চাইছেন, উন্নয়ন শুধুই ভালো বা মন্দের বিষয় নয়। ভালো-মন্দ মিলেই আমাদের সামনের দিকে হাঁটতে হবে। রবীন্দ্রনাথ এই দ্বৈত বাস্তবতাকে খুব ভালো করে বুঝতেন। তাই তীব্র হতাশা সত্ত্বেও তিনি বরাবরই আশার বার্তা ছড়িয়ে গেছেন। আর বলতেন, ভরসার বিষয়টিই বড় কথা। আশার ক্ষেত্রকে বড় করাই বড় বিষয়।

চলমান বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের এই সময়ে দারিদ্র্য নিরসন, প্রকৃতির সংরক্ষণ এবং মানুষের মঙ্গল নিশ্চিত করার এই নয়া পথচলায় সম্মিলিত চিন্তা ও কর্মের কোনো বিকল্প নেই। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিকভাবে এসে পড়েন। কেননা তিনি মনে করতেন, একলা মানুষ টুকরা মাত্র। আরও বলতেন, একা খেলে পেট ভরে; পাঁচজনে মিলে খেলে আত্মীয়তা বাড়ে। সারা জীবন তাই তিনি সৃজনশীল ও সম্মিলিত চিন্তা ও কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। মানবিকতাও তাঁর চলার পথে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথের চোখ, মন ও হৃদয় দিয়ে যদি ফের বিশ্বকে দেখতে পাই এবং মানুষের চিরন্তন চাওয়া-পাওয়াকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখে সমাধানের সূত্র খুঁজে পাই, তাহলেই এই পৃথিবী নিশ্চয় আরও একটু বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। আর তাহলেই রবীন্দ্রনাথ বরাবরই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।