জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শনিবার সংঘর্ষে জড়িয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের বিবদমান দু’টি পক্ষ আবার আলোচনায় এসেছে। সংঘর্ষের একদিন পরও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে দু’টি পক্ষই নিজেদের প্রকৃত ওলামা লীগ দাবি করে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি’ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন।
জানা যায়, ১৯৬৯ সালে আওয়ামী ওলামা পার্টি নামে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সংগঠনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার তৎপরতা শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের সর্বশেষ কাউন্সিল হয়। দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সংগঠনটি ২০০১ সালে টাঙ্গাইলের আখতার হোসেন বোখারী, বরিশালের ইসমাইল হোসাইন, ডেমরার ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালীর নেতৃত্বে তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়।
এরপর ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া ওলামা লীগ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার চাঙ্গা হয়ে উঠে। তবে ওলামা লীগ নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগের অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় তারা দলের ক্রান্তিকালে দলের পাশে বেশি দাঁড়িয়েছিলেন।
গত কয়েকবছর ধরে হেলালী ও বোখারী গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। তারা প্রকাশ্যেই একে অপরকে জঙ্গি সংগঠন দাবি করলেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন তাদের ডাক পড়েছে, তেমনি তাদের অনুষ্ঠানেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
দল থেকে কোনো পক্ষকে সমর্থন দেওয়া না হলেও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া হেলালীকে ও আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ বোখারী গ্রুপকে সমর্থন করেন বলে দাবি ওলামা লীগ নেতাদের। তবে বিবদমান এ দু’টি পক্ষকে সমঝোতায় আনার কোনো তৎপরতা আওয়ামী লীগে দেখা না গেলেও কয়েকমাস আগে প্রধানমন্ত্রী ওলামা লীগকে সতর্ক করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল।
এ ছাড়া উভয় গ্রুপের বিরুদ্ধেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, হজ সুবিধা গ্রহণ, কাজী ব্যবসা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, তদবির, চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আর জঙ্গি তৎপরতা, জামায়াত সংশ্লিষ্টতা, গা-ঢাকা দেওয়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওলামা লীগের ভেতর থেকেই।
যোগাযোগ করা হলে একাংশের সভাপতি ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালী বলেন, আমি ইন্টারন্যাশনাল বক্তা, টিভি আলোচক। ওদের সমালোচনা শুনতে আর ভাল লাগে না। আমি জামায়াত-হেফাজতের কাছে বিক্রি না। তারা বাল্যবিবাহ চায়, সংবিধান মানে না। হিন্দু বিচারপতি মানে না। এ সব দাবি আওয়ামী লীগ করে না, বিএনপি করে না, জামায়াতও করে না। এই মূর্খরা করে।
তিনি বলেন, এরা হেফাজতের মতো ১৩ দফার ডাক দিয়েছে। আমার ওপর হামলা হয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে তারাই করেছে, কারণ তাদের সাথে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিদের সম্পর্ক আছে।
তিনি বলেন, তারা সংগঠনের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লা কাচপুরীর (১৯৯৮ সালে নির্বাচিত) মদদপুষ্ট, যে নেত্রীর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে ২০০১ সালে দল থেকে বহিষ্কার হয়। আর বোখারীর সাধারণ সম্পাদক হাসান তার বাড়িতে থাকে।
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন (যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ) না হয়েও এ পরিচয় ব্যবহার সম্পর্কে হেলালী বলেন, ‘জঙ্গিদের জন্য আমাদের সে অবস্থান নষ্ট হইছে। আমি কারো অর্থায়নে কাজ করি না। মায়া ভাই, নাসিম (আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) ভাই চাচ্ছে তাদের পিডা (পেটানো) দেওয়ার জন্য।’
তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, জামায়াতের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ। আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। আমি জামায়াত হলে ২১ আগস্ট আমার ওপর কেন হামলা হল?’
অন্যদিকে হেলালী গ্রুপের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে এর জন্য মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দায়ী করেছেন বোখারী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী।
তিনি বলেন, ‘জয় বাংলা বলার কারণে জঙ্গিরা পুলিশের সামনে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেছে। পুলিশ কিছু করেনি, এ পুলিশ দিয়া কি হইবে? ২০০১ সালে জেএমবি আমাদের মারতে পারেনি, এখন মারল। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অধিকার চাই। হেলালীর জঙ্গিরা কিভাবে আওয়ামী লীগ অফিসের তিনতলায় অফিস করে? হেলারীর বাবা রাজাকার, ও কোনোদিন আওয়ামী লীগ করেনি। তার সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার ট্রাক ড্রাইভার।’
“এই মায়া বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ অফিস খুলতে পারেনি, আমরা অফিস খুলেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভালবাসায়, জয় বাংলা বলায় মায়ার লোকজন তিনতলায় থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করবে এটা দুঃখজনক। দলে এমন খারাপ লোকের প্রশ্রয় হয় কিভাবে?” প্রশ্ন আবুল হাসানের।
এদিকে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমরাই একমাত্র মওদুদীর বই বাজেয়াপ্তের দাবি করেছি। ওরা চাঁদাবাজি করে মার খায়, আমরা প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত পাই।
তবে ওলামা লীগের এ অংশটির বিরুদ্ধেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ উঠেছে বার বার। বিভিন্ন সময় তারা শিক্ষানীতি বাতিল, সরকারের নাস্তিক মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া, হিন্দুদের লেখা প্রত্যাহার, ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান, ইসলামিক শিক্ষানীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোরকাবিরোধী এবং পর্দাবিরোধী মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাহার, বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্দিষ্ট না করে বাল্যবিবাহবিরোধী আইন প্রত্যাহার, ভারতে মুসলিম নির্যাতন বন্ধে সরকারকে চাপ প্রদান, চাকরিতে ৯৮ ভাগ মুসলমানদের আনুপাতিকহারে নিয়োগ, হিন্দুদের ৬০ ভাগ বা তারও বেশি নিয়োগ দিয়ে বৈষম্য না করা, প্রশাসনে হিন্দুকরণ বন্ধ, বিদেশী স্বার্থ রক্ষাকারী দেশদ্রোহী সিএইচটি কমিশনসহ বিদেশী দালালদের নিষিদ্ধ করা, ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধ করা, মুসলমানদের জন্য নববর্ষ ভাতা বাতিল, উগ্রবাদী, মৌলবাদী হিন্দুদের সরকার ও মুসলিমবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করাসহ নানা দাবি তুলেছে।
তাদের এ সব দাবির সাথে বরাবরই অংশ নিয়েছে সম্মিলিত ইসলামী গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা পরিষদ, জাতীয় কুরআন শিক্ষা মিশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ফিৎনা প্রতিরোধ কমিটি, বাংলাদেশ ওলামা মাশায়েখ ঐক্যজোট, ইমাম মোয়াজ্জিন কল্যাণ পরিষদ, কোরআন প্রচার সংস্থা, হাক্কানী ত্বরীক্বত ফেডারেশন, বাংলাদেশ এতিমখানা কল্যাণ সমিতি, বঙ্গবন্ধু ওলামা পরিষদ।
এর আগে হেফাজতে ইসলাম ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের শাস্তি, বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ, নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রীষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিল।
হেফাজতের বিভিন্ন দাবির অনুকরণ ও প্রগতিশীল লেখকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে আবুল হাসান শরীয়তপুরী বলেন, জাফর ইকবাল প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়ের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলেছে, আর শিক্ষকদের নিয়ে কি করেছে তা তো জানেন। আমরা নামাজ পড়ি- হেফাজত, জামায়াত, বিএনপিরও নামাজ পড়তে হয়। তাই বলে কি নামাজ হেফাজতের হয়ে যায়? আমরা সবাই-ই মরব।
হিন্দু হওয়ার কারণে বর্তমান বিচারপতির অপসারণের দাবি জানানোর বিষয়ে তিনি বলেন, হিন্দুদের মধ্যেও বিএনপি-জামায়াত রয়েছে। তারা বিশৃঙ্খলা করতে চায়। এ জন্য আমরা সরকারকে সতর্ক করত চেয়েছি। কারণ হিন্দুদের মধ্যে জামায়াত না থাকলে সাঈদী পাস করত কিভাবে? তবে হিন্দুরা তাদের মতো পূজা করবে এতে আমাদের আপত্তি নেই, প্রয়োজনে আমরা পাহারা দেব।
এ সব বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ওলামা লীগ আমাদের কোনো সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন না। তবে দলের বাইরে থেকেও যে কেউই আমাদের সমর্থন করতে পারে। দেখা যায়, আমরা তাদের অনুষ্ঠানে গেস্ট হয়ে যাচ্ছি। তারাও আমাদের অনুষ্ঠানে আসছে। শুধু ওলামা লীগ নয়, এমন অনেক সংগঠন রয়েছে।
‘রাজনীতি মানে সেবা করা, সচেতনতা তৈরী করা। কেউ যদি রাজনীতির নামে অপরাজনীতিকে গ্রহণ করে, অরাজনীতি করে তাহলে তাদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা বিষয়গুলো পযবেক্ষণ করছি’ বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগে নেতা খালিদ মাহমুদ আরও বলেন, ‘আমরা যেহেতু সরকারি দল, তাই অনেকেই অনেক সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, যাতে কেউ সে সুযোগটা নিতে না পারে। আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে না পারে।’
‘ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের আদর্শে সমর্থন করে, কিন্তু তাদের বিবাদ ও প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান কি’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দায়িত্ব না। কারণ তারা আমাদের স্বীকৃত কোনো সংগঠন না। আর কেউ যদি রাজনীতির নামে দেশের স্বার্থবিঘ্ন করে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে।’