যবান যেন যিকিরের মাধ্যমে সিক্ত-সতেজ থাকে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সারাদিন আমরা যত কথা বলি, তার সিকিভাগও কি যিকির করি! প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, জায়েয-নাজায়েয কত রকম কথাবার্তায় আমাদের দিনরাত কেটে যায়, কিন্তু যিকিরের জন্য সারাদিনের অল্প কিছু সময়ও কি ব্যয় হয়?

দুনিয়াবী ব্যস্ততা জীবন জুড়েই আছে। জীবন পার করার জন্য টেনেটুনে হলেও সেসব কাজ আমরা করি। কিন্তু সবসময় কি দুনিয়াবী কাজকেই প্রাধান্য দিব? তাহলে আমাদের আখেরাতের যিম্মাদারি কে নেবে?

যত দীর্ঘ আয়ুই পাই না কেন, দুনিয়ার জীবন তো অতি অল্প। আখেরাতের জীবনের সামনে দুনিয়ার জীবন তো কোনো হিসাবেই আসে না। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্যই যদি পুরোটা যিন্দেগী এভাবে ক্ষয় করে ফেলি, বিশাল আখেরাতের জন্য তাহলে কী রইল? আমাদেরকে যে করেই হোক আখেরাতের পুঁজি সঞ্চয় করতে হবে, দুনিয়াবী সব কাজের উপর আখেরাতকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

কুরআনে কারীম এবং হাদীস শরীফে যিকির ও যিকিরকারীদের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেছেন-

وَ لَذِكْرُ اللّٰهِ اَكْبَرُ.

অর্থাৎ, “আল্লাহর যিকিরই সবচেয়ে বড়।” -সূরা আনকাবুত: ৪৫

আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-

اِنَّ الْمُسْلِمِیْنَ وَ الْمُسْلِمٰتِ … وَ الذّٰكِرِیْنَ اللهَ كَثِیْرًا وَّ الذّٰكِرٰتِ   اَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَّ اَجْرًا عَظِیْمًا.

“নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ এবং নারী বেশি বেশি আল্লাহর যিকিরকারী পুরুষ এবং নারী এদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত এবং বিরাট প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।”-সূরা আহযাব: ৩৫

হযরত আবুদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে উত্তম, তোমাদের রবের নিকট সবচেয়ে প্রিয়, তোমাদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি উন্নতকারী, স্বর্ণ রৌপ্য আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার চেয়েও বেশি উত্তম এবং শত্রুর মুখোমুখি হয়ে শত্রুকে হত্যা করা এবং শত্রুর হাতে তোমাদের শহীদ হওয়ার চেয়েও বেশি উত্তম আমলের কথা বলব?” সাহাবীগণ বললেন, “অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ!” তখন তিনি বললেন, “তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার যিকির।”-জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৭

হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) বললেন, মুফাররিদরা অগ্রগামী হয়ে যাচ্ছে। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, মুফাররিদ কারা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন তিনি বললেন, বেশি বেশি আল্লাহর যিকিরকারী পুরুষ এবং নারী।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৯১

এমন আরো অনেক ফযীলতপূর্ণ হাদীস বর্ণিত আছে। অনেক যিকির আছে, যেগুলো আদায় করতে খুব কম সময় লাগে, কিন্তু আজরের দিকে থেকে অনেক বড়। যেমন, “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম”। পড়তে কতক্ষণ লাগে? কিন্তু তার প্রতিদান! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এই দুটি বাক্য পড়তে খুবই সহজ, অথচ সেগুলো রহমানের নিকট প্রিয় এবং মীযানের পাল্লায় হবে ভারী। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৪

এই তাসবীহের আরো একটি ফযিলত বর্ণিত আছে। তা হল, যে দিনে একশ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পড়বে তার সকল সগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৬৬

সারাদিন কতভাবেই তো সময় নষ্ট করি। কত ধরনের কথাবার্তায় সময় পার করি। অথচ এসব সময়ে যিকির-তিলাওয়াত, অযীফায় মশগুল থাকলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় দিক থেকে কত লাভবান হতাম! যবানের গুনাহে আমলনামা ভরে উঠত না।

যিকিরের সাথে ইস্তিগফারের আমল করা খুবই জরুরি। কারণ, নাজায়েয কোনো কথা বলে ফেললে তারপরে যদি বেশি বেশি ইস্তিগফার বা যিকির করি তাহলে তা সেই গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়! আমাদের প্রিয় নবীজী (সা.) নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও  দিনে সত্তর বারের বেশি ইস্তিগফার করতেন। তাহলে গুনাহগার উম্মতের জন্য কী পরিমাণ ইস্তিগফার প্রয়োজন? আমাদের বেশিরভাগ গুনাহই যবানের দ্বারা হয়। তাই সারাদিন বেশি বেশি ইস্তিগফার পড়া উচিত।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) তাঁর কাছে একজন খাদেমা চাইলে তিনি ফাতিমা (রা.) কে খাদেমা দেওয়ার পরিবর্তে তাসবীহ শিখিয়েছেন এবং বলেছেন, এই তাসবীহ গোলাম-বাদী থেকেও উত্তম। তা হল রাতে ঘুমানোর সময় তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ, চৌত্রিশবার আল্লাহু আকবার পড়া।

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আমাদেরকে বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন দুআ শিখিয়েছেন। ঘুমানোর দুআ, ঘুম থেকে ওঠার পরের দুআ, খাওয়ার আগে-পরের দুআ, ইস্তিঞ্জার আগে-পরের দুআ, সকাল-সন্ধ্যার দুআ। যাতে এসকল দুআর মাধ্যমে সবসময়ই আল্লাহকে স্মরণ করতে পারি; কোনো অবস্থায়ই যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না থাকি।

দৈনন্দিন দুআ-যিকিরের সাথে সাথে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াত, মুনাজাতে মাকবূল এবং অন্যান্য ওযীফাও আদায় করা উচিত।

হয়ত মনে হতে পারে, সারাদিন আমার কত কাজ! এত কাজকর্ম আর সংসার সামলে এত আমল করার সুযোগ কোথায়! কিন্তু পূর্ববর্তী মহীয়সী নারীদের জীবনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, তাঁদেরও কাজকর্ম ছিল, সংসার ছিল, আমার চেয়েও তাঁদের ব্যস্ততা, সাংসারিক ঝামেলা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এত কষ্ট, এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তাঁদের জীবন ছিল আমলে-যিকিরে ভরপুর। এসব ছিল তাদের মূল কাজ। বাকিগুলো করতেন প্রয়োজনের তাকিদে। আমিও তাঁদের মতো হিম্মত করলে, দুনিয়া এবং আখেরাতকে তাঁদের মতো করে ভাবলে আমার জন্যও যিকির-আমল সহজ হয়ে যাবে।

তাছাড়া কাজ তো  করি হাত-পা দিয়ে। মুখ তো অবসরই থাকে। তাই অবসর সময়ে তো বটেই, ব্যস্ত সময়েও যিকির, ইস্তিগফারে লেগে থাকতে পারি।

রাসূল (সা.)কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইসলামে তো অনেক বিষয় আছে (সবগুলোর উপর আমল করা হয়ত আমার পক্ষে সম্ভব হবে না) সুতরাং আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যাতে আমি সবসময় লেগে থাকতে পারি। তখন রাসূল (সা.) বললেন-

لَا يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللهِ.

“তোমার যবান যেন সর্বদা আল্লাহর যিকিরে সিক্ত-সতেজ থাকে।” -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৫

আমাদের অবস্থাও যেন হয় এমন। আল্লাহ আমাদের সকলকে বেশি বেশি জিকিরের মাধ্যমে যবানকে সতেজ রাখার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর