অপরূপ সৌন্দর্য ঘেরা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনেও। এরশাদ হয়েছে ‘তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করে না। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? উভয় সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় মণিমুক্তা ও প্রবাল। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে?’
(সূরা আর-রাহমান : ১৯-২৫)

সবুজাভ বাংলাদেশের রূপের যেন শেষ নেই। অপূর্ব কান্তরূপ ছড়িয়ে আছে সুনিবিড় ছায়াঘেরা প্রতিটি জনপদে। পাহাড়, নদী, সাগর, সবুজ প্রান্তর কী নেই ছোট্ট এ দেশটিতে! সুন্দরের প্রত্যেকটি উপাদান দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিন ঢেলে সাজিয়েছেন আমাদের এ মাতৃভূমি। এ যেন স্বপ্নে দর্শানো স্বর্গের কোনো নিকুঞ্জ।

বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবার আগে যে নামটি আসে, তা হলো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত বলে দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক ভিড় করেন প্রতিনিয়ত। বালুকাময় বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। দূরে উচ্ছল তরঙ্গমালায় হেলেদুলে ভাসে জেলেদের নৌকা। মহান আল্লাহ যেন বাংলার সব রূপ ঢেলে দিয়েছেন বালুর এই আঁচলে। সাগরের গর্জন আর বাতাসের কলতান কানে রিনিঝিনি ঢেউ তোলে। দূরের সবুজ পাহাড় যেন মিশেছে নীলাভ আকাশের কোলে। জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যও বেশ চমৎকার। শিশুরা খেলার ছলে হারিয়ে যায় ঝাউবীথির আড়ালে।

নানা রং আর ডিজাইনের ঝিনুক, শামুক ও কাঁকড়ায় অনিন্দ্য রূপ ধারণ করে সমুদ্রতট। বিকালে রক্তিম সূর্যটা হারিয়ে যায় অথৈ জলের বুকে। হাজার হাজার পর্যটক উপভোগ করেন অপরূপ সে দৃশ্য। সৈকত সংলগ্ন শামুক, ঝিনুক ও নানা প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ বিপণিবিতান, অত্যাধুনিক হোটেল, মোটেল, কটেজ, নিত্যসাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেটগুলোয় পর্যটকদের বিচরণে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত প্রাণচঞ্চল থাকে প্রতিনিয়ত। সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনেও। এরশাদ হয়েছে ‘তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করে না। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? উভয় সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় মণিমুক্তা ও প্রবাল। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নিয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে?’ (সূরা আর-রাহমান : ১৯-২৫)।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত কক্সবাজার জেলা। এখানেই পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যা একটানা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আধুনিক কক্সবাজারের নাম রাখা হয়েছে হিরাম কক্সের নামানুসারে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলে ভারতের সামরিক কর্মকর্তা। তিনি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে একটি বাজার স্থাপন করেন। কক্স সাহেবের বাজার থেকে কক্সবাজার নামের উৎপত্তি। একসময় কক্সবাজার পানোয়া নামেও পরিচিত ছিল। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘হলুদ ফুল’। কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এ হলুদ ফুলে ঝকমক করত তখন।

আরব ব্যবসায়ী ও ধর্ম প্রচারকরা সর্বপ্রথম অষ্টম শতকে চট্টগ্রাম ও আকিব বন্দরে আগমন করেন। এ দুই বন্দরের মধ্যবর্তী হওয়ায় কক্সবাজার এলাকা আরবদের অধীনে চলে আসে। নবম শতাব্দীতে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম হরিকেলার রাজা কান্তিদেব দ্বারা শাসিত হতো। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজা সুলাত ইঙ্গ চন্দ্র চট্টগ্রাম দখল করে নেন।

নবম শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে ১৬১৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিগ্রহণের আগে পর্যন্ত কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ি রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। তার যাত্রাবহরের প্রায় একহাজার পালকি কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ডুলাহাজারা অর্থ হাজার পালকি। মুঘলদের পর ত্রিপুরা, আরকন, পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশরা এ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
সমুদ্রসৈকত ছাড়াও কক্সবাজারে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। যেমন:

লাবণী পয়েন্ট
কক্সবাজার শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবণী পয়েন্ট কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্রসৈকত বলে বিবেচনা করা হয়। নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অনেক দোকান, যা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ।

হিমছড়ি
হিমছড়ি কক্সবাজারের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ভঙ্গুর পাহাড় আর ঝরনা এখানকার প্রধান আকর্ষণ। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পথে বাম দিকে সবুজঘেরা পাহাড় আর ডানদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশি মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। বর্ষার সময় হিমছড়ির ঝরনাকে অনেক বেশি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত মনে হয়। হিমছড়িতে পাহাড়ের চূড়ায় একটি রিসোর্ট আছে, যেখান থেকে সাগরের দৃশ্য অপার্থিব দেখায়। সম্প্রতি হিমছড়িতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র ও পিকনিক স্পট।

ইনানী বিচ
হিমছড়ি থেকে আরও ৫ কিলোমিটার গেলেই ইনানী বিচ বা ইনানী সমুদ্রসৈকত। ইনানী বিচে প্রবাল পাথরের ছড়াছড়ি। অনেকটা সেন্টমার্টিনের মতোই। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের মতো এ সৈকতের বেলাভূমিতে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে না। অনেকটাই শান্ত প্রকৃতির সৈকত এ ইনানী। জোয়ারের সময় এলে প্রবাল পাথরের দেখা পাওয়া যাবে না। ভাটার সময়ই বিশাল এলাকাজুড়ে ভেসে ওঠে এ পাথর। প্রবাল পাথরে লেগে থাকে ধারালো শামুক-ঝিনুক। তাই এখানে বেশি লাফালাফি করা বিপজ্জনক। একদিকে পাহাড় আর অপরদিকে সমুদ্রের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করেন দর্শকরা।

শাহপরীর দ্বীপ
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ। টেকনাফ উপজেলা শহর থেকে শাহপরীর দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। জনশ্রুতি আছে, শাহ সুজার স্ত্রী পরীবানুর ‘পরী’ ও শাহ সুজার ‘শাহ’ মিলে এ দ্বীপের নামকরণ শাহপরীর দ্বীপ করা হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের নামকরণের এরকম আরও অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে স্থানীয়দের কাছে। দ্বীপের মনকাড়া সৌন্দর্য সহজেই আকৃষ্ট করে দর্শক হৃদয়কে।

ছেঁড়া দ্বীপ
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের স্থান ও দ্বীপের নাম হলো ছেঁড়া দ্বীপ। ২০০০ সালের শেষ দিকে দ্বীপটির সন্ধান পাওয়া যায়। ছেঁড়া দ্বীপে দেখা যাবে অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য। সামুদ্রিক ঢেউ আর সারি সারি নারকেল গাছ। প্রবাল পাথর ও পাথরের তৈরি বিভিন্ন কারুকার্য চোখে পড়বে ছেঁড়া দ্বীপে গেলে। চাঁদনি রাতে ছেঁড়া দ্বীপ সাজে তার অপরূপ সাজে। এ সময় যে কোনো ভ্রমণকারীর মন ভরে যাবে ছেঁড়া দ্বীপের অপরূপ শোভা অবলোকন করে।

কুতুবদিয়া দ্বীপ
প্রায় ২১৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুতুবদিয়া দ্বীপ কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত। এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। জেনারেটর ও সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে এখানকার বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটানো হয়। এখানে আছে  বৈচিত্র্যময় নানা সৌন্দর্য। নির্জন সমুদ্রসৈকত, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, লবণ চাষ, বাতিঘর, কুতুব আউলিয়ার মাজারসহ আছে দেখার মতো অনেক কিছু। নান্দনিক এ স্পটগুলো ছাড়াও রয়েছে শামলাপুর সমুদ্রসৈকত, মারমেইড ইকো রিসোর্ট, সোনাদিয়া দ্বীপ, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কসহ অনেক কিছুই। মহান আল্লাহর অনন্য এ সৌন্দর্যগুলো অবলোকন করে বিমুগ্ধ হয় প্রতিটি দর্শকহৃদয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর