ঢাকা ১০:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জল-মাটি-পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার কানিবক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩৬:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
  • ২৯৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নিরীহ পাখি কানিবক মূলত জলের পাখি। জলের কিনারা ধরে পিলপিল পায়ে অসম্ভব দ্রুতবেগে হাঁটতে পারে হলুদ চোখের এই কানিবক। আবার নিজ প্রয়োজনেই হঠাৎ করে থামতেও পারে। এ ছাড়া মুহূর্তেই স্ট্যাচু হতে এদের জুড়ি মেলা ভার। জল-মাটি-পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার কানিবক। সাধারণত পুকুর, খাল-বিল, ঝিল ও নদীসহ সব ধরনের জলাভূমিতে কানিবক দেখা যায়। কানিবকের ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান পন্ড হেরন’ এবং বৈজ্ঞানিক নাম ‘আরডিওলা গ্রায়ি’। এরা কানাবক, কোঁচবক, কানাবগি, দেশি কানিবক বা কানিবক নামেও পরিচিত।

বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কানিবকের প্রধান বসতি। এর আকার সাধারণত প্রায় ৪৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। হলুদ চোখের লাজুক চেহারা আর লম্বা তীক্ষ ঠোঁট এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া ধূসর বাদামি পিঠ, মাথা, গলা এবং বুকে বাদামি আর সাদা ডোরাও অন্যান্য বক থেকে এদের আলাদা পরিচয় বহন করে। কানিবকের বুকের নিচে পেট থেকে লেজ বরাবর অংশটি সাদা। আর দ্রুতবেগে হাঁটার জন্য রয়েছে লম্বা হলুদ পা। পুকুর, বিল-ঝিল, ডোবায় বা যে কোনো জলাশয়ের ধারে বসে এই বককে প্রায়ই হঠাত্ করে ছোঁ মেরে ছোট মাছ ও ব্যাঙ খেতে দেখা যায়। বর্শার মতো তীক্ষ ঠোঁট তাদের এই হঠাৎ শিকার পদ্ধতিতে খুব কাজে লাগে।

ছোট ব্যাঙ, মাছ আর জলজ পোকা এদের প্রিয় খাবার। তবে খাদ্য তালিকায় আরো রয়েছে ব্যাঙাচি, জল মাকড়সা, কাঁকড়া ও কেঁচো ইত্যাদি। তবে ছোট সাপ ও কাঁকড়া ধরার সময় এরা যথেষ্ট সতর্ক থাকে। কারণ, সাপ ঠোঁটে প্যাঁচ দিতে পারে, আর কাঁকড়া তার সাঁড়াশিতে চেপে ধরতে পারে! এ রকম শিকারের ক্ষেত্রে এরা উত্তেজিত হয়ে পুচ্ছ দোলায়। সাধারণত বর্ষাকাল এদের প্রজনন ঋতু। তবে শীতের শেষ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাস থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত ডিম দেয় এরা। এ সময় ৩ থেকে ৫টি ডিম দেয় কানিবক। এরপর অপেক্ষা, কবে পৃথিবীর আলোয় বাচ্চা ফুটে বেরিয়ে আসবে। একটানা ১৮ থেকে ২৪ দিন তা দেয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে।

প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতির অন্তরঙ্গ বন্ধু পাখি। মানুষের জীবনযাত্রায় পাখির সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী আবহাওয়া, কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, পাখিদের আবাসস্থল ও খাদ্য সঙ্কট এবং পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় নানা প্রজাতির পাখি। এসব পাখির মধ্যে কানিবক ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোকিল, বউ কথা কও, টিয়া, ময়না, ঘুঘু, শালিক, চড়ুই, বাবুই, টুনটুনি, মাছরাঙা, বক, কোয়েল, পাতিকাক, দাঁড়কাক, কবুতর ইত্যাদি।

এসব পাখি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ধান, পাট ও গমসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজি খেতে পোকা নিধনের জন্য এক ধরনের বিষ এবং কীটনাশক ব্যবহার করায় ওইসব ক্ষেতে পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে গিয়ে মারা পড়ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে ঝড়-বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, অতি খরা এবং অতি শীতে এই বৈরী আবহাওয়ার কারণে এসব দেশীয় পাখি বর্তমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায়ও এরা বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ ছাড়া পাখিবান্ধব বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা কেটে ভিনদেশীয় পরিবেশবান্ধব নয় এমন গাছের বনায়ন বা বৃক্ষরোপণ করায় দেশীয় পাখিরা তাদের পুরনো চিরচেনা আবাস্থল পাচ্ছে না বিধায়ও তারা হারিয়ে যেতে বসেছে। বসন্তকালে শহর-গ্রাম সর্বত্রই কোকিল এবং বউ কথা কওসহ বিভিন্ন পাখির ডাকাডাকি, কলরব আর কিচিরমিচিরে মন ভরে উঠত। বর্তমানে ওইসব পাখির কলরব খুব একটা শোনা যায় না।

এসব কারণে অন্যান্য পাখির সঙ্গে কানিবকও হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই তো আগের মতো আর খুব একটা চোখে পড়ে না এই ছোট্ট বকটি। আমাদের দেশে সাধারণত বাগেরহাট, সুন্দরবন ও সাতক্ষীরাসহ নির্জন চরদ্বীপ হাওরে বেশি দেখা মেলে কানিবকের। তবে ঢাকা শহরেও কদাচিৎ দেখা যায় এটি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জল-মাটি-পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার কানিবক

আপডেট টাইম : ১২:৩৬:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নিরীহ পাখি কানিবক মূলত জলের পাখি। জলের কিনারা ধরে পিলপিল পায়ে অসম্ভব দ্রুতবেগে হাঁটতে পারে হলুদ চোখের এই কানিবক। আবার নিজ প্রয়োজনেই হঠাৎ করে থামতেও পারে। এ ছাড়া মুহূর্তেই স্ট্যাচু হতে এদের জুড়ি মেলা ভার। জল-মাটি-পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার কানিবক। সাধারণত পুকুর, খাল-বিল, ঝিল ও নদীসহ সব ধরনের জলাভূমিতে কানিবক দেখা যায়। কানিবকের ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান পন্ড হেরন’ এবং বৈজ্ঞানিক নাম ‘আরডিওলা গ্রায়ি’। এরা কানাবক, কোঁচবক, কানাবগি, দেশি কানিবক বা কানিবক নামেও পরিচিত।

বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কানিবকের প্রধান বসতি। এর আকার সাধারণত প্রায় ৪৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। হলুদ চোখের লাজুক চেহারা আর লম্বা তীক্ষ ঠোঁট এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া ধূসর বাদামি পিঠ, মাথা, গলা এবং বুকে বাদামি আর সাদা ডোরাও অন্যান্য বক থেকে এদের আলাদা পরিচয় বহন করে। কানিবকের বুকের নিচে পেট থেকে লেজ বরাবর অংশটি সাদা। আর দ্রুতবেগে হাঁটার জন্য রয়েছে লম্বা হলুদ পা। পুকুর, বিল-ঝিল, ডোবায় বা যে কোনো জলাশয়ের ধারে বসে এই বককে প্রায়ই হঠাত্ করে ছোঁ মেরে ছোট মাছ ও ব্যাঙ খেতে দেখা যায়। বর্শার মতো তীক্ষ ঠোঁট তাদের এই হঠাৎ শিকার পদ্ধতিতে খুব কাজে লাগে।

ছোট ব্যাঙ, মাছ আর জলজ পোকা এদের প্রিয় খাবার। তবে খাদ্য তালিকায় আরো রয়েছে ব্যাঙাচি, জল মাকড়সা, কাঁকড়া ও কেঁচো ইত্যাদি। তবে ছোট সাপ ও কাঁকড়া ধরার সময় এরা যথেষ্ট সতর্ক থাকে। কারণ, সাপ ঠোঁটে প্যাঁচ দিতে পারে, আর কাঁকড়া তার সাঁড়াশিতে চেপে ধরতে পারে! এ রকম শিকারের ক্ষেত্রে এরা উত্তেজিত হয়ে পুচ্ছ দোলায়। সাধারণত বর্ষাকাল এদের প্রজনন ঋতু। তবে শীতের শেষ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাস থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত ডিম দেয় এরা। এ সময় ৩ থেকে ৫টি ডিম দেয় কানিবক। এরপর অপেক্ষা, কবে পৃথিবীর আলোয় বাচ্চা ফুটে বেরিয়ে আসবে। একটানা ১৮ থেকে ২৪ দিন তা দেয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে।

প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতির অন্তরঙ্গ বন্ধু পাখি। মানুষের জীবনযাত্রায় পাখির সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী আবহাওয়া, কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, পাখিদের আবাসস্থল ও খাদ্য সঙ্কট এবং পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় নানা প্রজাতির পাখি। এসব পাখির মধ্যে কানিবক ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোকিল, বউ কথা কও, টিয়া, ময়না, ঘুঘু, শালিক, চড়ুই, বাবুই, টুনটুনি, মাছরাঙা, বক, কোয়েল, পাতিকাক, দাঁড়কাক, কবুতর ইত্যাদি।

এসব পাখি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ধান, পাট ও গমসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজি খেতে পোকা নিধনের জন্য এক ধরনের বিষ এবং কীটনাশক ব্যবহার করায় ওইসব ক্ষেতে পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে গিয়ে মারা পড়ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে ঝড়-বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, অতি খরা এবং অতি শীতে এই বৈরী আবহাওয়ার কারণে এসব দেশীয় পাখি বর্তমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায়ও এরা বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ ছাড়া পাখিবান্ধব বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা কেটে ভিনদেশীয় পরিবেশবান্ধব নয় এমন গাছের বনায়ন বা বৃক্ষরোপণ করায় দেশীয় পাখিরা তাদের পুরনো চিরচেনা আবাস্থল পাচ্ছে না বিধায়ও তারা হারিয়ে যেতে বসেছে। বসন্তকালে শহর-গ্রাম সর্বত্রই কোকিল এবং বউ কথা কওসহ বিভিন্ন পাখির ডাকাডাকি, কলরব আর কিচিরমিচিরে মন ভরে উঠত। বর্তমানে ওইসব পাখির কলরব খুব একটা শোনা যায় না।

এসব কারণে অন্যান্য পাখির সঙ্গে কানিবকও হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই তো আগের মতো আর খুব একটা চোখে পড়ে না এই ছোট্ট বকটি। আমাদের দেশে সাধারণত বাগেরহাট, সুন্দরবন ও সাতক্ষীরাসহ নির্জন চরদ্বীপ হাওরে বেশি দেখা মেলে কানিবকের। তবে ঢাকা শহরেও কদাচিৎ দেখা যায় এটি।