হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষ অধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্য মজুত বা স্টক করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং মানবতার প্রতি চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শনের শামিল। কিছু মানুষ খাদ্যাভাবে কষ্টে দিনাতিপাত করবে, আর কিছু মানুষ নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করবে এটা ইসলাম সমর্থন করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি মজুতদারী করে, সে পাপাচারী।’ (শুয়াবুল ঈমান)।
ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যাপকতার ফলে নতুন করে তার পরিচিতি পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। মূলত বিনিময় প্রথাকে ব্যবসাবাণিজ্য বলা হয়। প্রাচীনকালে পণ্যের বিনিময়ে পণ্যের আদান-প্রদানের প্রথা চালু ছিল। যাকে ফিকহের পরিভাষায় ‘বাইউল মুকায়াজা’ বলা হয়। কিন্তু এ প্রথায় কিছুটা সমস্যা দেখা দেওয়ায় তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য আদান-প্রদানের প্রথা চালু হয়। সাধারণ অর্থে এটাকেই আমরা এখন ব্যবসাবাণিজ্য বলি। আদান-প্রদানের এ প্রথা মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। মানব অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকে এ প্রথা চালু হয়েছে, মানব অস্তিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
ব্যবসাবাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে ইসলাম। হাদিসে আছে ‘সৎ আমানতদার ব্যবসায়ীর নবীদের সঙ্গে হাশর হবে।’ যেহেতু ব্যবসাবাণিজ্য মানব প্রয়োজনের দিক বিবেচনায় সূচিত হয়েছে, তাই ইসলাম মানব প্রয়োজনের এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি কলুষতামুক্ত রাখার জন্য বেশকিছু বিধিবিধান দিয়েছে। একজন সৎ ব্যবসায়ীর নৈতিক দায়িত্ব হলো সেসব বিধান মেনে চলা। নিম্নে বিধানগুলো আলোচনা করা হলো।
প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া
ব্যবসাবাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ও হারাম। ক্রেতাকে ঠকানোর জন্য পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা জায়েজ নয়। হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ অপর একটি হাদিসে আছে ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতারণামূলক বেচাকেনাকে নিষিদ্ধ করেছেন।’ (মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা)। এ বিষয়ে তিরমিজি শরিফে একটি হাদিসে আছে ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার খাদ্যপণ্যের একটি স্তূপের মধ্যে হাত প্রবেশ করালে কিছুটা আর্দ্রতা অনুভব করেন, তিনি খাদ্যশস্যের মালিককে বলেন, কী ব্যাপার এ খাদ্যশস্য ভেজা কেন? তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল! এ খাদ্যশস্যের ওপর বৃষ্টির পানি পড়েছিল। রাসুল (সা.) বলেন তবে ভিজে যাওয়া পণ্য ওপরে রাখলে না কেন? যাতে মানুষ তা দেখতে পেত। অতঃপর তিনি এরশাদ করেন শোন, যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (মুসলিম, মেশকাত : ২৪৮)। আরবের লোকরা দুধের পশু বিক্রি করার সময় প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করত। তারা কয়েক দিন পর্যন্ত পশুটির দুধ দোহন না করে রেখে দিত, এতে স্তনে দুধ জমা হয়ে স্তন ফুলে যেত আর গ্রাহক দেখে মনে করত পশুটি প্রচুর দুধ দেয়, এ ভেবে তারা চড়া মূল্যে তা খরিদ করে প্রতারিত হতো। রাসুলুল্লাহ (সা.) এভাবে পশু বিক্রি করতে নিষেধ করেন। (বোখারি ও মুসলিম)।
ওজনে কম দেওয়া
ওজনে কম দেওয়া অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। ইসলামি শরিয়ত কখনও তা সমর্থন করে না। যারা ওজনে কম দেয় তাদের এ ঘৃণ্য কাজের বর্ণনা দিয়ে কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা স্বতন্ত্র একটি সূরা অবতীর্ণ করেন। সেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে কেয়ামতের দিবসে, যে দিন সব মানুষ দাঁড়াবে মহান প্রতিপালকের সামনে?।’ (সূরা তাতফিফ : ১-৬)। এ আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়, মাপে কম দেওয়া হারাম ও নিষিদ্ধ। তবে মনে রাখতে হবে, ‘তাতফিফ’ শব্দের অর্থ শুধু মাপে কম দেওয়া নয়; বরং যে-কোনো প্রাপককে যথাযথ প্রাপ্য না দেওয়া। সেটা গণনার মাধ্যমে হতে পারে অথবা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। প্রাপককে আপন হক থেকে বঞ্চিত করাই মূল উদ্দেশ্য।
মজুতদারী
আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষ অধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্য মজুত বা স্টক করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং মানবতার প্রতি চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শনের শামিল। কিছু মানুষ খাদ্যাভাবে কষ্টে দিনাতিপাত করবে, আর কিছু মানুষ নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করবে এটা ইসলাম সমর্থন করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি মজুতদারী করে, সে পাপাচারী।’ (শুয়াবুল ঈমান)। তবে মনে রাখতে হবে, মজুতদারী সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ নয়। যদি মজুতদারীর কারণে বাজারে পণ্য-সংকট সৃষ্টি না হয়, অথবা সে উদ্দেশ্যে মজুতদরী করা না হয়; তবে তা জায়েজ। সুতরাং মৌসুমের বিপুল আমদানিকালে কম মূল্যে পণ্য খরিদ করে স্টক করে রেখে পরে তা অধিক মূল্যে বিক্রি করা বৈধ। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য বাজারে ছেড়ে দেওয়া সর্বাবস্থায়ই উত্তম।
মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া
আজকাল মিথ্যা কথা বলা ব্যবসায়ীদের একটি চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তারা অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা শপথ করতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। এরশাদ হয়েছে ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেও না। তবে পরস্পর সম্মতিক্রমে বেচাকেনার মাধ্যমে।’ (সূরা নিসা : ২৯)। রাসুল (সা.) ব্যবসাবাণিজ্যকে মিথ্যার কলুষতা থেকে মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন। তিনি এরশাদ করেন ‘বেচাকেনার সময় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত লেনদেন গ্রহণ ও বর্জন করার অধিকার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সংরক্ষণ করে। তারা যদি পণ্য ও বিনিময় দ্রব্যের গুণাগুণ যথাযথ বর্ণনা করেন এবং সত্য কথা বলেন, তবে তাদের বেচাকেনার মধ্যে বরকত দেওয়া হয়। আর যদি মিথ্যা বলেন, কিংবা গুণাগুণ গোপন করেন; তবে বেচাকেনার বরকত নষ্ট করে দেওয়া হয়।’
মিথ্যা শপথ করা
এমনিতেই মিথ্যা শপথ করা মারাত্মক গোনাহের কাজ। তার ওপর ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর নিষেধাজ্ঞা আরও বেশি। কারণ ব্যবসাবাণিজ্যে অন্যের হক সংশ্লিষ্ট থাকে। অথচ আমাদের সমাজের ব্যবসায়ীদের প্রায়ই দেখা যায়, তারা পণ্যকে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য মিথ্যা শপথ করেন। যেমন একটি পণ্য বিক্রেতার ১০ টাকা কেনা পড়েছে, সে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে আল্লাহর কসম আমি এ পণ্যটি ১৫ টাকায় কিনেছি। ক্রেতা তার কথার ওপর ভিত্তি করে চড়া মূল্যে তা খরিদ করে নিয়ে যান এবং প্রতারণার শিকার হন। মিথ্যা শপথের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন ‘যারা আল্লাহর পথে কৃত অঙ্গীকার সামান্য মূল্যে বিক্রি করে তাদের আখেরাতে কোনো অংশ নেই। আর তাদের সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামেতের দিবসে কথা বলবেন না। তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দেবেন না। তাদের পরিশুদ্ধ করবেন না। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৭)। ওই আয়াত সম্পর্কে আবু জর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদের মার্জনা করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল তারা কারা? তারা তো বড় বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন তারা হলো অনুগ্রহ করার পর তা প্রকাশকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। অতঃপর রাসুল (সা.) এ আয়াত পড়েন।’ (মুসলিম, মেশকাত : ২৪৩)। অপর এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা দ্বারা কারও হক নষ্ট করে, সে নিজের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত করে নেয়। তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। বর্ণনাকারী আরজ করলেন, যদি বিষয়টি সামান্য পরিমাণে হয় তবুও? উত্তরে তিনি এরশাদ করেন, তা গাছের একটি তাজা গাছের ডালই হোক না কেন।’
সত্য শপথ থেকে বিরত থাকা
ব্যবসার ক্ষেত্রে সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা উচিত। কারণ একবার শপথ করার অভ্যাস হয়ে গেলে তা আর ফেরানো যায় না। তাছাড়া বেশি বেশি শপথ করা এটা ইসলামের দৃষ্টিতেও খারাপ কাজ। এ কারণেই ফকিহরা সত্য শপথ করাকেও মাকরুহ বলেছেন। রাসুল (সা.) বলেন ‘শপথ পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে ঠিক; কিন্তু তা ব্যবসার বরকত নষ্ট করে দেয়।’ অপর বর্ণনায় আছে ‘তোমরা বেচাকেনার ক্ষেত্রে অধিক শপথ থেকে বিরত থাক, কেননা তা পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও বরকত নষ্ট করে দেয়।’ (মুসলিম, মেশকাত : ২৪৩)।
সংশয়পূর্ণ লেনদেন থেকে বিরত থাকা
ব্যবসাবাণিজ্যে কিছু বিষয় স্পষ্ট হালাল, কিছু বিষয় স্পষ্ট হারাম, যা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। আর কিছু বিষয় আছে সংশয়পূর্ণ, সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে না, বিষয়টি কি হালাল না হারাম? সে ক্ষেত্রে সৎ ব্যবসায়ীর দায়িত্ব সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। ইসলামও সন্দেহ-সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়।