হাওর বার্তা ডেস্কঃ জনশক্তি রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। ২০১৭ সালে যেখানে রেকর্ড ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে সেখানে বিদায়ী বছরে (২০১৮) তা কমে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জনে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ২০১৭ সালের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি ২০১৮ সালে প্রায় ২৭ শতাংশ কমেছে। তবে জনশক্তি রপ্তানি কমলেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৩ হাজার ৫২৬ দশমিক ৮৪ কোটি ডলার। বিদায়ী বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৪৯৭ দশমিক ৬৬ কোটি ডলারে। বরাবরের মতোই সবচেয়ে বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন কুমিল্লা জেলা থেকে। আগের বছরগুলোর মতোই পার্বত্য জেলাগুলো থেকে বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির হার সবচেয়ে কম।
শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাজ না থাকায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে শ্রমিক রপ্তানি অর্ধেকে নেমে আসা এবং জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় বড় পরিসরে কর্মী যাওয়ার পথ মাঝপথে স্থগিত হওয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। তবে আগের (২০১৭) বছরসহ টানা কয়েক বছর বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হওয়ায় বিদেশ থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো প্রবাসী আয় বেড়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় এবং হুন্ডি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়াতেও প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। জানা যায়, ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়।
জনশক্তি রপ্তানির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক বিদেশে গেছে ২০১৭ সালে, ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন। আগের দুই বছরও (২০১৫ ও ২০১৬) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক (৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন ও ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন) শ্রমিক বিদেশে গেছেন। ২০১৭ সালে ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন শ্রমিকের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হয়। যার মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই পাঠানো সম্ভব হয় ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন। আর মালয়েশিয়াতে কর্মসংস্থান হয় ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন। ২০১৮ সালের শুরুতে বিগত (২০১৭) বছরের জনশক্তি রপ্তানির সফলতা তুলে ধরতে গিয়ে সদ্য সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি সংবাদ সম্মেলনে ২০১৮ সালে জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১২ লাখ ঘোষণা করেছিলেন।
নতুন নতুন দেশে জনশক্তি রপ্তানির দ্বার উন্মোচনসহ জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে চলমান মালয়েশিয়ায় কলিং ভিসায় কর্মী পাঠানো মাঝপথে আটকে যায়। বিদায়ী বছরে আগের বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ (এক লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন) শ্রমিকের মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থান হলেও আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে দেশটিতে পাঠানোর টার্গেট ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু, একচেটিয়া ব্যবসা তথা সিন্ডিকেটের অভিযোগ এবং অতিরিক্ত অর্থ নেয়াসহ নানা অভিযোগে মালয়েশিয়া সরকার কর্তৃক অনলাইন সিস্টেম ‘এসপিপিএ’ বাতিল ঘোষণা করায় মাঝপথে শ্রমবাজারটি স্থগিত হয়ে পড়ে। নতুন সিস্টেমে এটি দ্রুত চালু করার কথা থাকলেও এখন উভয় দেশের সরকার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্বপরিচিত শ্রমবাজারের বাইরে নতুন কোনো দেশে সেই অর্থে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে সৌদি আরব সরকার ‘সৌদিকরণ কর্মসূচির (প্রতি কারখানায় ২০ শতাংশ সৌদি নাগরিক থাকা বাধ্যতামূলক)’ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে প্রবাসীদের জন্য ১২ ধরনের চাকরি বন্ধ ঘোষণা করেছে সৌদি সরকার। এতে সে দেশের শ্রমবাজার আস্তে আস্তে বাংলাদেশিদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে এসব কাজে জড়িত বাংলাদেশিরা দেশে ফিরতে শুরু করেছে। চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত কর্মী যাওয়া এবং প্রতারিত হয়ে দেশে ফেরার (নারী-পুরুষ) ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সৌদি আরবের শ্রমবাজারেও ভাটা পড়েছে। আগের বছরের তুলনায় বিদায়ী ২০১৮ সালে অর্ধেক কর্মীও সৌদি আরবে যাননি বা পাঠানো যায়নি। ফলে সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ঘোষিত জনশক্তি রপ্তানির টার্গেট পূরণ তো হয়ইনি বরং আগের বছরের চেয়ে আড়াই লাখেরও বেশি শ্রমিক কম গেছে বিদেশে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রায় ৬৩ শতাংশ হয়েছে উপসাগরীয় এবং অন্যান্য আরব দেশে। বাকি ৩৭ শতাংশের বেশির ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। এরপর মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান ও সিঙ্গাপুরে। তথ্য মতে, ২০১৮ সালে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হওয়া দেশগুলো হলো সৌদি আরবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ জন, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন, ওমানে ৭২ হাজার ৫০৪ জন, কাতারে ৭৬ হাজার ৫৬০ জন, কুয়েতে ২৭ হাজার ৬৩৭ জন, সিঙ্গাপুরে ৪১ হাজার ৩৯৩ জন। এদিকে ২০১৫ সাল থেকে দেশের নারীশ্রমিকদের বিদেশ যাওয়া ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ২০১৭ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার নারীশ্রমিক বিদেশে যান। কিন্তু ২০১৮ সালে বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জনে। এর বড় অংশই যায় সৌদি আরবে।
অর্থাৎ ২০১৮ সালে নারীশ্রমিকদের বিদেশ যাওয়া গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। জনশক্তি রপ্তানিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) বলছে, ২০১৮ সালে কমপক্ষে আট শতাধিক নারীশ্রমিক নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন। বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বামসা) চেয়ারম্যান লিলি জাহান বলেন, সৌদি আরব থেকে নারীরা নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসায় মানুষ ভয় পাচ্ছেন। তাই প্রশিক্ষণ নিয়েও অনেকে যাচ্ছেন না। আগের বছরগুলোর মতো বিদায়ী (২০১৮) বছরেও কোনো শ্রমবাজার উন্মোচিত হয়নি। এ বিষয়ে রামরুর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, নারী-পুরুষ উভয়ে যেসব দেশে যাচ্ছে সেটির সামগ্রিক মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, দেশের শ্রমবাজারে বরাবরই একটি বা দুটি দেশের আধিপত্য। কখনো সংযুক্ত আরব আমিরাত, কখনো মালয়েশিয়া বা সৌদি আরব।
এক দেশকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থার অসুবিধা হলো সেই দেশে কোনো সমস্যা বা বিপর্যয় দেখা দিলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারও বিপদের মুখে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, প্রায় ছয় বছর পর বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার খুলেছে। প্রকৃতপক্ষে পুরুষ শ্রমিকদের জন্য বাজার বন্ধই রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আরব আমিরাত শুধু নারী গৃহকর্মী গ্রহণ করছে। ২০১৮ সালে মাত্র ৩ হাজার ২৩৫ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন, যাদের অধিকাংশই নারী। দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী, ধীরে ধীরে ১৯টি পেশায় পুরুষ কর্মী নেবে দেশটি। জাপানে স্বল্প পরিসরে শুধুমাত্র ইন্টার্ন পাঠানো শুরু হলেও এখনো আলোচিত রাশিয়া ও ইউরোপের দেশে শ্রমিক রপ্তানির পথ খোলেনি।
নতুন নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত না হওয়ায় গতি হারাচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে ৪ লাখ থেকে ৭ লাখের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি ওঠা নামা করছে। ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই এক ধাপে ১০ লাখ ছাড়িয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে। বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই দুটি বড় দেশ সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া ওপেন হওয়ায় এক ধাপে জনশক্তি রপ্তানি ১০ লাখ ছাড়িয়েছিল। এছাড়া বিগত দিনগুলোর বেশিরভাগই ৫-৭ লাখের মধ্যেই শ্রমবাজার সীমাবদ্ধ ছিল। তবে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার গত সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত না হলে এবং দুবাইয়ের শ্রমবাজার সেইভাবে ওপেন হলে সংখ্যা (জনশক্তি রপ্তানি) আরও বাড়তো।
তারপরও বলবো যা হয়েছে খারাপ হয়নি। তাছাড়া কত লোক গেল এটা না চিন্তা করে কত সংখ্যক দক্ষ লোক পাঠানো গেল এদিকেই নজর দেয়া জরুরি। তাহলে রেমিট্যান্স বাড়বে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে বায়রা মহাসচিব বলেন, যে হারে বৈধ চ্যানেলে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসছে তার চেয়েও বেশি হুন্ডির মাধ্যমে আসে। প্রবাসীরা যাতে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠায় সে ব্যাপারে উৎসাহিত করা উচিত এবং টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত। তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আলহাজ আবুল বাশার দাবি করেন, বিদেশে শ্রম উইংগুলোর ব্যর্থতার দরুণ জনশক্তি রপ্তানিতে আশানুরূপ গতি বাড়ছে না। নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে দূতাবাসগুলোকে সচল করতে হবে এবং শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকারের সাথে বায়রাকে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন সাবেক এ বায়রা নেতা।