হাওর বার্তা ডেস্কঃ অবশেষে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামী ২৩ ডিসেম্বর রবিবার। টানা দুইবার ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিও নির্বাচনে আসার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ কোনো শক্তির বুদ্ধিতে এবারের নির্বাচনে বিএনপি না এলে আইনি বাধ্যবাধকতায় দলটির নিবন্ধন বাতিল হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে দেশের অন্যতম বড় এই রাজনৈতিক দলের বর্তমান অবস্থা হয়তো ভিন্ন রকম হতো। গণতন্ত্র পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
জনগণ এখানে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের প্রতিনিধিকে সরকার গঠন করার জন্য কেন্দ্রে প্রেরণ করে। শুনতে ভালো লাগে, যে জনগণই এখানে সকল ক্ষমতার উৎস। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জনগণ ভুল লোককে তাদের প্রতিনিধি করে সংসদে পাঠাচ্ছে। নিম্নমানের লোকজন এমপি হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ, অসৎ, লোভী, কম পড়াশোনা জানা অনেকে এমপি হয়ে শুধু নিজের ও পরিবারের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। জনগণ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থেকে যায়। জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দুর্নীতিবাজকে এমপি বানালে এর ভুক্তভোগী হয় সবচেয়ে বেশি জনগণই।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচনের দাবি নিয়ে গোয়ার্তুমি করে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিএনপি সে নির্বাচনে না এলেও জাতীয় পার্টিসহ অন্য অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। বিএনপি ভেবেছিল, তারা নির্বাচনে না এলে দেশে-বিদেশে দশম জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হবে, আওয়ামী লীগ সরকার বৈধতা পাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ভেতরে থেকে সে নির্বাচন আয়োজন করে এবং দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়। ফলে বিএনপির সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে যায় দলটির জন্য।
জামায়াত আর পশ্চিমা শক্তির এজেন্ট ‘সুশীল’ সমাজের বুদ্ধিতে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর ফল ভোগ করছে দলটি। সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিএনপি ধীরে ধীরে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। দুর্নীতির মামলায় সাজা পেয়ে খালেদা জিয়া জেলখানায়, সন্ত্রাসী হামলার মামলায় সাজা পেয়েছেন তার ছেলে বিদেশে পালিয়ে থাকা তারেক রহমানও। খালেদা জিয়ার আরেক ছেকে আরাফাত রহমান কোকো ইহকাল ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলবন্দি হলেও বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো সামান্যতম আন্দোলন দাঁড় করাতে পারেনি। নীতি ও নৈতিকতার চর্চা না থাকলে একটা রাজনৈতিক দলের অবস্থা বুঝি এমনই হয়।
বিএনপির এর নেতৃত্বশূন্যতার সুযোগে ছোট ছোট কিছু দলের বড় নেতা বিএনপির জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে দেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটা কিছু করার চেষ্টা করে চলেছেন। প্রথমত যুক্তফ্রন্ট নামে, পরবর্তী সময়ে ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি প্লাটফর্ম দাঁড়ায়। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রহমান মান্নার তৎপরতায় ঐক্যফ্রন্ট মিডিয়াতে ভালো কাভারেজ পেলেও জনগণের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। ঐক্যফ্রন্ট এ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের অবস্থান এমনই নড়বড়ে যে, তাদের দাবি-দাওয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিও প্রাধান্য পায়নি। কামাল হোসেন হয়ে উঠেন ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা। মাহমুদুর রহমান মান্না মাঠ গরম করার জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির নিমিত্তে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন বলেও হুমকি দেন। তবে খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে ইতিমধ্যে আবার কারাগারে ফেরত গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট দুই দফা সংলাপ করে।
দুই দফার সংলাপ শেষে যে ইম্প্রেশন সারা দেশের মানুষ পেয়েছে সেটি হলো, শেখ হাসিনার যুক্তি, ব্যক্তিত্ব আর দৃঢ়চেতা মনোবলের কাছে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সবাই আত্মসমর্পণ করেছেন। দেশের সংবিধান, আইন, উন্নয়ন আর তাদের নিজেদের নানা সময়ের অনিয়মের কথার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর সামনে একটাও শক্ত জবাব দিতে পারেননি ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধিরা। এখানেই সততা, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার শক্তি। শেখ হাসিনার কাছে ঐক্যফ্রন্টের সম্মিলিত শক্তিও ম্লান হয়ে গেছে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্বাচন শুধু সরকার বা কমিশনের কাজ নয়। জনগণ ভোট দিতে না গেলে নির্বাচন উৎসবমুখর হয় না। একটি উৎসবমুখর, সুষ্ঠু নির্বাচন তখনই সম্ভব হয় যখন জনগণ ভোট দিতে কেন্দ্রে আসে। কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু ভোটের আয়োজন করা। কমিশন সুষ্ঠু ভোটের আয়োজন করল, জনগণ ভোট দিতে এলো, তাতেও কিন্তু নির্বাচন সফল হবে না। নির্বাচন সফল হবে তখনই যখন যোগ্য, সৎ, দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন।
যে রাজনৈতিক দল বা শক্তি দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটাতে সহায়তা করেছে, দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে বার বার চ্যাম্পিয়ন করেছে, যে দলের শীর্ষ নেতা দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে বন্দি, যে দলের শীর্ষ নেতারা প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে গ্রেনেড হামলার মতো জঘন্য ঘটনার জন্ম দিতে পারে সে দলের পক্ষে জনগণের ভোট যাবে কি না সেটি নিয়ে প্রতিটি ভোটারকে ভাবতে হবে। ভোটারদের ভাবতে হবে দেশের নেতৃত্ব দেয়ার মতো নেতা এখন কে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছেন? শুধু আবেগ আর অন্ধদলীয় আনুগত্যের বশে ভোট দিয়ে দিলে হবে না। কোন সরকারের সময় কেমন উন্নয়ন হয়েছে দেশের; ভোটারের নিজের, পরিবার ও সমাজের কেমন উন্নয়ন হয়েছে, এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আবেগ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে ভোট দিতে হবে।
বিশেষ করে তরুণ সমাজকে যুক্তির শক্তিতে মুক্তির পথ বেছে নিতে হবে। বিশ্ব যখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল বলে মেনে নিয়েছে, বিশ্ব যখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় বলে রায় দিচ্ছে তখন তরুণ সমাজকেও ভোটের সময় সঠিক জায়গায় ভোট দিতে হবে। যে উন্নয়ন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে, সে উন্নয়ন যেন থেমে না যায়। উন্নয়নকে অব্যাহত রাখার জন্য সঠিক জায়গায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করা সময়ের দাবি। গণতন্ত্র যেন আমাদের গলার কাটা হয়ে না দাঁড়ায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সমর্থক করে গড়ে তুলতে তাই আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব না। আমার ভোটের সুযোগে কোনো অশুভ শক্তি যেন দেশের ক্ষমতায় আসতে না পারে। আমি ভোট দেব সেই শক্তিকে যারা নিজেদেরকে উন্নয়নবান্ধব বলে প্রমাণ করতে পেরেছে।
লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক