ঢাকা ০৮:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অসলো চুক্তির সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩৩:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ অক্টোবর ২০১৮
  • ৩৮২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কয়েক যুগ ধরে চলতে থাকা মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অন্যতম ঘটনা হলো আরব-ইসরাইল সংকট। ইসরাইল যেমন চাচ্ছে তাদের স্বপ্ন রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করতে, ঠিক অন্যদিকে ফিলিস্তিনও চাচ্ছে তাদের ন্যায্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার। এসব কিছু মিলিয়ে সারা মধ্যপ্রাচ্য এখনো উত্তপ্ত। আমরা দেখি, শুরু থেকে একবার মাত্র শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সেখানে। সেটা নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। ১৯৯৩ সাল। চির বৈরী ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নরওয়ের অসলোতে গোপন বৈঠক হয়। এর সূত্র ধরে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিতে সই করেন ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত ও সেই সময়ের ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। ঐতিহাসিক ওই চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি হয়েছে সম্প্রতি।

২৫ বছর আগের ওই চুক্তিতে বোঝাপড়া হয়েছিল ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে এবং ইসরাইল পশ্চিমতীর ও গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। বদলে ইসরাইলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে পিএলও। ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের স্বীকৃতি মানতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত স্বশাসনের দেখা মেলেনি। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা। বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তি সইয়ের পর আরাফাত-রবিন হাত মেলানোর মধ্যে দিয়ে ইসরাইল-ফিলিস্তিন কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, দিন দিন তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে।

চুক্তির নেপথ্যে তিন ব্যক্তি ইয়াসির আরাফাত, আইজ্যাক রবিন ও ইসরাইলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে পরে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আড়াই দশক আগে আজকের এই দিনটিতে হোয়াইট হাউসের লনে অসলো শান্তিচুক্তি সই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় তিন হাজার আমন্ত্রিত অতিথি। তারা প্রত্যক্ষ করেন কিভাবে পুরনো দুই শত্রুবিভেদ ভুলে সম্প্রীতির বন্ধনে হাতে হাত রাখেন। সম্প্রীতির ওই যাত্রায় প্রথমে হাত বাড়িয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। খানিকটা ইতস্তত করলেও পরে রবিন হাত বাড়ান।

ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ফিলিস্তিন-ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও ফিলিস্তিনিদের বঞ্চনার অবসানে একে এক বড় ধরনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। যদিও ফিলিস্তিন ও ইসরাইল এবং আরব দেশের ভেতর এর কিছু সমালোচনাও শুরু হয়।

১৯৯৪ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনে অন্তর্বর্তীকালীন স্বশাসন শুরু হয়। দুই মাস পর ২৭ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে নিজ ভূখণ্ডে ফেরেন আরাফাত। গঠন করেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথ তৈরি ও এর দেখভালের দায়িত্ব পায় এই কর্তৃপক্ষ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে এক নতুন মধ্যবর্তী চুক্তি সই হয়, যা অসলো-২ নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য ছিল পশ্চিমতীরে স্বশাসনের পরিধি বাড়ানো। কিন্তু ৪ নভেম্বর ১৯৯৫ চুক্তির বিরোধিতাকারী উগ্রপন্থি ইহুদিবাদী একটি সংগঠনের পক্ষে আইজ্যাক রবিনকে হত্যা করা হয়। চুক্তি বাস্তবায়নে এটি ছিল এক বিরাট ধাক্কা। ২০০০ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা। এমন আশা-নিরাশার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এক নতুন সমঝোতা শুরু হয়। তবে সর্বশেষ সরাসরি এই সমঝোতা কোনো ফল বয়ে আনেনি। ২৫ বছর আগে অসলো চুক্তি যেখানে ছিল, তা সেখানেই পড়ে আছে। পশ্চিমতীর এখনো দখলীকৃত ভূখণ্ড ও গাজা উপত্যকা ইসরাইলি দখলদারদের অবরোধের মধ্যেই পড়ে আছে।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের বীজ কিন্তু হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শত বছরের চেয়েও কম। কিন্তু বহুকাল আগে খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে এ অঞ্চলে তাদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় সে সময় তারা ইসরাইলি হিসেবে আলাদাভাবে পরিচয় লাভ করেনি। এই জনগোষ্ঠীর দাবি, ইহুদি হিসেবে তারা তাওরাতে বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি ‘ক্যানান’ তথা বর্তমান ফিলিস্তিন, জেরুজালেম এবং জর্ডান, সিরিয়া, মিশরের কিছু অংশ মিলিয়ে একটি রাষ্ট্রের মালিক। যদিও তাদের এ দাবির পেছনে অন্যদের মতানৈক্য রয়েছে। যিশুর আবির্ভাবের পর তাদের ক্ষমতার পটপরিবর্তন হতে থাকে, এর ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের দিকে কনস্টান্টিনোপল সাম্রাজ্য কর্তৃক তাদের ক্ষমতা হারাতে থাকে, তার পরবর্তী সময়ে সপ্তম শতকে তারা পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

এরপর ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে কিছু সময়ের জন্য জেরুজালেম খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায় এবং ১১৮৭ সালে আবার মুসলমানদের হাতে চলে আসে। এসব ডামাডোলে এ অঞ্চলে ইহুদিদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে যার দরুন তারা ইউরোপে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ফলে রাশিয়াসহ ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং জেরুজালেম থেকে তাদের অবস্থান প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। অপরদিকে ১৮৮২ সালে রাশিয়ার ইহুদিদের দ্বারা ‘জায়ান’ আন্দোলন শুরু হয়।

জায়ান হলো জেরুজালেমের একটি পাহাড়, যাকে তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও আলাদা ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮৯৭ সালে ‘জায়োনিস্ট’ সংঘ গড়ে তোলে। তারপর থেকেই তারা ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে অল্প পরিমাণে আগমন করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় আর্থার ব্যালফোর কর্তৃক প্রকাশিত হয় ‘ব্যালফোর ঘোষণা’। যার প্রধান বক্তব্য হলো প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অটোমানদের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ফলে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদিদের আগমন বৃদ্ধি পায়। তার উপরে ১৯৩৩ সালে হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধন শুরু হলে এই অঙ্ক বিশাল হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময় বিপুল সংখ্যক ইহুদি সারা বিশ্ব থেকে এখানে এসে জড়ো হয়। ফলে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাদের সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তা অঞ্চলের স্থানীয় আরব মুসলিমদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তারা প্যালেস্টাইনের নতুন নতুন ভ‚মি অধিগ্রহণ করতে থাকে, যা প্যালেস্টাইনসহ তার আশপাশের আরবরা সহজে মেনে নিতে পারেনি। ফলে শুরু হয় ইহুদি বনাম আরব বিরোধ।

এর মধ্যেই গঠিত ইহুদিদের সন্ত্রাসী সংঘটন ‘ইর্গুন কিং’ যাদের নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে বোমা বিস্ফোরণসহ আরও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যার অধিকাংশই ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ফলে ইহুদি-মুসলিম সংঘাত চরমে উঠে। এ সময়ে ব্রিটিশরা চাতুর্যের সঙ্গে এই অঞ্চলের দায়িত্ব জাতিসংঘের হাতে অর্পণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে এ অঞ্চল থেকে বিদায় নেয়।

জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে জেরুজালেমসহ সারা প্যালেস্টাইন অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করে- পশ্চিমাংশে ইসরাইল, পূর্বাংশে প্যালেস্টাইন এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক তত্তাবধানে রাখা হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের ১৫ মে জাতিসংঘ ইসরাইলকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে। এর পরপরই ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া স্বীকৃতি দান করে। অপরদিকে কৌশলে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার বিষয়টি এড়িয়ে যায়, যা আরবলীগ কর্তৃক ব্যাপক সমালোচিত হয়। ফলে শুরু হয় আরব-ইসরাইল সংঘাত। এতে জড়িয়ে পড়ে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক প্রভৃতি আরব রাষ্ট্র। এর ধারাবাহিকতায় আরব-ইসরাইলদের মধ্যে ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সংঘাত বর্তমান পর্যন্ত গড়িয়েছে যদিও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনিরা বলা যায় সবার সহায়তা হারিয়ে একাই লড়ে যাচ্ছে ইসরাইলদের বিরুদ্ধে।

আমরা দেখি, ১৯৬৭ সালের জুনের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর থেকে অনেক শান্তি আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ প্রস্তাব, ১৯৬৭। এ প্রস্তাবে সাম্প্রতিক সংঘাতে দখলকৃত ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহারের আহবান জানানো হয়। এরপর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি, ১৯৭৮-এর মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিশরের আনোয়ার সাদাত ও ইসরাইলের মেনাচেম বেগিনের মধ্যে চুক্তি হয়, যা প্রথম আরব-ইসরাইল শান্তিচুক্তি হিসেবে খ্যাত। ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনেও জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। আরাফাতের পিএলওর ব্যাপারে ইসরাইলের আপত্তির কারণে ফিলিস্তিনিরা অংশ নেয় জর্ডানের সঙ্গে যৌথভাবে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে জর্ডান-ইসরাইল শান্তিচুক্তি হয়।

তবে আশার আলো শুধু দেখা গিয়েছিল সেই ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে। মাদ্রিদের পর থেকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের নেপথ্যে শান্তির উদ্যোগ চলতে থাকে। এর পরিণতিতে নরওয়ের গোপন মধ্যস্থতায় চুক্তি হয়। এতে স্থির হয়, পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী পর্যায়ক্রমে সরে যাবে। পাঁচ বছরের জন্য অন্তর্র্বর্তী স্বশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। এরপর জাতিসংঘের ২৪২ ও ৩৩৮ প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্থায়ী সমাধান হবে। এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে লিখিত না হলেও এ ইঙ্গিত থাকে যে, একদিন ইসরাইলের পাশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে তা আর সেভাবে কার্যকর হয়নি।

এরপর আমরা পাই রোডম্যাপ, ২০০৩। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ‘কোয়াট্রেট’ এই পরিকল্পনা তৈরি করে। এই রূপরেখার লক্ষ্য ছিল চূড়ান্ত সমাধানের আলোচনার জন্য পারস্পরিক আস্থা তৈরি করা। নানা কারণে এর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এ বছরের ডিসেম্বরেই জেনেভায় দুপক্ষের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ভূখণ্ড বিনিময়সহ বিভিন্ন প্রশ্নে কিছু সমঝোতা হয়।

এর চার বছর যে শান্তি আলোচনা, তা অ্যানাপোলিস, ২০০৭ নামে পরিচিত। থমকে যাওয়া শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিউ বুশ মেরিল্যান্ডের অ্যানাপোলিসের নেভাল একাডেমিতে সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাশাপাশি সৌদি আরব, সিরিয়াসহ ১২টির বেশি আরব দেশ অংশ নেয়। ২০০৮ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তির সিদ্ধান্ত হয়।

২৫ বছর পর এসে অসলো চুক্তি যদি মূল্যায়ন করা হয়, তবে বলবো ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের তিন নেতা নোবেল পুরস্কার ছাড়া বর্তমান বাস্তবতায় আর কিছুই দিতে পারেননি। চুক্তিটি অনেকটা লঙ্ঘন করে ইসরাইল আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের ভূমিতে তাদের বসতি বাড়ছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ইসরাইলের আগ্রাসন যদি না ঠেকানো যায় তবে অচিরেই এ-অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিন নামের একটি জাতিসত্তার বিলুপ্তি ঘটে যাবে।

এর বিপরীত কিছু হতে হলে বিশ্বসম্প্রদায়কে মানবিক অবস্থান নিতে হবে। জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। আর ফিলিস্তিনিদেরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদি হামাস ও ফাতাহ সব ভেদাভেদ ভুলে একই পতাকাতলে সমবেত হয় তাহলে স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারবে। আর ওআইসি এবং আরব লীগকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে হবে।

ফিলিস্তিনের চেয়ে অসলো চুক্তি থেকে তুলনামূলকভাবে ইসরাইল অধিকতর সুবিধা তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষত, বিদেশি কোম্পানিগুলো আরব দেশগুলোর সম্ভাব্য বর্জনের ভীতি কাটিয়ে ইসরাইলে শাখা খুলতে থাকে। এটি অর্থনৈতিকভাবে ইসরাইলকে এগিয়ে দেয়। ইসরাইল জর্ডানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। অন্য আরব দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের পথ তৈরি হয়। সে তুলনায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়টি একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে অসলো চুক্তি ফিলিস্তিনিদের জন্য একধরনের প্রহসনে রূপ নেয়। চুক্তির ২৫ বছর পর তা আরেকবার স্পষ্ট হয়েছে। আসলে সাত দশকের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম হতাশাই উপহার পেয়ে আসছে। অসলো চুক্তির ২৫ বছর পর এসেও দুঃসহ স্মৃতি শুধু ফিলিস্তিনিদেরই নয়, গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনের ভেতরেই ক্ষোভ তৈরি করেছে। ক্ষোভের আগুন থেকেই জন্ম নিক আশার আলো। ফিলিস্তিনিদের জন্য আমরা শুধু এইটুকু প্রত্যাশা রাখতে পারি।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

অসলো চুক্তির সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান

আপডেট টাইম : ০৫:৩৩:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ অক্টোবর ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কয়েক যুগ ধরে চলতে থাকা মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অন্যতম ঘটনা হলো আরব-ইসরাইল সংকট। ইসরাইল যেমন চাচ্ছে তাদের স্বপ্ন রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করতে, ঠিক অন্যদিকে ফিলিস্তিনও চাচ্ছে তাদের ন্যায্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার। এসব কিছু মিলিয়ে সারা মধ্যপ্রাচ্য এখনো উত্তপ্ত। আমরা দেখি, শুরু থেকে একবার মাত্র শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সেখানে। সেটা নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। ১৯৯৩ সাল। চির বৈরী ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নরওয়ের অসলোতে গোপন বৈঠক হয়। এর সূত্র ধরে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিতে সই করেন ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত ও সেই সময়ের ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। ঐতিহাসিক ওই চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি হয়েছে সম্প্রতি।

২৫ বছর আগের ওই চুক্তিতে বোঝাপড়া হয়েছিল ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে এবং ইসরাইল পশ্চিমতীর ও গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। বদলে ইসরাইলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে পিএলও। ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের স্বীকৃতি মানতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত স্বশাসনের দেখা মেলেনি। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা। বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তি সইয়ের পর আরাফাত-রবিন হাত মেলানোর মধ্যে দিয়ে ইসরাইল-ফিলিস্তিন কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, দিন দিন তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে।

চুক্তির নেপথ্যে তিন ব্যক্তি ইয়াসির আরাফাত, আইজ্যাক রবিন ও ইসরাইলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে পরে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আড়াই দশক আগে আজকের এই দিনটিতে হোয়াইট হাউসের লনে অসলো শান্তিচুক্তি সই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় তিন হাজার আমন্ত্রিত অতিথি। তারা প্রত্যক্ষ করেন কিভাবে পুরনো দুই শত্রুবিভেদ ভুলে সম্প্রীতির বন্ধনে হাতে হাত রাখেন। সম্প্রীতির ওই যাত্রায় প্রথমে হাত বাড়িয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। খানিকটা ইতস্তত করলেও পরে রবিন হাত বাড়ান।

ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ফিলিস্তিন-ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও ফিলিস্তিনিদের বঞ্চনার অবসানে একে এক বড় ধরনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। যদিও ফিলিস্তিন ও ইসরাইল এবং আরব দেশের ভেতর এর কিছু সমালোচনাও শুরু হয়।

১৯৯৪ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনে অন্তর্বর্তীকালীন স্বশাসন শুরু হয়। দুই মাস পর ২৭ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে নিজ ভূখণ্ডে ফেরেন আরাফাত। গঠন করেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথ তৈরি ও এর দেখভালের দায়িত্ব পায় এই কর্তৃপক্ষ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে এক নতুন মধ্যবর্তী চুক্তি সই হয়, যা অসলো-২ নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য ছিল পশ্চিমতীরে স্বশাসনের পরিধি বাড়ানো। কিন্তু ৪ নভেম্বর ১৯৯৫ চুক্তির বিরোধিতাকারী উগ্রপন্থি ইহুদিবাদী একটি সংগঠনের পক্ষে আইজ্যাক রবিনকে হত্যা করা হয়। চুক্তি বাস্তবায়নে এটি ছিল এক বিরাট ধাক্কা। ২০০০ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা। এমন আশা-নিরাশার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এক নতুন সমঝোতা শুরু হয়। তবে সর্বশেষ সরাসরি এই সমঝোতা কোনো ফল বয়ে আনেনি। ২৫ বছর আগে অসলো চুক্তি যেখানে ছিল, তা সেখানেই পড়ে আছে। পশ্চিমতীর এখনো দখলীকৃত ভূখণ্ড ও গাজা উপত্যকা ইসরাইলি দখলদারদের অবরোধের মধ্যেই পড়ে আছে।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের বীজ কিন্তু হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শত বছরের চেয়েও কম। কিন্তু বহুকাল আগে খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে এ অঞ্চলে তাদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় সে সময় তারা ইসরাইলি হিসেবে আলাদাভাবে পরিচয় লাভ করেনি। এই জনগোষ্ঠীর দাবি, ইহুদি হিসেবে তারা তাওরাতে বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি ‘ক্যানান’ তথা বর্তমান ফিলিস্তিন, জেরুজালেম এবং জর্ডান, সিরিয়া, মিশরের কিছু অংশ মিলিয়ে একটি রাষ্ট্রের মালিক। যদিও তাদের এ দাবির পেছনে অন্যদের মতানৈক্য রয়েছে। যিশুর আবির্ভাবের পর তাদের ক্ষমতার পটপরিবর্তন হতে থাকে, এর ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের দিকে কনস্টান্টিনোপল সাম্রাজ্য কর্তৃক তাদের ক্ষমতা হারাতে থাকে, তার পরবর্তী সময়ে সপ্তম শতকে তারা পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

এরপর ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে কিছু সময়ের জন্য জেরুজালেম খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায় এবং ১১৮৭ সালে আবার মুসলমানদের হাতে চলে আসে। এসব ডামাডোলে এ অঞ্চলে ইহুদিদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে যার দরুন তারা ইউরোপে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ফলে রাশিয়াসহ ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং জেরুজালেম থেকে তাদের অবস্থান প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। অপরদিকে ১৮৮২ সালে রাশিয়ার ইহুদিদের দ্বারা ‘জায়ান’ আন্দোলন শুরু হয়।

জায়ান হলো জেরুজালেমের একটি পাহাড়, যাকে তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও আলাদা ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮৯৭ সালে ‘জায়োনিস্ট’ সংঘ গড়ে তোলে। তারপর থেকেই তারা ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে অল্প পরিমাণে আগমন করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় আর্থার ব্যালফোর কর্তৃক প্রকাশিত হয় ‘ব্যালফোর ঘোষণা’। যার প্রধান বক্তব্য হলো প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অটোমানদের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ফলে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদিদের আগমন বৃদ্ধি পায়। তার উপরে ১৯৩৩ সালে হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধন শুরু হলে এই অঙ্ক বিশাল হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময় বিপুল সংখ্যক ইহুদি সারা বিশ্ব থেকে এখানে এসে জড়ো হয়। ফলে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাদের সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তা অঞ্চলের স্থানীয় আরব মুসলিমদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তারা প্যালেস্টাইনের নতুন নতুন ভ‚মি অধিগ্রহণ করতে থাকে, যা প্যালেস্টাইনসহ তার আশপাশের আরবরা সহজে মেনে নিতে পারেনি। ফলে শুরু হয় ইহুদি বনাম আরব বিরোধ।

এর মধ্যেই গঠিত ইহুদিদের সন্ত্রাসী সংঘটন ‘ইর্গুন কিং’ যাদের নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে বোমা বিস্ফোরণসহ আরও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যার অধিকাংশই ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ফলে ইহুদি-মুসলিম সংঘাত চরমে উঠে। এ সময়ে ব্রিটিশরা চাতুর্যের সঙ্গে এই অঞ্চলের দায়িত্ব জাতিসংঘের হাতে অর্পণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে এ অঞ্চল থেকে বিদায় নেয়।

জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে জেরুজালেমসহ সারা প্যালেস্টাইন অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করে- পশ্চিমাংশে ইসরাইল, পূর্বাংশে প্যালেস্টাইন এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক তত্তাবধানে রাখা হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের ১৫ মে জাতিসংঘ ইসরাইলকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে। এর পরপরই ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া স্বীকৃতি দান করে। অপরদিকে কৌশলে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার বিষয়টি এড়িয়ে যায়, যা আরবলীগ কর্তৃক ব্যাপক সমালোচিত হয়। ফলে শুরু হয় আরব-ইসরাইল সংঘাত। এতে জড়িয়ে পড়ে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক প্রভৃতি আরব রাষ্ট্র। এর ধারাবাহিকতায় আরব-ইসরাইলদের মধ্যে ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সংঘাত বর্তমান পর্যন্ত গড়িয়েছে যদিও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনিরা বলা যায় সবার সহায়তা হারিয়ে একাই লড়ে যাচ্ছে ইসরাইলদের বিরুদ্ধে।

আমরা দেখি, ১৯৬৭ সালের জুনের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর থেকে অনেক শান্তি আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ প্রস্তাব, ১৯৬৭। এ প্রস্তাবে সাম্প্রতিক সংঘাতে দখলকৃত ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহারের আহবান জানানো হয়। এরপর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি, ১৯৭৮-এর মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিশরের আনোয়ার সাদাত ও ইসরাইলের মেনাচেম বেগিনের মধ্যে চুক্তি হয়, যা প্রথম আরব-ইসরাইল শান্তিচুক্তি হিসেবে খ্যাত। ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনেও জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। আরাফাতের পিএলওর ব্যাপারে ইসরাইলের আপত্তির কারণে ফিলিস্তিনিরা অংশ নেয় জর্ডানের সঙ্গে যৌথভাবে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে জর্ডান-ইসরাইল শান্তিচুক্তি হয়।

তবে আশার আলো শুধু দেখা গিয়েছিল সেই ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে। মাদ্রিদের পর থেকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের নেপথ্যে শান্তির উদ্যোগ চলতে থাকে। এর পরিণতিতে নরওয়ের গোপন মধ্যস্থতায় চুক্তি হয়। এতে স্থির হয়, পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী পর্যায়ক্রমে সরে যাবে। পাঁচ বছরের জন্য অন্তর্র্বর্তী স্বশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। এরপর জাতিসংঘের ২৪২ ও ৩৩৮ প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্থায়ী সমাধান হবে। এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে লিখিত না হলেও এ ইঙ্গিত থাকে যে, একদিন ইসরাইলের পাশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে তা আর সেভাবে কার্যকর হয়নি।

এরপর আমরা পাই রোডম্যাপ, ২০০৩। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ‘কোয়াট্রেট’ এই পরিকল্পনা তৈরি করে। এই রূপরেখার লক্ষ্য ছিল চূড়ান্ত সমাধানের আলোচনার জন্য পারস্পরিক আস্থা তৈরি করা। নানা কারণে এর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এ বছরের ডিসেম্বরেই জেনেভায় দুপক্ষের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ভূখণ্ড বিনিময়সহ বিভিন্ন প্রশ্নে কিছু সমঝোতা হয়।

এর চার বছর যে শান্তি আলোচনা, তা অ্যানাপোলিস, ২০০৭ নামে পরিচিত। থমকে যাওয়া শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিউ বুশ মেরিল্যান্ডের অ্যানাপোলিসের নেভাল একাডেমিতে সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাশাপাশি সৌদি আরব, সিরিয়াসহ ১২টির বেশি আরব দেশ অংশ নেয়। ২০০৮ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ শান্তিচুক্তির সিদ্ধান্ত হয়।

২৫ বছর পর এসে অসলো চুক্তি যদি মূল্যায়ন করা হয়, তবে বলবো ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের তিন নেতা নোবেল পুরস্কার ছাড়া বর্তমান বাস্তবতায় আর কিছুই দিতে পারেননি। চুক্তিটি অনেকটা লঙ্ঘন করে ইসরাইল আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের ভূমিতে তাদের বসতি বাড়ছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ইসরাইলের আগ্রাসন যদি না ঠেকানো যায় তবে অচিরেই এ-অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিন নামের একটি জাতিসত্তার বিলুপ্তি ঘটে যাবে।

এর বিপরীত কিছু হতে হলে বিশ্বসম্প্রদায়কে মানবিক অবস্থান নিতে হবে। জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। আর ফিলিস্তিনিদেরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদি হামাস ও ফাতাহ সব ভেদাভেদ ভুলে একই পতাকাতলে সমবেত হয় তাহলে স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারবে। আর ওআইসি এবং আরব লীগকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে হবে।

ফিলিস্তিনের চেয়ে অসলো চুক্তি থেকে তুলনামূলকভাবে ইসরাইল অধিকতর সুবিধা তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষত, বিদেশি কোম্পানিগুলো আরব দেশগুলোর সম্ভাব্য বর্জনের ভীতি কাটিয়ে ইসরাইলে শাখা খুলতে থাকে। এটি অর্থনৈতিকভাবে ইসরাইলকে এগিয়ে দেয়। ইসরাইল জর্ডানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। অন্য আরব দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের পথ তৈরি হয়। সে তুলনায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়টি একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে অসলো চুক্তি ফিলিস্তিনিদের জন্য একধরনের প্রহসনে রূপ নেয়। চুক্তির ২৫ বছর পর তা আরেকবার স্পষ্ট হয়েছে। আসলে সাত দশকের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম হতাশাই উপহার পেয়ে আসছে। অসলো চুক্তির ২৫ বছর পর এসেও দুঃসহ স্মৃতি শুধু ফিলিস্তিনিদেরই নয়, গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনের ভেতরেই ক্ষোভ তৈরি করেছে। ক্ষোভের আগুন থেকেই জন্ম নিক আশার আলো। ফিলিস্তিনিদের জন্য আমরা শুধু এইটুকু প্রত্যাশা রাখতে পারি।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার