হাওর বার্তা ডেস্কঃ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামে নতুন যে জোট হয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। তিনি এই জোটে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনি চান আরও বৃহত্তর ঐক্য। সেই ঐক্যে তিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগকেও চান। একাত্তর সালে দেশে যে ঐতিহাসিক ঐক্য হয়েছিল সেই ঐক্য প্রত্যাশা করছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক। বুধবার রাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের নিয়মিত টক শো ‘আজকের বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। খালিদ মহিউদ্দিনের উপস্থাপনায় তার সঙ্গে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত। বাসা থেকে লাইভে যোগ দেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইব্রাহীম।
‘আপনি সব সময় বলতেন দেশে একটি জাতীয় ঐক্য হওয়া দরকার। সেই জাতীয় ঐক্য হচ্ছে বা হয়েছে তাতে আপনি থাকলেন না, তার কারণ কী আমাদের বলবেন? না কি অন্য কোনো ঐক্যের কথা ভাবছেন?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, এটা যথার্থ করেছেন। আমি এর সূচনাতে ছিলাম, বলতে পারেন এখনও আছি। আমি কিন্তু একটা অর্থবহ জাতীয় ঐক্য চাই। আমি একাত্তরের মতো দেশে একটা ঐতিহাসিক ঐক্য চাই, যে ঐক্যের মাধ্যমে আমাদের দেশে মানবিক মূল্যবোধগুলোর অবক্ষয় ঘটছে, সেখান থেকে আমরা যাতে ফিরে আসতে পারি। তাই আমি অন্য কোথাও যাচ্ছি কি না, এটা ভাবার এখনও কোনো কারণ নেই।’
কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি গোপনে কোনো কাজ এ পর্যন্ত করিনি। আর ক’দিন বাঁচব ঠিক জানি না। দেশের মানুষকে আঘাত দিয়ে কোনো গোপন কাজ করতে পারব না।’
‘একাত্তর সালে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে, এখন যেটা যাচ্ছেন সেটা কি কারো বিরুদ্ধে’- সঞ্চালকের এমন প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘না, না না না। আমি তো আমার বিরুদ্ধেই একতা চাচ্ছি। আমরা যে নিজের দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলেছি, একে-অন্যকে সম্মান করতে পারি না, ধীরে ধীরে সবই একটা লাগামহীন অবস্থা হয়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্যই আমি জাতীয় ঐক্য চাই।’
এখন যে ঐক্যটি হয়েছে, সেটিকে আপনি সে রকম মনে করছেন না? এমন প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘না, আমি সেটাকে পরিপূর্ণ মনে করছি না। কিন্তু আমি এ ঐক্যকে সাধুবাদ জানাই। বর্তমান সরকার বা সরকারি দল যেভাবে সবকিছুকে হালকা কথা দিয়ে, ছোটখাট কথা দিয়ে ছোট করতে চায়, আমার কাছে এটা খুব ভালো মনে হয় না।’
কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মতো বাক্য উচ্চারণ করুক, কথা বলুক। দেশের একজন মন্ত্রী, একটা মস্তবড় দল, এ দলের সাধারণ সম্পাদক তিনিও দায়িত্ব নিয়ে কথা বলবেন। এত হালকাভাবে বলার কোনো কারণ নেই। জাতীয় ঐক্যের তো অবশ্যই প্রয়োজন। অবশ্যই আমি ক্ষমতাসীনদেরও জাতীয় ঐক্যে চাই, অবশ্যই।’
টকশোতে বাসা থেকে লাইভে যোগ দেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইব্রাহিম। সঞ্চালক বলেন, যে ঐক্য হয়েছে বিএনপির সাথে তাতে আপনি কতটা খুশি, বা কতটা নাখোশ- এমন প্রশ্নে ইব্রাহিম বলেন, ‘আমাদের সমাজে নৈতিকতার যে অধঃপতন এবং ধস নেমেছে, তার সাথে যদি যোগ করি নীতিহীনতা, স্বচ্ছতা বা দেশপ্রেম। সার্বিক ধস নেমেছে, এটা একদিনে হয়নি। একদিনে নয়, দশ বছরে নয়, বেশ কয়েক বছর ধরে। এটি পুনরুদ্ধার করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে। এর জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার।’
ইব্রাহীম বলেন, ‘এই মুহূর্তে যে জাতীয় ঐক্যটি করা হয়েছে, এটা একান্তভাবেই একটি রাজনৈতিক ঐক্য। নাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বিএনপি আমাদের প্রতিনিধিত্ব করুক।’
নৈতিকতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছিলেন, তাতে এই ঐক্যফ্রন্টে আপনার আশা পূরণ হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে ইব্রাহীম বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগকে এই মুহূর্তে এই ঐক্যফ্রন্টে কল্পনা করছি না। রাজনৈতিক যে ঐক্যটি হয়েছে, আওয়ামী লীগ এবং যারা ঐক্য করেছেন তারা উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর বাসিন্দা রাজনৈতিক অঙ্গনে। অতএব এটা আমি মনে করি এই মুহূর্তের জন্য বেশি চাওয়া।’
এই ঐক্যটিকে কীভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই ঐক্যের যা হচ্ছে তাতে এটাকে ঐক্য না বলে আমি বলতে চাই এটা একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেটা দুই দিন আগে হলো, তার সাথে এখানে ২০ দল থেকে বিএনপি এসেছে। মজার বিষয় ২০ দল থেকে আবার দুটো দল বের হয়ে গেছে। ঐক্যের প্রক্রিয়ার মধ্যে আবার ভাঙনও দেখা গেছে। আবার ঐক্যফ্রন্টে যুক্তফ্রন্ট পুরোটা আসেনি। দুজন এসেছেন যুক্তফ্রন্টের, আবার বিকল্পধারা থেকে গেছে।’
আরাফাত বলেন, ‘তাহলে আলটিমেটলি যেটি বলা হচ্ছিল আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টি তাদের বাইরে বাকি সবাইকে নিয়ে একটা জাতীয় ঐক্য হবে। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল জাতীয় পার্টি যারা এদিকে আছে তারাই মোটামুটি ৬০% মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে। আপনি যদি ২০০৮ সালের নির্বাচন দেখেন, এর বাইরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপে যেটা দেখা যায়।’
‘বাকি যে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে বিএনপি এবং অন্যান্য যারা আছে তারা সবাইকে একাট্টা করার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। যে কারণে যারা যুক্তফ্রন্ট করলেন কিছুদিন আগে, করে তারাই যুক্তফ্রন্টে থাকতে পারলেন না। তারা আছেন কি না জানি না, তারা ঐক্য বদল করে ঐক্যফ্রন্টে গেলেন। এখানে বি চৌধুরী ছিলেন, এখন কামাল হোসেন আছেন, আর সাথে আছে বিএনপি।’
আরাফাত বলেন, ‘আবার ২০ দল থেকে বলা হচ্ছে, ২০ দলের প্রতিনিধিত্ব করছে বিএনপি এবং সেটাকে তারা স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি বলছে- না, আমরা এককভাবে আছি, আমাদের সাথে ২০ দল নেই বা জামায়াত আমাদের সাথে আসেনি। যেহেতু ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য নেতা বলছেন আমরা জামায়াতের সাথে ঐক্য করব না। এটি একটি খুবই কনফিউশন, কনফিউস একটা সিচুয়েশনের মধ্যে আছে এখন পর্যন্ত। এটাকে আমি রাজনৈতিক মেরুকরণের এক ধরনের প্রক্রিয়ার বাহিরে ঐক্য, জাতীয় ঐক্যতো পরের কথা। ওই ধরনের কিছু এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।’
সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি ধরেন এমন হতো যুক্তফ্রন্টের সবাই আসতো, বাকি সবাই মিলে একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তাহলে কারো মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না। ২০ দলের মধ্যে সুনির্দিষ্ট একটি দল জামায়াতকে কেউ মানছে না। এই নিয়েও যদি কোনো সমস্যা না থাকত, তাহলে বলা যেত আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টির বাইরে একটি ঐক্য হয়েছে। কিন্তু বড় জোটটাতো এদিকে আছেই, মহাজোট। তার বাইরে যারা তারা কিন্তু এখনও একতাবদ্ধ হতে পারেনি। এ জন্য আমি মনে করি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে এখনও রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে আছে।