হাওর বার্তা ডেস্কঃ জীবন কখোনো কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবন বহতা নদীর মত। বয়ে চলে অবিরাম। নিরবধি। পেণ্ডুলামের মত ছকে বাঁধা নয়! আমার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সময়ে একদিন বাসা থেকে বের হবার সময় দেখতে হয়েছিলো আমার মায়ের রক্তাক্ত পায়ের আঙ্গুল। পরীক্ষার হলে যাবার জন্য মায়ের কাছে বলতে গিয়েছিলাম, মা আমি যাচ্ছি। মা ছিল রান্না ঘরে মাছ কাটায় ব্যস্ত। আমাকে বিদায় জানাতে উঠে দাঁড়াতেই মাছ কাটা বটি ঘুরে আমার মায়ের পায়ের আঙ্গুলে পড়ে।
নিমেষেই রান্নাঘর প্লাবিত হয়েছিলো আমার মায়ের রক্তে। ভীত সন্ত্রস্ত আমি থমকে গিয়েছিলাম। মায়ের পায়ের আঙ্গুল গুলো দেখা যাচ্ছিলো না। কেবল রক্ত– রক্ত আর রক্ত। আজীবন সংগ্রামী মা এতটুকু বিচলিত না হয়ে আমাকে বলেছিলো– “যাও দেরী হয়ে যাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় মত না গেলে তোমার জীবন থেকে একটা বছর পিছিয়ে যাবে। জীবনে পেছনে তাকাবার সুযোগ নাই। সামনে যাও। “সেদিনই জেনেছিলাম জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবন বহতা নদী। চলে গিয়েছিলাম পরীক্ষার হলে।
এরপর কলেজের গণ্ডি। যশোর সরকারি মহিলা কলেজ আমার ঠিকানা হলো। সে বছর ১৯৮৩ সাল জয়ন্তী কলেজ ছাড়ছে। আমার বোন এবং আমার জীবনের একমাত্র বন্ধু। আমি কেঁদেছিলাম। তখন কি জানতাম এ কান্না কেবল সাময়িক? সামনে আরো জমে আছে পাহাড়সম কান্না? সেদিনও মা বলেছিল- আজ কাঁদছো। কাল ঠিক হয়ে যাবে। সময় পার হয়ে যাবে। সময় কারো জন্য বসে থাকে না। ছাত্রাবস্থায় কলেজ জীবনটাই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময়। আসলেই – চোখের পলকে কেটে গিয়েছিলো কলেজ জীবন। নানা কাজের মাঝে। কেবল লেখা পড়াই না অনেক কিছুর সাথেই জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। তখন পুরোদমে শুরু হয়েছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন।
১৯৮৬ সালে বলতে গেলে এক প্রকার জোর করেই আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায় মা। ডেকে নেয় জয়ন্তী। কারণ ও তখন সেখানে পড়ছে সমাজকর্ম বিভাগে। আমি যেতে চাই নি। একে তো মা’কে ছেড়ে যাওয়া। আর যশোরের এই চমতকার মফস্বলীয় পরিবেশ আমাকে টানতো। ওদের একপ্রকার জোরাজুরিতেই রাজশাহী যাওয়া এবং শেষ অব্দি মা আর জয়ন্তীর ইচ্ছাতেই আইন বিভাগে ভর্তি হওয়া।
বরাবরই ঘরকুনো ছিলাম আমি। একটু গবেট মার্কা পড়ুয়া। পড়ার জোড়ে ভালো ফল। জয়ন্তী ডানপিটে। খুব সামাজিক। অপরের জন্যই নিবেদিত জীবন ছিলো ওর। আমরা পিঠাপিঠি দুই বোন। বন্ধু। আমার সব ভালো কাজের সাথী। চরম উৎসাহদাতা। নিজের অজশ্র গুণ থাকার পরও আমাকেই গুণী বলে মনে করা। তাই ওর সাথেই থাকা মন্নুজান হলে। আমাদের সময় চালু হোলো তাপসী রাবেয়া হল। কিন্তু আমি যেমন ওর পিছু ছাড়িনি ঠিক তেমনি ও আমাকে যেতে দেয়নি নতুন হল তাপসী রাবেয়াতে।
জয়ন্তী দুই বছরের বড় ছিলো আমার। তাই আমার আগেই ওর বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনার জীবন শেষ হলেও বছর খানেক কেন যে অতিরিক্ত ছিলো সে আর কে জানে না। আমি ভীতু টাইপের। জয়ন্তী অদম্য সাহসী। আবার ক্ষেত্র বিশেষে ও ভীতু। তখন আমার সাহস ওকে অনুপ্রেরণা দিতো। এমনি করেই কেটেছে আমাদের যৌথ জীবন।
স্কুল–কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে আমার যা কিছু অর্জন সব কিছুতেই জয়ন্তীর অবদান ছিলো। আর আমি? ছিলাম অনেকটা ওর ছায়া সঙ্গী– সেই শিশুকাল থেকেই!
কি অদ্ভুত আজ সেই ১৬ অক্টোবর। আজ প্রায় ১১ বছর পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ফোনে হঠাত করেই জয়ন্তীর কথা মনে করিয়ে দিলেন। ওর শ্বাসকষ্ট ছিলো! ২০০৭ এর এই দিনে জয়ন্তী আমাকে সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফোনে বলেছিলো, “যশোর যাচ্ছি। মা’র জন্য মন খারাপ লাগছে।”
আমি কি জানতাম সেদিন আমি যা বলেছিলাম ওকে সেকথাই অমোঘ বানীতে পরিণত হবে? ২০০৭ সাল। ঝিরঝিরে ব্রষ্টি দেখে বলেছিলাম, “যাস না। মনেহয় আর দেখা হবে না তোর সাথে।”
মানুষের জীবন বহতা নদীর মত। জয়ন্তীর চলে যাওয়া একটা কেবল মাত্রই একটি দেহয়াবসান নয়। আমার কাছে এটা একটা আন্দোলনের সূত্রপাত। সড়ক দুর্ঘটনাকে আমি আর দুর্ঘটনা মনে করতে পারলাম না। এটা একটি নিরাপদ – নির্মম- নিষ্ঠুর- অমানবিক – ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড বা খুন বলেই আসছি। যার বিচার হয় না।
২০০৭ এর ১৮ অক্টোবর সকাল এগারোটার পর যখন ফোনে জানলাম “জয়ন্তীর গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে ফরিদপুরে”! সড়ক বা মহা সড়কের কাছে, সড়কের যানবাহনের কাছে বা যানচালকের কাছে আমরা কতটা জিম্মি!
গাড়ির চালক ব্রেক ফেল করে রাস্তার ধারে খাদে জমে থাকা পানিতে গাড়ী ডুবিয়ে পালিয়েছে। অক্ষত গাড়ি থেকে একে একে সকলেই উদ্ধার হয়েছিলো কিন্তু কেউ লক্ষ্যই করেনি যে গাড়ির ভেতরে একজন জলজ্যান্ত মানুষ তার নিঃশ্বাস বন্দ হয়ে কষ্ট পাচ্ছে- মারা যাচ্ছে! যখন ওকে বের করে আনা হোলো তখন ও জয়ন্তীর শ্বাস প্রশ্বাস চলাচল করছে। কিন্তু ব্যর্থ ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেখানে পর্যাপ্ত না থাকায় ও শুধু বিদায় নিলো একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়েই। যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েই ওর শেষ কর্মস্থল ছিলো!
চলে গেলো একজন তুখোড় ছাত্র – একজন দুর্দান্ত জনপ্রিয় ছাত্রনেতা–স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সময়ের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা একটি অমিত সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ! জীবন পড়েছিলো মরণ সাথে নিয়ে ফরিদপুরের মহা সড়কের পাশে। এই অবেলায় অসময়ে চলে যাওয়া কে মেনে নিতে পারে?
মানুষের নির্দয়তা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একটি শিশু কন্যাকে প্রাণহীন মায়ের পাশে ফেলে “ড্রাইভার” নামের ঘাতক–খুনী পালিয়ে যায়। আহ!
জয়ন্তী চলে যাবার পর আমিও ভেবেছিলাম জীবন বোধকরি এখানেই থেমে গেলো। যায়নি। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবন এক বহতা নদীর নাম। জীবন চলমান। বার বার একই জায়গায় ঘড়ির কাটার মত ঘুরে ফিরে আসবে না। আসে না। ক্যালেন্ডারের পাতার মত উল্টাতেই থাকে। যতই পাতা উল্টাই ততই কমে আসে দিন। এভাবেই একদিন চলে যেতে হবে সকলকেই– ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
জীবনে চলতে চলতে আমরা প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুরে দাড়াই। আবার জীবন শুরু করি।
যা শুরু হোলো না সেটা হোলো সেটা কেবল – ন্যায় বিচার। আমি পাই নি আমার বোনের হত্যার বিচার। এমনি করে অনেকেই যারা হারিয়েছে নিকটজনকে- সড়কে – মহা সড়কে নিত্যদিন!
সেদিন এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা যখন বললেন যে, প্রতিটা জেলায়– প্রতিটা ডিসি অফিসে – প্রতিটা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যারা ডিসি অফিসে কর্মরত তাদের কাছে অসংখ্য ইউডি (আন ন্যাচুরাল ডেথ) যাকে আমরা বলি “অস্বাভাবিক ম্রত্যু” মামলার ফাইল অসমাপ্ত অবস্থায় ফাইল বন্দী হয়ে পড়ে আছে। যার কোনো শেষ নাই– পরিসমাপ্তি ঘটেনি যে সব মামলার। বিচার হয়নি যে সব হত্যাকাণ্ডের। বিচার ও নির্বাহী বিভাগ প্রথক হবার সুফল হলো এই যে, রাষ্ট্র বা আইন যে সব মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মনে করছে সেই সব মামলাই ডাম্পিং হচ্ছে ডি সি অফিসের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে।
এই অবস্থার অবসান কবে ঘটবে? কিভাবে?
আর কতদিন সড়ক হত্যাকাণ্ডের নাম থাকবে– সড়ক দুর্ঘটনা ? কতদিন আর শাজাহান খানের মত মন্ত্রীরা হেসে বা পদত্যাগ না করেই পার পেয়ে যাবে? কতদিন আমরা বিআরটিএ নামের এই খাদকের হাতে বন্দী থাকবো? কতদিনই বা অহেতুক গাড়ির কাগজ পত্র পরীক্ষার নামে আমাদের কে নাকানি চুবানি খেতে হবে ট্রাফিক পুলিশের কাছে? কতদিন এই ড্রাইভার নামের খুনীদের জয় জয়কার চলবে রাস্তা জুড়ে?
কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভে নয় বা কেবল ক্ষমতায় যাবার লোভে নয় আপনারা যারা জনপ্রতিনিধি তারা মানুষের কথা ভাবুন। দেশের কথা– জনগণের কথা ভাবুন। কেবল গুলি করে বা কূপিয়ে হত্যাই হত্যা নয়। যানবাহনের মালিক আর ড্রাইভাররা ষঢ়যন্ত্রীদের সাহায্যে পরষ্পর যোগসাযোসে যে মানুষগুলোকে মেরে ফেলছে এই সবই “হত্যা” যা ঘটছে জেনে – শুনে – বুঝে। বিচার করুন। বিচারের আওতায় আনুন। মানুষের জন্য আইন।
সুশাসন কি? রুল অব ল’ বা আইনের শাষন কাকে বলে? একবার ও কি যারা ক্ষমতায় ছিলেন বা যেতে চান অথবা আছেন তারা ভেবে দেখেছেন? খুনের, হত্যার প্রকার ভেদ আছে। সেই সব চিহ্নিত করুন। আইনের আওতায় আনুন। প্রতিটি জীবন ই অমূল্য সম্পদ এই কথাটা কেবল আপনার জন্য নয় সকলের জন্যই প্রযোজ্য!
শান্তিতে ঘুমা জয়ন্তী। আমার বোন। বন্ধু আমার।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী