হাওর বার্তা ডেস্কঃ যখন এই লেখাটি লিখতে বসেছি ঠিক তখন তেজী সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশটা কেমন যেন গুমোট পরিবেশে আবদ্ধ, বৃষ্টি হওয়ার পূর্বমুহূর্ত।
ছাত্র রাজনীতি! এ যেন এক বিভীষিকার নাম। যে বিভীষিকায় অযাচিত চাপ আছে, অবজ্ঞা আছে, অপমান আছে, অশ্রদ্ধা আছে! কোন ছেলে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলে সে নিশ্চিতভাবে বখাটে, চাঁদাবাজ নাহয় সন্ত্রাসী। বন্ধুবান্ধবের কাছে সে হাসির পাত্র, চুপিসারে কৌতুক গল্পের বিষয়বস্তু।
পাশাপাশি কোনো মেয়ে রাজনীতির ক্ষেত্রে পা বাড়ালে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন আরেক কাঠি সরেস হয়ে যায়। যে মেয়ে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাজনীতিতে আসে এবং ভূমিকা রাখতে চায়, সেই মেয়ে সমাজের চোখে হয়ে যায় বাউণ্ডুলে নাহয় শতভাগ বখে যাওয়া বালিকা! মান তো বাড়েই না, বরং শত অপমান এবং নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাকে মোকাবেলা কিংবা মানিয়ে নিয়ে তাকে সামনে এগোতে হয়।
আর চারপাশে থাকা পরম শ্রদ্ধেয়রা আড়চোখে তাকিয়ে ছাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের যেন বারবার এই জানান দিতে চায় যে তারা একেকজন ‘বাবার খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ উজবুক। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়কে তারা এড়িয়ে যান এবং প্রচন্ড অবজ্ঞা ও অবহেলার সাথে আমাদের নিরুৎসাহিত করতে থাকেন। এমনকি, বাবা, মা, পরিবারের সবার কাছে আমরা পরিতাজ্য বস্তু হয়ে উঠি! প্রচন্ড ভালোবেসেও হাজার ভৎসনা গ্রহণ করে ফিরে আসতে হয় প্রেমিকার কাছ থেকে।
আর আমরা যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত তাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিত্য নতুন আরোপিত শাস্তির ফর্দতো আছেই। কেননা তারা দেখেছে শান্তিপূর্ণ “ভ্যাট বিরোধী” আন্দোলনে ছাত্ররা কি অমিত শক্তি দিয়ে তাদের অধিকার আদায় করে নিয়েছিলো!
সবার একটাই কথা আমরা কেন বাংলাদেশের মত দেশে ছাত্ররাজনীতি করি? কেন?
আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় এত কিছুর পড়েও আমরা কেন ছাত্ররাজনীতি করি। আমরা কি ছাত্ররাজনীতি করে বস্তাবস্তা টাকা ইনকাম করি নাকি ক্ষমতার পারদ ছুঁয়ে হারিয়ে যাই বেহেস্তি সুখে! নাকি এটা দেশ গড়ার পথে নিজেকে বিসর্জন দেয়া কিংবা আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা বাদ দিয়ে সমষ্টির স্বার্থ চিন্তা করে নিজের মেধা, মনন ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ার ব্রত নিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। সত্যিই, আমি অনেক বেশি সন্দিহান!
জাতীয় কবি বলে গেছেন, এখন যারা তরুণ তাদেরই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপযুক্ত সময়।
সৃষ্টির শুরু থেকেই আমরা দেখে আসছি তরুণরাই একটা দেশের মূল চালিকা শক্তি, দেশ গড়ার মূল নিয়ামক বা কারিগর। ৪৭ এর দেশ ভাগ, ৫২ র ভাষা আন্দোলন, ৬৬ ছয় দফা, ৬৯ এর গন অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ র এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে তরুণরাই মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ছাত্ররাজনীতির হাত ধরে এবং জন্ম দেয় নতুন ইতিহাসের। এইতো মাত্র দশ বছর আগে আমরা দেখেছি, সেনা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধেও এদেশের ছাত্ররা, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে রাজপথে থেকে কিভাবে গণতন্ত্রকে ছিনিয়ে এনেছে বাংলার মানুষের আপামর এই জনসাধারণের জন্য।
তারপরেও আপনাদের হীন দৃষ্টিভঙ্গি কেন বদলায় না বলতে পারেন কি?
হ্যা, আমি মানছি ছাত্র রাজনীতি তাদের অতীত, ঐতিহ্য খানিকটা হারিয়ে ফেলেছে, কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা আছে। তাই বলে তো মাথা ব্যাথায় ওষুধ হিসেবে আমরা মাথা কেটে ফেলার মত বোকামি তো আর করতে পারি না, তাই না! পরিবর্তন তো আমাদের হাত ধরেই হতে হবে, কোন দৈব শক্তি এসে তো পরিবর্তন ঘটাবে না।
মাঝে মাঝেই আমি একটা কথা বলি, আপনার বাড়ির সামনে আবর্জনা পড়ে থাকলে আপনি কি করবেন প্রত্যেক দিন গন্ধ শুকতে শুকতে রাস্তা পার হবেন নাকি সেটা কিভাবে পরিষ্কার করা যায় সেটার কথা ভাববেন? নাকি ডাস্টবিনই তুলে দিবেন?
আমরা যারা ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত আমাদের অপরাধটা কি বলতে পারেন? আমরা রাজপথে থেকে অধিকার আদায়ের কথা বলি, এটাই আমাদের অপরাধ! আমরা দেশপ্রেমের মন্ত্র দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে চাই, এটাই আমাদের অপরাধ? আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভিত্তিক আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি এটাই আমাদের অপরাধ?
তাহলে আমরা অপরাধী, আমরা বখাটে, আমরা বাউণ্ডুলে! আলোর পথের যাত্রী হয়ে শত বাধা অতিক্রম করে দুর্বার গতিতে আমরা এগিয়ে যাবোই,সাধ্য কার রুখবে মোদের!
শেষ বেলায় কবির ভাষায় বলতে চাই- ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’।