হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে ২৫ সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড ফার্মাসিস্ট দিবস’ পালিত হয়। এবারের ফার্মাসিস্ট দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ফার্মাসিস্টই আপনার ওষুধ বিশেষজ্ঞ’ (Pharmacists : your medicines experts)। গত বছরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘ফার্মাসিস্টরা আপনার সেবায় নিয়োজিত’ (From research to health care : your pharmacist is at your service)। আমরা খুব ভালো করেই জানি, উন্নততর জীবনের জন্য, সমৃদ্ধ জাতির জন্য চাই সুস্থ ও সাবলীল মানুষ, চাই চেতনাস্নিগ্ধ আলোকিত ঋদ্ধ মানুষ। একটি সুন্দর সাবলীল জীবনের জন্য সুস্থ থাকা অনিবার্য। জীবনের অনন্ত চাহিদার মাঝে সুস্থতাই প্রথম চাওয়া। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা।
স্বাস্থ্যসেবাকে রাষ্ট্রের অন্যতম করণীয় হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত জননায়ক হিসেবে মানুষের এই আকাঙ্ক্ষাটি বাংলাদেশের সংবিধানে রূপদান করেছিলেন। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) অনুসারে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং অনুচ্ছেদ ১৮(১) অনুসারে জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
বর্তমানে দেশে জনগণ সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে তা পরিসর ও গুণগত মানের দিক থেকে আরো উন্নীত করা প্রয়োজন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-র মূলমন্ত্র ছিল ‘সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফার্মেসি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ফার্মেসিকে একটি পেশাগত বিষয় এবং ফার্মাসিস্টদের পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তার ও নার্সের ভূমিকা যেমন অপরিসীম, ঠিক তেমনিভাবে ওষুধের সংরক্ষণ, গুণগত মান, সঠিক ওষুধ নির্বাচন ও ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের ভূমিকাও অপরিহার্য।
গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা নিজেদের পেশাগত দক্ষতা দিয়ে ওষুধশিল্পে (উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্রণ, মানের নিশ্চয়তা বিধান, গবেষণা ও উন্নয়ন, বিপণন, উৎপাদন পরিকল্পনা, ডিসপেন্সিং, রেগুলেটরি অ্যাফেয়ারস, বিজনেজ ডেভেলপমেন্ট ও রপ্তানি) সরকারি সংস্থায়, বেসরকারি হাসপাতালে, কমিউনিটি ফার্মেসিতে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ওষুধশিল্পের বিকাশে আমূল পরিবর্তন। বর্তমানে দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশে উৎপাদন হচ্ছে এবং ১৮২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা দেশের বড় ওষুধ কম্পানিগুলোতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন।
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ওষুধের অপব্যবহার রোধ ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য দেশে মডেল ফার্মেসি চালু করা হয়েছে। মডেল ফার্মেসিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কর্তৃক ওষুধ সংরক্ষণ, ডিসপেন্স ও ওষুধ সম্পর্কে তথ্যাদি দেওয়ার পাশাপাশি ওষুধ সেবনবিধি সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছেন। বর্তমানে ২০০টির বেশি মডেল ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তাঁদের কর্মপরিবেশ ও দায়িত্ব পালনের জন্য ‘ফার্মেসি ইনচার্জ বা ফার্মেসি ম্যানেজার’ হিসেবে পদায়নের জন্য ফার্মেসি কাউন্সিল উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
এ ছাড়া এ দেশের কিছুসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতালে এরই মধ্যে উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা তথা ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে আসছেন। আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ ছাড়া গুণগত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়াই ওষুধ সংরক্ষণ, ডিসপেন্সিং ও ওষুধ বিতরণ করা হয়ে থাকে। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হাসপাতালে নিযুক্ত হলে এ দেশের হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও তাঁদের পদোন্নতির সুযোগ করে স্বাস্থ্যসেবাকে আরো উন্নতকরণের বিষয়টি এখন সময়ের দাবি। ২০০৭ সালের তথ্য অনুসারে দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৭৬০, যা বর্তমানে ১৩ হাজার ৪০০।
বর্তমানে ১২টি সরকারি ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর গড়ে চার হাজার ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল থেকে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছেন। তবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে না। আমরা জানি, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-র ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্যবিষয়ক মানবসম্পদ থেকে জ্ঞান ও দক্ষতার সর্বোচ্চ সুফল অর্জনের লক্ষ্যে সর্বস্তরের জন্য একটি সঠিক ও চাহিদাভিত্তিক মানবসম্পদ উন্নয়ন পদ্ধতি গড়ে তোলা এবং চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্য জনশক্তির সব স্তরে নিয়োগ, পদোন্নতি-পদায়ন ও বদলির নীতিমালা বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
তা ছাড়া জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬-র ৪.৩ অনুচ্ছেদে ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ৪.৩ অনুচ্ছেদের ‘ঙ’ উপ-অনুচ্ছেদে দেশে পর্যায়ক্রমে সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আন্ত বিভাগ ও বহির্বিভাগে ‘হসপিটাল ফার্মে’ (Hospital Pharmacy) কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের হসপিটালে কর্মরত ফার্মাসিস্টদের তুলনামূলক বিবরণী দেখা যাক। মালয়েশিয়ায় ফার্মাসিস্ট ও জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ১:২৩১৫, সিঙ্গাপুরে ১:২১৩০ ও ইংল্যান্ডে ১:১০০০। থাইল্যান্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে দুজন ফার্মাসিস্ট, ৩০ শয্যার বিপরীতে তিনজন ফার্মাসিস্ট, ৬০ শয্যার বিপরীতে তিনজন ফার্মাসিস্ট, ৯০-১২০ শয্যার বিপরীতে পাঁচজন ফার্মাসিস্ট।
এমতাবস্থায় দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে (জেলা হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ওষুধের নিরাপদ সংরক্ষণ, ওষুধের অপব্যবহার রোধ ও যৌক্তিক ব্যবহারে ফার্মাসিস্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক পর্যায়ে ওষুধ বিপণন ও ডিসপেন্সিং ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে সরকারি হাসপাতালগুলোতে উন্নততর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বহির্বিভাগ ফার্মেসিতে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ও আন্ত বিভাগে প্রতি ৫০ শয্যার বিপরীতে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগদান এবং নিয়োগকৃত ফার্মাসিস্টদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে জনশক্তির সব স্তরে পদোন্নতির লক্ষ্যে হসপিটাল ফার্মেসিতে নিম্নলিখিত পদবিন্যাস করা যেতে পারে : হাসপাতাল ফার্মেসিতে (Hospital Pharmacy) প্রস্তাবিত ফার্মাসিস্ট নিয়োগের পদবিন্যাস এভাবে করা যেতে পারে- ১. ফার্মাসিস্ট (ক্লিনিক্যাল)/ফার্মাসিস্ট (ফার্মেসি ইনচার্জ), ২. সিনিয়র ফার্মাসিস্ট (ক্লিনিক্যাল), ৩. উপপ্রধান ফার্মাসিস্ট, ৪. প্রধান ফার্মাসিস্ট।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্স-এই তিন শ্রেণির পেশাজীবী রয়েছেন। ডাক্তারদের জন্য স্বাস্থ্য এবং নার্সদের জন্য নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পৃথক দুটি অধিদপ্তর রয়েছে। এই অধিদপ্তর দুটির মাধ্যমে নিয়োগকৃত ডাক্তার ও নার্সদের সার্ভিস সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মূল্যায়নসহ যাবতীয় প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়।
এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত পদবিন্যাসের আলোকে হাসপাতালগুলোতে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ ও কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মতো ফার্মেসি সার্ভিসেস পরিদপ্তর বা অধিদপ্তর গঠন করে জেলা হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখনই উত্কৃষ্ট সময়। কেননা বাংলাদেশে এখন ১২ হাজার ৭৩৭ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট (এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশে কর্মরত), পাঁচ হাজার ৭০০ জন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট এবং ৫৫ হাজার সি প্রেড ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। এই দক্ষ জনগোষ্ঠীকে দেশের কাজে লাগাতে হলে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টদের বেশি বেশি করে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে সরকারি কাঠামোতে নিয়োগ দেওয়া খুবই জরুরি। গ্রিক চিকিৎসক গেলেনকে বলা হয় ‘ফাদার অব ফার্মাসিস্ট’। তিনি সেই সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফার্মাসিস্ট কতটা জরুরি।
লেখকদ্বয় : ফার্মেসি কাউন্সিলের বর্তমান ও সাবেক সহসভাপতি