হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৩ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা মন্তব্য করেন যে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, যা কিনা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শুরু করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন যে, তার সরকার বাংলাদেশের যেকোনো ভালো কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেবে। এর চারদিন পর শ্রিংলা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বলেন যে, ভারত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এবং শরণার্ধীদের ফেরত পাঠাতে সবসময় চেষ্টা করে যাবে, কারণ ভারত মনে করে যে বাংলাদেশের সমস্যা আসলে ভারতেরও সমস্যা। কক্সবাজারে তাঁর সফর নিয়ে শ্রিংলা বলেন, বাংলাদেশকে সমস্যা মোকাবিলায় ভারতের সহায়তা করতেই হবে; যেকারণে তিনি সেখানে গিয়েছেন এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। তিনি এই সমস্যার প্রতিটি পদেই ভারতের সাথে থাকার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি একইসাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ২০ হাজার কেরোসিন স্টোভ এবং ১১ লাখ লিটার কেরোসিন তেল বিতরণ করেন। এক বছর আগে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ৯’শ ৮১ মেট্রিক টন এবং এবছরের মে মাসে ৩’শ ৭৩ মেট্রিক টন ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করে। শ্রিংলা বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যায়। তবে দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ককে মূল্যায়ন করতে হলে শ্রিংলা যে কথাগুলি বলেন নি, সেগুলিও আলোচনায় আনা জরুরি।
রোহিঙ্গা শিবিরে শ্রিংলার যে এটা প্রথম সফর, তা সংবাদ মাধ্যমে তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়নি। শ্রিংলার আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি ও উপ-প্রধানমন্ত্রী, ডিসেম্বরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী, অক্টোবরে জর্ডানের রানী, এবছরের জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট, জুলাই মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট একত্রে, এবং একই মাসে মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়াও আরও অনেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন। তবে শ্রিংলা এই প্রথমবারের মতোই কক্সবাজারে যাবার জন্যে সময় করতে পেরেছেন।
গত বছরের আগস্টে ভারত সরকার ঘোষণা দেয় যে, মিয়ানমার থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভারত সরকার সেদেশ থেকে বের করে দেবার পরিকল্পনা করছে। এরপরে ১৮ই সেপ্টেম্বর ভারত সরকার সেদেশের সুপ্রিম কোর্টকে বলে যে, রোহিঙ্গারা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকিস্বরূপ।
এবছরের জানুয়ারি মাসে ভারতের আদালতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের করা এক পিটিশনে অভিযোগ করে বলা হয় যে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ সদস্যরা ‘চিলি স্প্রে’ এবং ‘স্টান গ্রেনেড’ ব্যবহার করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে চাইছে। জবাবে ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বলে, ভারত দুনিয়ার শরণার্থী রাজধানী হতে পারে না! যদি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো না হয়, তাহলে সারা দুনিয়ার সব দেশ থেকে শরণার্থীরা ভারতে আসতে থাকবে। নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের এহেন যুদ্ধংদেহী মনোভাব বলে দিচ্ছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ভারতের কতটুকু সমবেদনা রয়েছে; যদিও শ্রিংলা তার বক্তব্যে বাংলাদেশের পক্ষে অনেক কথাই বলেছেন।
অন্ততঃ এটা পরিষ্কার যে, শ্রিংলার ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে এক বছরের বেশি সময় কেনো লেগে গেলো। ক’দিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বিমসটেক সন্মেলনে ভারত রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কোনো কথা না বলে বরং মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে।
একই সাথে বাংলাদেশের সাথেও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট বিনিয়োগ করছে ভারত। হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যেদিন কক্সবাজারে গিয়েছেন, সেদিনই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারতকে চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়। এই অনুমতির মাধ্যমে বাংলাদেশের দুই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে পণ্য নেয়া যাবে। বাংলাদেশ সরকার চাইছে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে দুই দেশের মাঝে যে রেল যোগাযোগ ছিল, তা পুরোপুরি পুনর্বহাল করতে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ি পর্যন্ত রেল যোগাযোগ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে বাংলাদেশ থেকে ট্রেন দার্জিলিং যেতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর রেললাইন এবং আখাউড়া থেকে আগরতলা রেললাইনও এই লক্ষ্যের অধীনে চালু করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ভারত আশা করছে যে, এর মাধ্যমে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে আগরতলা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে ভারতের জন্যে নৌযোগাযোগ খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ, যার মাধ্যমে কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে মালামাল যাচ্ছে ত্রিপুরার আগরতলায়। দুই দেশের মাঝে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের লাভ যে তেমন একটা নেই, তা দুই দেশের বাণিজ্যের সংখ্যাগুলি দেখলেই বোঝা যায়।
দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ৯ বিলিয়ন ডলারের কাছে চলে গেলেও ভারতের কঠোর বাণিজ্যনীতির কারণে বাংলাদেশের বিপক্ষে বাণিজ্য ঘাটতি ৭ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। আবার বাংলাদেশের যেসকল প্রকল্পে ভারত ঋণ দিয়েছে, সেগুলিতে ব্যবহৃত বেশিরভাগ পণ্যই ভারত থেকে আমদানিতে চুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় অর্থায়নের এই প্রকল্পগুলি দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতিকে আরও বাড়াচ্ছে।
ভারতের আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করার জন্যে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ১০ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভারতের বহরমপুর থেকে অতিরিক্ত আরও ৫’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৬’শ ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে থাকে। এই আমদানি ৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উন্নীত করার পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক প্রকল্পেও ভারতীয় কোম্পানিগুলি সরবরাহক হিসেবে কাজ পেয়েছে। মোটকথা বাংলাদেশে ভারতীয়দের জন্যে ব্যবসার সুযোগ ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন, ট্রানজিট সুবিধা, জ্বালানি-বিদ্যুৎ-রেলগাড়ি আমদানি প্রকল্পের নিচে চাপা পড়ে গেছে তিস্তা চুক্তি এবং অভিন্ন নদীর পানিবন্টনের মতো গভীর সমস্যা। বিপজ্জনক নদী-সংযোগ প্রকল্প নিয়েও কথা চলছে ভারতে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হবার আগেই আসামের মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর পরিকল্পনাও শুরু হয়েছে। দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক কি শুধুই একপেশে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি সম্পর্কোন্নয়নের নতুন সংজ্ঞাই এটি?