হাওর বার্তা ডেস্কঃ অনেক স্বপ্ন নিয়ে বছর খানিক আগে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন সফুরা। সেখানে গিয়ে প্রথমে তিনি গৃহস্থালীর কাজ করেন। কিছু দিন পর নিয়োগ কর্তার আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান সফুরা। এক পর্যায়ে ওই নিয়োগকর্তা বাসার কাজের ফাঁকে তাকে ‘খারাপ’ কাজে বাধ্য করতেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। রাজি না হলেই তার ওপর চলতো শারীরিক নির্যাতন। এভাবেই এক সময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ওই নিয়োগকর্তা তাকে গর্ভপাত করায়। গৃহকর্তার এই নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেখানকার পুলিশের কাছে ধরা দেন তিনি।
দীর্ঘ দুর্বিষহ জীবনের নির্মম এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া আটটায় ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ইওয়াই ২৫৮ ফ্লাইটে ঢাকার শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান সফুরা। একই ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন অন্তত ৭৮ জন নারী শ্রমিক। দেশে ফিরে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন নারী শ্রমিকরা। বিমানবন্দরে কথা হয় সৌদি ফেরত এই নারী শ্রমিক সফুরার সঙ্গে।
সফুরা বলেন, ‘কী যে খারাপ খারাপ কাজ করতো তারা। রাজি না হইলেই ইচ্ছামতো মারতো। একবার অসুস্থ হইয়া পড়ায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে জানতে পারি, আমার প্যাটে তিন মাসের বাচ্চা। পরে কফিল (নিয়োগকর্তা) ওষুধ খাওয়ায়ে বাচ্চা ফালায় দেয়। এরপর আবারও অত্যাচার করতো আমারে। এক মাস আগে আমি কফিলের বাড়ির থেইক্যা পালায়ে পুলিশের কাছে ধরা দেই। পুলিশ আমারে প্রায় সপ্তাহখানেক জেলে রাখে। এরপর সফর জেলে (ডিপোর্ট সেন্টারে) দিয়া দেয়। সেখান থেকে আজকে আমারে দেশে পাঠাইসে। আমারে যেই কোম্পানি পাঠায়সিল আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করমু।’
সফুরার মতো ৪০ বছর বয়সী বিধবা ফরিজাও অনেক আশা নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়েকে ভালোভাবে মানুষ করবেন এই আশা নিয়েই সেখানে পাড়ি জমান। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে টাকার বিনিময়ে এক দালালের কাছ থেকে ট্রেনিং কার্ড (বিএমইটি কার্ড) নিয়ে সৌদি আরব যান তিনি। কথঅ ছিল, এক বাড়িতে গৃহস্থালীর কাজ করবেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দুই বাড়িতে কাজ করেছেন তিনি। প্রথম মালিকের বাড়িতে দুই মাসের বেতন পেলেও পরে আর কোনও বেতন দেওয়া হতো না।
ফরিজা বলেন, ‘আমার স্বামী নাই। একটা মেয়ে আছে। তার জন্য আমি গেছিলাম সৌদি আরব। দালাল আমারে টাকা দিয়া ট্রেইনিং কার্ড কইরা দিছে। আমার যাওয়া লাগে নাই। ১২০০ টাকা (সৌদি রিয়াল) বেতনের কথা কইছিল। সেখানে গিয়া প্রথম দুই মাস ৯০০ টাকা পাইছি। ওইখান থেকে পরে আমারে অন্য বাসায় পাঠায়। সেখানে কাজ করছি পাঁচ মাস। কিন্তু বেতন সব রাইখা দিছে। বেতনের কথা কইলে ম্যাডাম আমারে মারতো। আমি আরবি ভাষায় তাদের কাছে কইতাম—আমার বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা। কেউ শুনতো না, খালি মারতো।’
চার মাস আগে উন্নত জীবনের আশায় সৌদি আরব গিয়েছিলেন সাবিনা। ভাল কাজের জন্য দালালকে ৪০ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কথা ছিল তিনি কাজ করবেন ফলের ফ্যাক্টরিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাকে বাসাবাড়ির কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাবিনা অভিযোগ করে বলেন, ‘কাজ করতে না চাওয়ায় আমাকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ভাঙা গ্লাস দিয়ে পা কেটে দেওয়া হয়েছে।’
তিন মাস আগে সৌদি আরবে গিয়ে দুই মাস ‘সফর’ জেলে কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন জাহানুর। তিনি এর আগে মিশরে কাজ করেছেন। কিন্তু সেদেশের অভিজ্ঞতা আর সৌদি আরবের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মালিকের কথা না শোনায় তাকে মক্তবে (অফিসে) দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। সেখানে জাহানুরকে বলা হতো— বাংলাদেশ থেকে তাকে কিনে নেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘মক্তবে মেয়েদের বুকে হাত দিয়ে মারা হয়। সেখানে বাংলাদেশি যারা আছেন, তারা পরামর্শ দিতেন—এদেশে আর আইসেন না!
উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখা সৌদি আরব ফেরত এই নারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা বাংলাদেশের মেয়েদের সৌদি আরবে না পাঠাতে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে করজোড়ে অনুরোধ জানান। তারা আরও বলেন, সৌদি আরবে নিয়োগকর্তার বাসায় পরিষ্কার জায়গায় থাকতে দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের অনেককেই থাকতে হতো রান্নাঘরে। খাবার হিসেবে তারা পেতেন রুটি আর পানি। শারীরিক নির্যাতন, বাসস্থান ও খাবারের সমস্যা, বেতন না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কেউ দুই বছর, কেউ একবছর, কেউ তিন-চার মাস, আবার কেউবা একমাসের মাথায় ফেরত চলে আসছেন সেদেশ থেকে।
এছাড়া, সেদেশের মক্তবে (নিয়োগকর্তার রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস) নিয়েও নারী শ্রমিকদের ইচ্ছামতো শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন তারা। এর মধ্যে আব্দুল্লাহর মক্তবে সবচেয়ে বেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা। তারা এও বলেছেন, সেখানে আরও ৫০-৬০ জন বাংলাদেশি নারী শ্রমিক বর্তমানে অবস্থান করছেন। তাদের ওপর বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নারী শ্রমিক যায়। আবার নানা কারণে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগে সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি নারী ফেরত আসেন। তবে কোনও সংস্থা কিংবা মন্ত্রণালয়, কারও কাছে এই ফেরত আসা শ্রমিকের বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য নেই।
বিমানবন্দরের প্রবাস কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,এই বছরের ৩ মে ৩৫ জন, ১২ মে ২৭ জন, ১৯ মে ৬৬ জন, ২৩ মে ২১ জন, ২৭ মে ৪০ জন এবং ৩ জুন ২৯ জন,১৮ জুন ১৬ জন এবং ১৯ জুন ২৭ জন এবং ২৬ জুন ২২ জন, ১০ জুলাই ৪২ জন, ২১ জুলাই ৩৪ জন, ২৮ জুলাই ৪২ জন, ৩ আগস্ট ২৮ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। তবে এর বাইরেও আরও নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যম হতে জানা যায়।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে কাজের জন্য যাচ্ছেন বাংলাদেশি নারীরা।
জনশক্তি,কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট অভিবাসনের ১৩ শতাংশ এবং এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একা অভিবাসন প্রত্যাশী নারী শ্রমিককে অভিবাসনে যেতে বাধা দেওয়া হলেও ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে তা কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে। তবে ২০১৬ সালে অভিবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা নেমে আসে ১৬ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে ১৩ শতাংশে।