ঢাকা ০৫:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাতিসংঘ অধিবেশনে সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান সন্ত্রাস চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৫৮:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর ২০১৫
  • ২৯৯ বার

বিশ্ব এখন সবচেয়ে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এর প্রথমটি হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে এটি প্রধান অন্তরায়। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি জলবায়ুজনিত পরিবর্তনও উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বুধবার নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে বাংলায় দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। এসময় তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আজ আমরা সবচেয়ে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি; যার প্রথমটি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদ। বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে এটি প্রধান অন্তরায়। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজে সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদের শিকার। আমার পিতা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই এবং অন্য নিকটাত্মীয়দের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি নিজেও কমপক্ষে ১৯ বার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। আমার সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস জঙ্গিবাদ এবং মৌলবাদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে বিশ্বাসী। বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত রয়েছে; সেসব চরমপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মোকাবিলায় আমরা সদাতৎপর।

টেকসই উন্নয়নের জন্য বছরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলন এবং নিউইয়র্কে সদ্যসমাপ্ত ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলন গোটা বিশ্বের জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। আগামী মাসে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলন হবে। ওই সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তি কার্যকর হবে জানিয়ে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি মারাত্মক উন্নয়ন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা এগিয়ে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমাদের সামনে সামান্যই সুযোগ অবশিষ্ট আছে। এ বিশ্বকে নিরাপদ, আরও সবুজ এবং আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে আমাদের অবশ্যই সফল হতে হবে।

২০১৬ সালে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (জিএফএমডি) নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেকসই ?উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সার্ক, বিমসটেক, বিসিআইএম-ইসির মতো আঞ্চলিক সংস্থা প্রতিষ্ঠায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য আমরা অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, অভিবাসন এবং মানব চলাচল আজ নতুনভাবে ইতিহাস ও ভৌগোলিক পরিসীমা নির্ধারণে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০৩০ উন্নয়ন এজেন্ডায় উন্নয়নের জন্য অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপযোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অভিবাসনের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। এ লক্ষ্য সামনে রেখে, উৎস এবং গন্তব্য দেশ হিসেবে জিএফএমডির নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিগত প্রায় ১৫ বছর যাবত বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার এটি বৃহদাংশ এবং এর বাস্তবায়ন এমডিজিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমডিজির সার্বিক অগ্রগতি আমাদের আরও বৃহদাকার, বলিষ্ঠ ও উচ্চাভিলাষী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে অনুপ্রাণিত করেছে। এমডিজিতে যে উচ্চাশা প্রতিফলিত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে আমাদের সরকারি ও ব্যক্তিখাতসহ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক তহবিলের জোগান অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য উন্নত দেশগুলোর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের জিএনআইয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ ওডিএ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রদান জরুরি। পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার ও বিস্তার এবং অভিযোজনের যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। এ ধরনের প্রযুক্তি ও সক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া অনেক উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন অনার্জিত থেকে যাবে বলে আমার আশঙ্কা।

তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে শান্তিরক্ষা এবং শান্তি নির্মাণ জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম প্রধান শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গর্বিত। এ পর্যন্ত আমাদের সাহসী শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বের ৪০ দেশের ৫৪টি মিশনে নিয়োজিত হয়েছেন। আমরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী পুলিশ সদস্য নিয়োজিত করার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, চার দশকেরও বেশি আগে, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার প্রথম বক্তৃতায় ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বঞ্চনা ও আগ্রাসনমুক্ত একটি বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার’ স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সেই উদাত্ত আহ্বান আজও আমাদের জাতীয় উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে সম্পৃক্ততার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বর্তমানে এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগোচ্ছি যেখানে দারিদ্র্য, অসমতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এর আগে আমি ‘রূপকল্প-২০২১’ উপস্থাপন করেছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা একটি মধ্যম-আয়ের, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি অর্থাৎ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে চাই।

বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সীমিত সম্পদ দ্বারা বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম দারিদ্র্য হ্রাসকারী দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছি। দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালে যেখানে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে এমডিজি-১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ অর্জন করেছে অথবা অর্জনের ক্ষেত্রে সঠিক পথেই এগোচ্ছে। বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও গত ছয় বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রেরণের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় সাড়ে ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে চলতি অর্থবছরে ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ইউএনডিপির নিম্ন মানবসম্পদ উন্নয়নের দেশ থেকে মধ্যম সারিতে উন্নীত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।

বিপুল সংখ্যক যুব সম্প্রদায়কে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য বিনিয়োগ করা হলে তা ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এজন্য আমার সরকার শিক্ষা এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। মেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বছরের প্রথম দিনই আমরা সারা দেশে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ৩২৬ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। তিনি জানান, গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। উৎপাদনমুখী সম্পদে নারীর প্রবেশাধিকার এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে। অটিজম ও অন্যান্য বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে জাতিসংঘে আমরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছি।

এসডিজি ফ্রেমওয়ার্ককে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বর্তমানে ২০১৬-২০২০ মেয়াদি নতুন জাতীয় পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি টেকসই, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে আকাক্সক্ষা সেখানে কেউ যাতে পিছিয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। সমাজে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত না হলে আমরা টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত করতে পারব না। এজন্য আমরা শান্তি সমুন্নত রাখতে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর।

সম্প্রতি আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল ও সমুদ্রসীমা সমস্যা সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান কূটনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩১ জুলাই মধ্যরাতে আমরা ভারতের সঙ্গে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় করেছি, যার মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার রাষ্ট্রবিহীন ছিটমহলবাসী তাদের পছন্দের রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পেরেছেন। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে করার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাছে কূটনৈতিক সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। তিনি বলেন, একই চেতনায় আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের সামষ্টিক অঙ্গীকার অনুযায়ী এমন একটি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও উন্নত বিশ্ব গড়ে তুলি; যেখানে দারিদ্র্য এবং অসমতা, সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘাত, বিদ্বেষ ও বৈষম্য থাকবে না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জাতিসংঘ অধিবেশনে সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান সন্ত্রাস চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ

আপডেট টাইম : ০৬:৫৮:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর ২০১৫

বিশ্ব এখন সবচেয়ে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এর প্রথমটি হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে এটি প্রধান অন্তরায়। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি জলবায়ুজনিত পরিবর্তনও উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বুধবার নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে বাংলায় দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। এসময় তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আজ আমরা সবচেয়ে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি; যার প্রথমটি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদ। বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে এটি প্রধান অন্তরায়। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজে সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদের শিকার। আমার পিতা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই এবং অন্য নিকটাত্মীয়দের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি নিজেও কমপক্ষে ১৯ বার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। আমার সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস জঙ্গিবাদ এবং মৌলবাদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে বিশ্বাসী। বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত রয়েছে; সেসব চরমপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মোকাবিলায় আমরা সদাতৎপর।

টেকসই উন্নয়নের জন্য বছরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলন এবং নিউইয়র্কে সদ্যসমাপ্ত ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলন গোটা বিশ্বের জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। আগামী মাসে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলন হবে। ওই সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তি কার্যকর হবে জানিয়ে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি মারাত্মক উন্নয়ন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা এগিয়ে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমাদের সামনে সামান্যই সুযোগ অবশিষ্ট আছে। এ বিশ্বকে নিরাপদ, আরও সবুজ এবং আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে আমাদের অবশ্যই সফল হতে হবে।

২০১৬ সালে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (জিএফএমডি) নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেকসই ?উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সার্ক, বিমসটেক, বিসিআইএম-ইসির মতো আঞ্চলিক সংস্থা প্রতিষ্ঠায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য আমরা অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, অভিবাসন এবং মানব চলাচল আজ নতুনভাবে ইতিহাস ও ভৌগোলিক পরিসীমা নির্ধারণে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০৩০ উন্নয়ন এজেন্ডায় উন্নয়নের জন্য অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপযোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অভিবাসনের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। এ লক্ষ্য সামনে রেখে, উৎস এবং গন্তব্য দেশ হিসেবে জিএফএমডির নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিগত প্রায় ১৫ বছর যাবত বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার এটি বৃহদাংশ এবং এর বাস্তবায়ন এমডিজিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমডিজির সার্বিক অগ্রগতি আমাদের আরও বৃহদাকার, বলিষ্ঠ ও উচ্চাভিলাষী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে অনুপ্রাণিত করেছে। এমডিজিতে যে উচ্চাশা প্রতিফলিত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে আমাদের সরকারি ও ব্যক্তিখাতসহ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক তহবিলের জোগান অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য উন্নত দেশগুলোর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের জিএনআইয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ ওডিএ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রদান জরুরি। পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার ও বিস্তার এবং অভিযোজনের যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। এ ধরনের প্রযুক্তি ও সক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া অনেক উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন অনার্জিত থেকে যাবে বলে আমার আশঙ্কা।

তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে শান্তিরক্ষা এবং শান্তি নির্মাণ জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম প্রধান শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গর্বিত। এ পর্যন্ত আমাদের সাহসী শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বের ৪০ দেশের ৫৪টি মিশনে নিয়োজিত হয়েছেন। আমরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী পুলিশ সদস্য নিয়োজিত করার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, চার দশকেরও বেশি আগে, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার প্রথম বক্তৃতায় ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বঞ্চনা ও আগ্রাসনমুক্ত একটি বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার’ স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সেই উদাত্ত আহ্বান আজও আমাদের জাতীয় উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে সম্পৃক্ততার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বর্তমানে এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগোচ্ছি যেখানে দারিদ্র্য, অসমতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এর আগে আমি ‘রূপকল্প-২০২১’ উপস্থাপন করেছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা একটি মধ্যম-আয়ের, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি অর্থাৎ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে চাই।

বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সীমিত সম্পদ দ্বারা বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম দারিদ্র্য হ্রাসকারী দেশ হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছি। দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালে যেখানে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে এমডিজি-১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ অর্জন করেছে অথবা অর্জনের ক্ষেত্রে সঠিক পথেই এগোচ্ছে। বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও গত ছয় বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রেরণের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় সাড়ে ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে চলতি অর্থবছরে ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ইউএনডিপির নিম্ন মানবসম্পদ উন্নয়নের দেশ থেকে মধ্যম সারিতে উন্নীত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।

বিপুল সংখ্যক যুব সম্প্রদায়কে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য বিনিয়োগ করা হলে তা ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এজন্য আমার সরকার শিক্ষা এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। মেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বছরের প্রথম দিনই আমরা সারা দেশে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ৩২৬ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। তিনি জানান, গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। উৎপাদনমুখী সম্পদে নারীর প্রবেশাধিকার এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে। অটিজম ও অন্যান্য বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে জাতিসংঘে আমরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছি।

এসডিজি ফ্রেমওয়ার্ককে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বর্তমানে ২০১৬-২০২০ মেয়াদি নতুন জাতীয় পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি টেকসই, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে আকাক্সক্ষা সেখানে কেউ যাতে পিছিয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। সমাজে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত না হলে আমরা টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত করতে পারব না। এজন্য আমরা শান্তি সমুন্নত রাখতে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর।

সম্প্রতি আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল ও সমুদ্রসীমা সমস্যা সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান কূটনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩১ জুলাই মধ্যরাতে আমরা ভারতের সঙ্গে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় করেছি, যার মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার রাষ্ট্রবিহীন ছিটমহলবাসী তাদের পছন্দের রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পেরেছেন। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে করার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাছে কূটনৈতিক সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। তিনি বলেন, একই চেতনায় আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের সামষ্টিক অঙ্গীকার অনুযায়ী এমন একটি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও উন্নত বিশ্ব গড়ে তুলি; যেখানে দারিদ্র্য এবং অসমতা, সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘাত, বিদ্বেষ ও বৈষম্য থাকবে না।