হাওর বার্তা ডেস্কঃ রংপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সদ্যপুষ্করণী ইউনিয়নের অজপাড়াগাঁ নয়াপুকুর। গ্রামের খেলার মাঠে বিরল একটি দৃশ্য অনেককে অবাক করবে—ফুটবল খেলছে গ্রামের মেয়েরা। শুধু খেলছে না, ফুটবলের কলাকৌশল রপ্ত করছে তারা কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। এরা সবাই ‘নয়াপুকুর সাজানো বাগান ফুটবল একাডেমি’র শিক্ষার্থী। অবাক করা ব্যাপারই বটে—নিভৃত এক গ্রামে মেয়েদের জন্য ফুটবল একাডেমি। সেটাও স্থানীয় লোকজনের গড়ে তোলা। গ্রামের খেটে খাওয়া হতদরিদ্র কৃষকেরা নিজেরা অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই ফুটবল একাডেমি।
আর হবে না-ই বা কেন, পুরো গ্রামটিই যে মেয়েদের ফুটবলের গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই গ্রামের মেয়েরা এখন খেলছে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে। ইতিমধ্যে দেশের বাইরেও খেলেছে তারা। ফুটবল একাডেমির ব্যবস্থাপক এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য জাকির হোসেন বলেন, ‘গ্রামের সাধারণ মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের ফুটবলে সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে আরও অনেক দূরে যেতে চাই আমরা।’
শুরুটা করেছিল গ্রামের পালিচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্ট চালু হলে এই স্কুল থেকে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি টিম। সেই টিম রংপুর বিভাগে তো চ্যাম্পিয়ন হয়েছেই, জাতীয় পর্যায়ে গিয়েও একবার রানার্সআপ, পরেরবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
সেটা ২০১১ সালের কথা। সেই থেকে গ্রামে ফুটবলের বাতাস। গ্রামের ২১ কিশোরী এখন নিয়মিত ফুটবল খেলে। গত মঙ্গলবার বিকেলে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পালিচড়া এম এস উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের মাঠে একাডেমির অনুশীলনের প্রস্তুতি চলছে। খেলোয়াড়দের বয়স ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। কেউ পায়ে বুট পরছে। কেউ গায়ে জড়াচ্ছে জার্সি। কারও আবার খালি পা। অনুশীলনের জন্য মাঠে চিহ্ন (মার্কার) বসানো হয়েছে। এসব চিহ্নের ফাঁকফোকর দিয়ে বল আদান-প্রদান চলছে। আবার কখনো চলছে ফুটবল হাতে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শারীরিক কসরত। দীর্ঘ শ্রমসাধ্য অনুশীলন।
অনুশীলনের ফাঁকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিশরাত জাহান ময়ূরী বলে, ‘আমার নেতৃত্বেই ২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে রংপুর বিভাগ রানার্সআপ হয়েছে। পরের বছরই দেশসেরা হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমাদের এই গ্রাম থেকে পাঁচজন মেয়ে দেশের বাইরে খেলে সুনাম কুড়িয়েছে। পুরো গ্রামজুড়ে এখন ফুটবলের আলোচনা।’
চতুর্থ শ্রেণির স্নেহা আক্তার বলে, ‘টিভিতে আমাদের গ্রামের মেয়েদের খেলা দেখে মা-বাবার ইচ্ছায় ফুটবলে নেমেছি। আমিও ওদের মতো একদিন বিদেশে খেলব। ছিনিয়ে আনব জয়।’
অভিভাবকসহ গ্রামের লোকজন মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহিত করেন খেলোয়াড়দের।
রেখা আক্তারের বাবা কৃষক বুলবুল আহমেদ বললেন, ‘হামার অ্যাটে (আমাদের এখানে) মেয়েমানুষের ফুটবল খেলা নিয়া কোনো বিরোধ নাই। কষ্ট থাকলেও ছাওয়াগুলা প্রতিদিন ফুটবল প্রশিক্ষণ নেয়।’
এ বছর দেশের বাইরে তাজিকিস্তানে এএফসি-অনূর্ধ্ব ১৪ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ দল ভারতকে ৯-০ গোলে হারিয়ে শিরোপাজয়ী হয়। এই জয়ী দলে এ গ্রামেরই তিনজন খেলেছে। এরা হলো লাবণী আক্তার, আর্শিতা জাহান ও আঁখি আক্তার। এর আগে দেশের বাইরে নেপালে খেলেছে সিরাজ জাহান স্বপ্না। মৌসুমী আক্তার খেলেছে পাকিস্তানে। ২০১১-১২ সালে পরপর দুই বছর সেরা খেলোয়াড় হয়ে গোল্ডেন বুট জিতেছে এ গ্রামেরই রোকসানা পারভীন। সে এখন ঢাকায় বিজিএমসিতে খেলছে।
অনুশীলন করা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জয়নব বেগমের বাবা কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘দেখতে দেখতে পাঁচটা ছাওয়া (সন্তান) বিদেশোত খেলে আসিল। ওরা এলা (এখন) ঢাকাত খেলায়। এই বয়সে টাকাও পাঠায় বাড়িত।’
খেলার মাঠের পাশে গ্রামের মানুষের উদ্যোগে একটি পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে ড্রেসিং রুম থাকবে। খেলা নিয়ে বৈঠক হবে। প্রশিক্ষণ চলবে। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে এ মুহূর্তে ঘর নির্মাণ থেমে আছে বলে জানা যায়। তবে থেমে নেই অনুশীলন।
পালিচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল দলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বহুদূর নিয়ে গিয়েছিলেন রংপুরের বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়াড় হারুন-আর-রশিদ। একাডেমির প্রশিক্ষণের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। হারুন-আর-রশিদ বলেন, ‘সকাল-বিকেল পরিশ্রম করে এই দলকে অনেক কষ্ট করে গড়ে তুলেছি। প্রতিদিন শহর থেকে গ্রামে ছুটে গিয়েছি। অনেকেই ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। আবার অনেকের ঢাকার ক্লাবে খেলার জন্য ডাক এসেছে। এই গ্রামে মেয়েদের ফুটবলে অনেক আগ্রহ। তাইতো অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই গ্রাম থেকে একদিন পুরো দলই হয়তো দেশের বাইরে খেলবে।’
প্রশিক্ষক হারুন-অর-রশিদের সহকারী হিসেবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ওই গ্রামের মিলন খান নামের এক কিশোর। ভালো লাগা থেকে বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সে। মিলন বলে, ‘হারুন স্যারের অনুপস্থিতিতে আমি মেয়েদের নিয়ে প্রতিদিনই মাঠে থাকি। প্রশিক্ষণের কাজটি কোনো রকমে চালিয়ে যাই।’
সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসিমা জামান ববি বললেন, ‘ছোট ছোট মেয়েদের এমন খেলা দেখে আমি প্রায়ই সেখানে ছুটে যাই। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে উৎসাহিত করি।’
সূত্র: প্রথম আলো