হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরে এখন ধান খেতে সবুজের দোল। মাঠের পর মাঠ বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ধান খেত আদিগন্ত সবুজ হয়ে আছে। বেড়ে উঠছে বছরের একমাত্র ফসল, ইরি বোরো। আর এক থেকে দেড় মাস পরই এ মাঠ হয়ে উঠবে পাকা ধানের রঙে সোনালি। এবার ধানের সবুজ রংই বলে দিচ্ছে কৃষকের ফসল ভালো হওয়ার সম্ভাবনার কথা। তবে সোনালি ধানের স্বপ্নে মত্ত কৃষকের বুকে আশঙ্কা, সত্যিই কি এ সোনার ফসল ঘরে উঠবে? নাকি ডুবে যাবে অকাল বন্যায়, পাহাড়ি ঢলে?
কিশোরগঞ্জ মিঠামইন উপজেলার চারিগ্রামের সাদেক আলী জানান, গত বছর তার প্রায় আড়াই একর জমির ধান তলিয়ে যায় পানির নিচে। একটা ধানও সে ঘরে তুলতে পারেনি। এ অবস্থা হাওরের প্রতিটি কৃষকের। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালেও কৃষক সম্পূর্ণ ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। নির্ধারিত সময়ের আগেই পানিতে তলিয়ে যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির পাকা ফসল। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, মিঠামইন, ইটনাসহ বিভিন্ন হাওর এলাকার কৃষকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল নয়নভাগার।
‘নয়নভাগা’ শব্দটা সুন্দর হলেও এতে যে কী পরিমাণ কষ্ট ও প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতা জড়িয়ে আছে তা হাওরের মানুষমাত্রই জানেন। সকল হাওরঞ্চলের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সেখানে ধান রোপণ ও ধান কাটার দুই মৌসুমে দুই ধরনের খেতমজুর কাজ করে। যে শ্রেণীর মজুর ধান রোপণের সময় কাজ করে তাদের বলে ‘জিরাতি’। আর যে শ্রেণীর মজুর ধান কাটার কাজ করে তাদের বলে ‘দাওয়ালি’ বা ‘ভাগালি’। এই খেতমজুররা সাধারণত হাওরঞ্চলের বাইরে থেকে আসে। অসময়ে পানি চলে এলে খেতমজুরদের পাওয়া যায় না। খুব দ্রুত পানিতে তলিয়ে যায় ফসল। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসল যে কেউ কেটে নিয়ে যেতে পারে। ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক বা শ্রমিকরা তখন যতটা পারে ডুব দিয়ে পানির তল থেকে ফসল তুলে নিয়ে আসে। এ প্রক্রিয়াটাকে বলে ‘নয়নভাগা’।
হাওরের এই সমস্যা নতুন নয়। প্রায় প্রতি বছরই কৃষক আশঙ্কায় থাকে ফসল নিয়ে। এ অঞ্চলের কৃষক সাধারণত ব্রি ২৮ বা ২৯ জাতের ধান চাষ করে। ব্রি ২৮-এর জীবনকাল ১৪০ দিন, অন্যদিকে ব্রি ২৯-এর জীবনকাল ১৬০ দিন। কৃষক ব্রি ২৮-এর চেয়ে ব্রি ২৯ চাষ করতে বেশি আগ্রহী। কারণ এর ফলন বেশি। কিন্তু ব্রি ২৯-এর ফসল ঘরে তুলতে তুলতে লেগে যায় মে মাসের মাঝামাঝি সময়। আর হাওরঞ্চলে এই সময়ে পানি চলে আসে। ফলে কৃষকের জমি ফসলসমেত তলিয়ে যায় পানিতে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (IRRI) মহাপরিচালক ম্যাথিউ মোরেল পরিদর্শনে আসেন।
তিনি জানান, হাওরের উপযোগী ধানের জাত উদ্ভাবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সব ঠিকঠাকমতো চললে বছর দুয়েকের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হবে। ইরির গবেষক ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন প্লটে ২৭১টি লাইনের গবেষণা চলছে। সেখানে ইরি, ব্রি এবং নেপাল থেকে আনা বিভিন্ন জাতের মধ্যে ক্রস করা হয়েছে। সফল হলে দু-তিন বছরের মধ্যেই একটা স্বল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল জাতের ধান পাওয়া যাবে।
একটা সময় বলা হতো আমাদের দেশ আউশের দেশ। ‘আউশ’ শব্দটাই এসেছে ‘আশু’ থেকে। মানে স্বল্পমেয়াদি ধান ছিল আউশ। শুনেছি দুই মাস অর্থাৎ ৬০ দিনে ফসল তোলা যায় এমন জাতের ধানও আমাদের ছিল। কিন্তু সেসব জাত উচ্চফলনশীল ছিল না। আবার আউশ যে তাপমাত্রায় চাষ হয়, তা বোরো মৌসুমে সম্ভব কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। কৃষকের স্বল্প সময়ের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল ধানের জাতের প্রয়োজন। আমাদের হাওরের জন্য উপযোগী একটা ধান মডার্ন রাইস ব্রিডিং টেকনোলজি, জিনোম এডিটিং টেকনোলজি এসব ব্যবহার করে হাওরের জন্য উপযোগী জলমগ্নতাসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ধানের জাত তৈরি এখন সময়ের দাবি। হাওরের নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে আছে। পাহাড়ি ঢল দূরে থাক, অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই নদী উপচে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে ফসলের মাঠ। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কৃষক।
আমরা প্রতিনিয়ত নষ্ট করে চলেছি পরিবেশের স্বাভাবিকতা। আর তারই প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে হাওরঞ্চলের সাধারণ কৃষক। হাওরঞ্চলের কৃষিকে বাঁচাতে সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে হাওরঞ্চলের কৃষকের কী করণীয়? নতুন জাত উদ্ভাবন না হওয়া অবধি কৃষককে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে ব্রি ২৯ চাষ করলেও, নিচু জমিতে অবশ্যই ব্রি ২৮ চাষ করতে হবে। হাওরের ধান নিয়ে গবেষকদের বহুমাত্রিক গবেষণার প্রয়োজন।
পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারের কৃষিবিষয়ক দফতরগুলোর আরও বেশি সক্রিয় অংশগ্রহণ। ধানের বিকল্প কী হতে পারে? তাও ভেবে দেখা উচিত। জলজ ধান, যা পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এবং জলাবদ্ধ অবস্থায়ও চাষ করা যায়। চীনে জিজানিয়া নামে এমন একটি জাত আছে। গ্রিন ব্লু এগ্রিকালচার। সাগর-তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ‘সি উইড’-এর চাষ হয় বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া ওটার চেস্টনাট, ওসাভি, বিভিন্ন ধরনের হার্বস : সেইজ, পার্সি, এ ছাড়াও নানা জাতের হাইড্রোফাইটও চাষ করা সম্ভব হাওর এলাকায়।
আর একটি ভয়াবহ খবর হচ্ছে হাওররক্ষা বাঁধগুলোর নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। তড়িঘড়ি করে যেগুলো নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নিয়েও কৃষক শঙ্কিত। কাঁচা অবস্থায় নরম মাটির এসব বাঁধ প্রকৃত অর্থে পানি আটকাতে পারবে কিনা এ প্রশ্ন হাওরবাসীর। বাঁধের প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ফেব্রুয়ারিতে, কিন্তু কাজ শুরুই হয়েছে মার্চে। ঠিকাদার, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনপ্রশাসন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে পরস্পরকে। কৃষকের অভিযোগ, প্রতি বছর পানি আসার আগে আগে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়, কাজ শেষ না হতেই পানি চলে আসে। যে মাটিটুকু ফেলা হয় তাও পানিতে ধুয়ে নিয়ে যায়। অথচ পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বেশিসংখ্যক শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করলে এই ক্ষতিটুকুর সম্মুখীন হতে হয় না।
হাওরঞ্চল ঘুরে আমার মনে হয়েছে সেখানকার কৃষিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া এখনো তেমনভাবে স্পর্শ করেনি। ট্রাক্টরে হালচাষ করলেও ফসল রোপণ ও ফসল কাটার জন্য কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার তারা করে না। অথচ ড্রাম সিডার ব্যবহার করে তারা কম সময়ে যেমন রোপণের কাজ সম্পন্ন করতে পারে, তেমনভাবে রিপার মেশিন ব্যবহার করে কম সময়ে বেশি ফসলও কাটা সম্ভব। এতে বন্যার পানি আসতে শুরু করলে শ্রমিকের যে সংকট দেখা দেয়, সেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। অন্যদিকে কম সময়ে অধিক ধান কাটাও সম্ভব। হাওরের কৃষকের কৃষি নিরাপত্তার জন্য শস্যবীমার বিষয়টিতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। শস্যবীমা হলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। কৃষকও আর্থিক নিরাপত্তায় থাকবে তার ফসল নিয়ে।
হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি ধানভাণ্ডার রক্ষা করতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নযাত্রায় হাওরবাসীকে যুক্ত করতে সকলে নতুন করে ভাবতে হবে। কৃষি গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণসহ সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় যুক্ত হয়ে। হাওরের মাঠ যে সবুজ ফসলের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, সে ফসল সোনা হয়ে ভরে তুলুক কৃষকের ঘরে। সমৃদ্ধ হোক হাওরঞ্চল।