হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে পাউবোর নীতিমালা অনুযায়ী সব বাঁধেই মাটি কমপেকশন (দুরমুজ করা) করে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মাটি কমপেকশনের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৩৭.৫২ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৯৫৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট বরাদ্দ ১৭৩ কোটি টাকা। ৯৫৮টি প্রকল্পের ৭৫ লাখ ঘনমিটার মাটির কমপেকশন খাতের বরাদ্দ ২৩ কোটি টাকা। প্রাক্কলনে পৃথকভাবে কমপেকশন বরাদ্দ থাকলেও কেউ সঠিকভাবে কমপেকশন করছেন না।
প্রাক্কলনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে ৭ কেজি ওজনের লোহার হাতুড়ি দিয়ে বাঁধের মাটি কমপেকশন করতে হবে। প্রতি ৬ ইঞ্চি মাটি ফেলার পরপর হাতুড়ি দিয়ে কমপেকশন করার নিয়ম। কিন্তু কোন বাঁধেই পাউবোর নিয়ম অনুযায়ী কমপেকশন হচ্ছে না বলে সরেজমিনে দেখা যাচ্ছে। জামালগঞ্জ উপজেলার হালি, মহালিয়া হাওর ঘুরে এই চিত্র দেখা দেখা গেছে। ইচ্ছাখুশি কাজ করছেন পিআইসির সভাপতি-সদস্য সচিব। এক্সেভেটর বা ট্রাক দিয়ে একসাথে অনেক মাটি ফেলায় কমপেকশন করার কোন সুযোগই থাকছে না। ৬ ইঞ্চি করে মাটি ফেলার নিয়ম থাকলেও একসাথেই অন্তত ৪-৫ ফুট উঁচু করে মাটি ফেলা হচ্ছে। এরপর এই মাটির উপর ট্রাক বা এক্সেভেটর চালানো হচ্ছে।
পিআইসির সভাপতিদের দাবি বাঁধে মাটি ফেলার পর ঢেকো (বড় ট্রাক) ও এক্সেভেটর চলাচল করায় কমপেকশনের প্রয়োজন হয় না। তাদের দাবি বাঁধের উপর এক্সেভেটর ও ট্রাক চলাচল করার পর বরং কমপেকশনের চেয়েও ভাল হচ্ছে। তবে পিআইসির সভাপতিদের এসব দাবি মানতে নারাজ পাউবো কর্তৃপক্ষ। বাঁধে সঠিকভাবে কমপেকশন করার জন্য সকল কাবিটা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সদস্য সচিব পাউবোর শাখা কর্মকর্তাদের চিঠি দিলেও কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। জানা যায়, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দুরমুজসহ সকল নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করার জন্য প্রথমে গত গত ৭ জানুয়ারি , পরে ৩০ জানুয়ারি ও সর্বশেষ ১৯ জানুয়ারি জেলার সকল উপজেলার ইউএনও ও পাউবো-প্রকৌশলীকে চিঠি দেন।
নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের মাটি কমপেকশন না হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন, জেলার বিভিন্ন হাওরপাড়ের কৃষক ও স্থানীয় লোকজন। সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের নিধিরচর গ্রামের বাসিন্দা শাহাব উদ্দিন ও হরিনগর গ্রামের বাসিন্দা স্মৃতিরত দাস বলেন,‘আমাদের খরচা ও জোয়াল ভাঙার হাওরের বাঁধে দুরমুজ দেয়া হয়নি। এর জন্য পৃথক বরাদ্দের বিষয়টিও আমরা জানি না। দিরাইয়ের টাংনির হাওরপাড়ের রাড়ইল গ্রামের বাসিন্দা আনু চৌধুরী বলেন,‘নীতিমালা অনুযায়ী কোন কাজই হচ্ছে না। পিআইসির লোকজন ইচ্ছে খুশি কাজ করছেন। বাঁধে কোন ধরনের দুরমুজ দেয়া হয়নি। মধ্যনগর থানার চামরদানী ইউপি চেয়ারম্যান জাকিরুল আজাদ মান্না বলেন,‘হাওরের বাঁধ নির্মাণে কোথাও দুরমুজ দেয়া হচ্ছে না। কেউ কেউ লোক দেখানো কিছু করছেন। দুরমুজের বরাদ্দ ফেরত নেয়া প্রয়োজন।
গত শনিবার জামালগঞ্জের হালীর হাওরে বাঁধের কাজ চলাকালীন সময়ে দেখা যায়, হালীর হাওরের ৯৬ নং উপ প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত এক্সেভেটর চালক বাঁধের পাশে মাটি তুলছেন। বাঁধে ফেলা মাটি কমপেকশন করা হয়নি। কথা বলার জন্য বাঁধের পাশে পিআইসির সভাপতি-সদস্য সচিব কাউকে পাওয়া যায়নি। শনিবার বেলা ১১ টায় বেহেলী ইউপির আলীপুর গোরস্থানের কাছে হালীর হাওরের ১৪ নং উপ প্রকল্পের কাজ তদারক করছিলেন পিআইসির সভাপতি আব্দুল মতিনের ছেলে মাসুদ রানা। ট্রাক দিয়ে বাঁধের নির্দিষ্ট স্থানে মাটি ফেলার সাথে সাথে শ্রমিকদের সাথে নিয়ে উপরের মাটি সমান করছিলেন তিনি। মাটি কমপেকশনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘মাটি ফেলার পর ঢেকু (বড় ট্রাক) ও এক্সেভেটর চলাচল করায় কমপেকশনের প্রয়োজন হয় না।
একই দাবি করলেন, আছানপুর ও হরিপুর গ্রামের মাঝের অংশের ৮২ নং পিআইসির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ মাসুমের ছোট ভাই কাজ তদারককারী সাময়ুন মিয়া। ৫৮ নং পিআইসির সভাপতি রফিকুল ইসলামের ভাই হেলাল উদ্দীন অবশ্য স্বীকার করলেন নিয়ম অনুযায়ী কমপেকশন না হওয়ার কথা। তিনি বলেন,‘নীতিমালায় যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে হয়ত হচ্ছে না। তবে এক্সেভেটরের চাপে উপরের মাটি শক্ত হচ্ছে । গত শনিবার বিকাল সাড়ে ৩ টায় গিয়ে দেখা গেল, হালীর হাওরের সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙা ‘কালীবাড়ি ক্লোজার’-এ মাটি ফেলার কাজ হচ্ছে। চারটি পিআইসি যৌথভাবে এই ভাঙায় মাটির কাজ করছেন। ক্লোজারের দক্ষিণ দিক থেকে ট্রলিতে করে মাটি এনে ফেলে এক্সেভেটর দিয়ে গুছানো হচ্ছে। তবে ভাঙার মূল অংশটুকু বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ভরাট করা সম্ভব হয়নি।
এই বাঁধ ভেঙে গত বছর হালীর হাওর ডুবলেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাঙার কাজও অন্যান্য বাঁধের ন্যায় হচ্ছে। কালিবাড়ি বাঁধেও পাউবোর নীতিমালা অনুযায়ী কমপেকশন হচ্ছে না। তবে কালীবাড়ি ভাঙার মূল অংশের পিআইসি সভাপতি মিহির লাল রায় বললেন,‘ আমরা যেভাবে কাজ করছি, এভাবে কেউ করছে না। একবার মাটি ফেলে অন্তত ১০ বার এক্সেভেটর ও ট্রলি আসা যাওয়া করছে। আমাদের কাজে আর কোন কমপেকশনের প্রয়োজন নেই। মূল গর্ত ভরাট ও কাজ সঠিক সময়ে শেষ করার বিষয়ে তিনি আরও বলেন,‘আমরা আপ্রাণ করে যাচ্ছি। আমাদের কাজটি সবচেয়ে বড় ও গভীর। আমাদের কিছু সময় দিতে হবে। হালীর হাওরের হালীর হাওরের ১৪ নং উপ প্রকল্পের কাছের রাঙ্গিয়ায় অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী উত্তর কামলাবাজ গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন,‘এভাবে দুরমুজ দেয়া লাগে বলে আগে কেউ বলেনি। বাঁধে কোন দুরমুজ দেয়া হয়নি। আমরা যদি জানতাম তাহলে অবশ্যই মাটি ফেলার সময় বলতাম। কারণ এই বান্দেই আমার ধান রক্ষা অইত।
একইস্থানে বসবাসকারী সাচনা গ্রামের আরেক প্রবীণ কৃষক মইদুর আলী বলেন,‘ বান্দও মাডি ফালাইতাছে আমরা দেখতাছি। ইতা অততা আইন-টাইন বুঝি না।’ তবে হ্যামার দিয়ে দুরমুজ দিতে দেখেননি বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন,‘ নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কমপেকশন হচ্ছে না। এ বিষয়ে বার বার কাবিটা উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। তারপরও সঠিকভাবে নীতিমালা অনুসরণ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বাঁধের প্রকৃত অবস্থা দেখেই বিল প্রদান করার জন্য অনুরোধ করা হবে।