হাওর বার্তা ডেস্কঃ বয়স একশ’ একের বেশি। পরনে খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এক হাতে ছড়ি আরেক হাতে কিছু খুচরা টাকা ও ছোট একটি শপিং ব্যাগ। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে জনাকীর্ণ সড়কে এরকম যে লোকটি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যান তাঁর নাম আলী তাহের মজুমদার। মানুষ তাঁকে ভাষা সৈনিক হিসেবেই চিনে জানে। দেখলে বলে-ঐ দেখ ভাষা সৈনিক যায়।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতাজী সুভাষ বসুর অনুচর এবং ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও জাতির জনকের প্রিয়ভাজন আলী তাহের মজুমদারের জন্ম কাগজপত্র অনুসারে ১৯১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। তাঁর মতে আরো ২/৩ বছর বেশি তাঁর বয়স।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে তাঁর জন্ম আলী তাহের মজুমদারের। বাবা চারু মজুমদার, মা সাবানী বিবি। চাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিকের পর কুমিল্লা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করা আলী তাহের মজুমদার ছাত্র থাকাকালে ১৯৩৫ সালে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৮ম পাঞ্জাব আর্মিতে যোগ দিলেও ৭/৮ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ছুটিতে এসে আর ফেরত যান নি।
সে সময় কোর্ট মার্শালে তার বিচার শুরু হয়। জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। অদ্ভূত ব্যাপার তাঁকে কোর্ট মার্শালের বিচার থেকে বাঁচাতে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদ ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের মোজাফ্ফর হোসেন ভূইয়া ফেনীতে জাপানি বাহিনীর বোমায় আলী তাহের মজুমদার নিহত হয়েছিল বলে প্রতিবেদন পাঠিয়ে তাঁকে রক্ষা করেন।
ঐ সময়ে নেতাজী সুভাষ বসুর অনুচর/গুপ্তচর হিসেবে কাজ শুরু করেন আলী তাহের মজুমদার। কুমিল্লা ও ফেনীতে বিলি করেন সুভাষ বসুর লিফলেট। জাপানের হিরোসিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পরের সময়ে আত্মগোপনে চলে যায় তিনি। অবস্থান নেন কলকাতার ১০নং বলাই দত্ত স্ট্রিটে। পরে ফিরে আসেন কুমিল্লায়।
দেশ বিভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে সে সময় কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী কমিটি গঠন করেন। ফলে হিন্দু অধ্যুষিত কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ১৯৪৬ সালের কোন এক দিন কলকাতার ১০ নং মীর্জাপুর এ্যাস্ট্রেটে চা দোকানে আড্ডা দেয়ার সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় হয় আলী তাহের মজুমদারের।
বঙ্গবন্ধু তখন কিছু প্রগতিমনা ছাত্রদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। তার মুখেই আলী তাহের জানতে পারেন বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ করার কথা। দেশ বিভাগের সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরত বোসের পরিকল্পিত বাংলা ভাষাভাষি এলাকা নিয়ে স্বাধীন সরকার গঠনের জন্য কাজ করেন। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তোলেন কুমিল্লার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত।
তখন ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আলী তাহের মজুমদার তখন আরএসপি করতেন। ঐ অফিসে বসে ভাষা আন্দোলনের লিফলেট পোস্টার লিখে বিলি করতেন। কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও বিপ্লবী অতিন্দ্র মোহন রায়ের সাথে যোগাযোগ রেখে চালাতেন আন্দোলন।
৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলি হলে তা অতীন রায়ের মাধ্যমে জানতে পারেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কুমিল্লার মানুষ। আলী তাহের মজুমদার মিছিল করার সময় কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জে গ্রেপ্তার হন। পরদিন তাকে ছেড়ে দেয়। এর আগেও দু’দফা গ্রেপ্তার হন আলী তাহের মজুমদার।
১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লা এসে আরএসপি দলের সদস্যদের সাথে বৈঠক করেন। এসময় বঙ্গবন্ধু আলী তাহের মজুমদারকে আওয়ামী মুসলীম লীগে যোগ দেয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর কথায় মুগ্ধ হয়ে আলী তাহের মজুমদার যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে ৩ বছর কারাগারে ছিলেন। ১৯৫৬ সালে কারামুক্ত হয়ে কুমিল্লা সদর থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
৬৬ এর ৬দফা আন্দোলনে ৬৯ এর গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর মার্চে গণআন্দোলন গড়ে তুলে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হামলার পর চলে যান ভারতে, অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানী সেনারা তার বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে আলী তাহের মজুমদারকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের স্থলে কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য করেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৯৪ সালে কৃষকলীগের কুমিল্লা জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এখনো কোন না কোনভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করে যেতে চান ১০১ বছর বয়সী আলী তাহের মজুমদার। তিনি জানান, আত্মীয় স্বজনরা তার উপর অসন্তুষ্ট। কারন আওয়ামী লীগ করে প্রত্যেকে লাখ লাখ টাকা বানিয়েছে। আমাকে বঙ্গবন্ধু দুইবার নমিনেশন দিয়েছে। আমি নির্বাচন করি নি। সামান্য জমিজমা আছে। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাই, তা দিয়ে চলে যায়। অভাব তো আছেই।
নির্লোভ, সাদা মাটা মানুষ আলী তাহের মজুমদার বলেন, আমার ক্ষতি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুম বাচ্চু মিয়া। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক নেতাই সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। সে সময় বাচ্চু মিয়ার বাসায় ‘ইমপোর্ট লাইসেন্স পারমিট’ বন্টন করা হতো। আমি পারমিটের কথা বললে তিনি বলেন, ‘তোমার রাজনীতি ভোগের নয়, ত্যাগের রাজনীতি’।
কিছু লোক গাছ লাগায় আর কিছু লোক ফল খায়। তুমি গাছ লাগানোদের দলে। আমাকে পারমিট দেয় নি’। আলী তাহের মজুমদার জানান, হতাশা নেই। সবাই ভালো আছে। আপনি ভালো আছেন, আমি ভালো আছি। কিন্তু কোথায় যেন কি নেই। মানুষ যখন বুঝতে পারবে কি নেই তখনই আরেকটা বিপ্লব হবে।
তিনি জানান, জীবনের সায়াহ্নে এসে চাওয়া একটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখা। নাতিনটার একটা চাকুরি যদি দিয়ে যেতে পারতাম। বর্তমানে কুমিল্লার দুর্গাপুর ভূমি অফিসের কাছে নাতিনের বাড়িতে থাকে মহান এই বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক আলী তাহের মজুমদার।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ