হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বৃহৎ দেখার হাওরের সামান্য কিছু বোরো জমির ফসল রক্ষায় কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে অভিযোগ উঠেছে। দেখার হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় মূল বাঁধের ভেতর বাঁধ দেয়া হচ্ছে। ৫ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি’র) মাধ্যমে ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের দরিয়াবাজ গ্রামের একপ্রান্তে (কলাউড়া মসজিদ) থেকে মিয়ারটেকা ভায়া দরিয়াবাজ গ্রামের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত উপ-প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই ৫টি পিআইসির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওই বাঁধ নির্মাণ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন এলাকার লোকজন। পরে একই বিষয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার জেলা প্রশাসকের সেবাচত্ত্বরে গণশুনানীতে অংশ নিয়ে অভিযোগ করেন এলাকার লোকজন। জানা যায়, দেখার হাওরের উত্তরপূর্ব তীরের সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের দরিয়াবাজ-কলাউরা গ্রামের কিছু লোকের বোরো জমির ধান রক্ষায় ৫টি উপ-প্রকল্প তৈরি করা হয়। ২৪৪৪ মিটার দৈঘ্যের বাঁধ নির্মাণে ৫টি পিআইসির জন্য মোট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় ৯১ লাখ টাকা। প্রকল্পগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শেষ পর্যায়ে চলে আসবে জানিয়েছেন পিআইসির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকগণ।
গতকাল শুক্রবার বেলা ১১ টায় সরেজমিনে মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ৫ পিআইসির ওই উপ প্রকল্পের বাঁধে গিয়ে দেখা যায় কাজ চলমান রয়েছে। বাঁধের দুই প্রান্তে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। মাঝ অংশের কাজ চলছে। তবে পাউবোর নীতিমালা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। বাঁধের দুই প্রান্তের দু’টি পিআইসিতে সাইনবোর্ড থাকলেও অন্য ৩টি পিআইসির কাজের কোন সাইনবোর্ড নেই। পিআইসি নিজেদের ইচ্ছাখুশি কাজ করছেন। দূর থেকে ট্রাক ও ট্রলি দিয়ে মাটি এনে স্তুপ স্তুপ করে ফেলা হচ্ছে। বাঁধের কোথাও কমপেকশন (দুরমুজ) দেয়া হচ্ছে না। বাঁধের প্রস্থ সঠিকভাবে করা হলেও উচ্চতা এবং স্লোপ ঠিকমত করা হচ্ছে না।
তবে পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের দাবি, তারা সকল নিয়ম মেনে বাঁধের কাজ করছেন। উচ্চতা ও প্রস্থ নিয়মের চেয়েও বেশী করে করছেন। ট্রাক-ট্রলি দিয়ে মাটি ফেলার সময়ই দুরমুজ দেয়া হচ্ছে। তিনটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। অন্য একটি গত রাতে চোরে নিয়ে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি সাইনবোর্ড লাগানো হবে। কাজ যখন শেষ পর্যায়ে হবে তখন সব স্থানেই দুরমুজ দেয়া হবে। তাদেরই দাবি, এই বাঁধের ভেতরে ২০০ একর জমি রয়েছে। বাঁধের ভেতরের অংশের বোরো জমি রক্ষা করতে এই বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। চেয়ারম্যান ও পাউবোর ইঞ্জিনিয়ার (এসও) দেখেই এই প্রকল্পগুলো নিয়েছেন। তাদের বিরোধীরা এখন নানা কথা বলছে ও অভিযোগ করছে। যারা অভিযোগ করছেন এখানে তাদের কারোর জমি নেই। তবে পাউবো এই প্রথম এখানে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে স্বীকার করেন তারা।
এদিকে স্থানীয় অনেকেরই দাবি এখানে অপ্রয়োজনীয় ৫টি উপ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি টাকার অপচয় হচ্ছে। কারণ এত অল্প জমির ধান রক্ষায় যদি প্রায় ১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তাহলে সমগ্র জেলায় এই ধরনের হাজার হাজার বাঁধ তৈরি করতে হবে। ওই ৫টি পিআইসির একটির সভাপতি মোল্লাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রেদুয়ান আলী রায়হান। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি একটা পিআইসির সভাপতি, তবে এলাকার মেম্বার হওয়ায় আমি সবগুলো কাজ তদারকি করছি। কাজ খুব ভালভাবে হচ্ছে। একসাথে সবগুলো কাজ করছি আমরা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ম মেনে কাজ করলে দুই হাজার উনিশ সালের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না।’ প্রথম কিস্তিতে ২৫ ভাগ টাকা দেয়ার কথা ছিল কিন্তু টাকা দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
পাউবোর নতুন নীতিমালা অনুযায়ী পিআইসি বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন করলেও এই বাঁধে মধ্যসত্ত্বভোগীরা কাজ করছেন বলে জানা গেছে। প্রকল্পের কাজ ও বরাদ্দের পরিমান জানতে চাইলে তা বলতে পারেননি একটি পিআইসির সভাপতি আক্কাস আলী ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন। মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আজাদ মিয়া বলেন, ‘এই বাঁধের কোন প্রয়োজনই ছিল না। কারণ এই বাঁধের ভেতরে মাত্র ২০-৩০ একর জমি রয়েছে। এসব জমি বৃহত্তর দেখার হাওরেরই অংশ। দেখার হাওরের সব ধান রক্ষা হলে এই ধান এমনিতেই রক্ষা হবে। কারণ এই অংশটুকু অনেক উপরে ও গ্রামের নিচে। এখানে প্রায় ১ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে লুটপাটের জন্য। অথচ আফররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে না। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন করেছি। একইভাবে লালপুর গ্রামের কাছে আরও একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাঁধটিও বোরো ফসল রক্ষার কাজে আসবে না। ’
খাগুড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ছলিমুল্লাহ ও মনির উদ্দিন বলেন, ‘এখানে বাঁধের কোন প্রয়োজন নেই, এই বাঁধ দেখার হাওরের ফসল রক্ষায় কোন কাজে আসবে না। ফায়দা লুটার জন্য এসব কাজ করা হচ্ছে।’
বল্লভপুর গ্রামের মাও. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরের কোন উপকারে আসবে না এই বাঁধ। এটা কিছু সংখ্যক মানুষের কাজে আসবে। এই টাকায় যদি আফরের বাঁধ দেয়া যেত সমগ্র দেখার হাওরের কৃষকদের ফসলরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখত। উছারগাঁও-এর বাসিন্দা মোল্লাপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হুসেন বলেন, ‘কিছু সংখ্যক লোকের ব্যক্তি স্বার্থে এই বাঁধ দেয়া হচ্ছে। যারা বাঁধ নির্মাণ করছেন তাদের স্বার্থ হচ্ছে। এই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নির্ধারণ ও যাচাই-বাছাইয়ের কোন সভায় আমাদের ডাকা হয়নি।’
বুড়িস্থলের বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, ‘এখানে এত টাকা খরচ করে কোন বাঁধ করার কোন দরকার ছিল না। এই বাঁধ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হল প্রকল্পের টাকা লুটপাট করা। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের আস্তমা গ্রামের বাসিন্দা হাসান মাহমুদ তারেক বলেন, ‘দেখার হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় মূল বাঁধ দেয়া হচ্ছে মহাসিং নদীর মাঝে উথারিয়া খালে ও নদীর দুই তীরে। হাওরের ভেতরে ও তীরে এত টাকা খরচ করে বাঁধ দেয়া সরকারি অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং সদর উপজেলা কমিটির সদস্য সচিব পাউবোর উপ সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুল সিদ্দিক বলেন, ‘এলাকার ইউপি চেয়ারম্যানের অনুরোধে এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
নিয়ম মোতাবেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিছু মানুষ শুধু বিরোধিতার কারণে এসব কথা বলছে। চামড়ার মুখ যা মনে চায় তাই বলে। সব পিআইসিকে তাগিদ দেয়া হয়েছে সাইনবোর্ড রাখার জন্য। তবে কমপেকশনে কিছু দুর্বলতা আছে। এটা শুধু সদরেরই নয়, এই সমস্যা সারা জেলায় রয়েছে। তুলনামূলক সদরের বাঁধের অবস্থা ভাল আছে।
অল্প জমির ধান রক্ষায় প্রায় এক কোটি টাকা প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, স্থানীয়দের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জের অনেক স্থানেই এ ধরণের বাঁধ হয়েছে।