হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভিড় বাড়তে বাড়তে ক্রমাগত আমাদের জমায়েত যেন একটা পথসভায় রূপ নিতে থাকে। আমরা আলোচনা এগিয়ে নিতে হোঁচট খাই। আধভাঙা প্লাস্টিকের মোড়ায় এক পায়ে ভর দিয়ে বসে ছিলাম; সেটাও যেন ক্লান্ত হয়ে যায়। কে যেন একটা শক্তপোক্ত মোড়া নিয়ে আসে। তাঁদের মধ্যে একজন আমিন, তিনি একসময় ছিল মাঝি—রোহিঙ্গাদের গোষ্ঠীনেতা। পান ভেঙে দুই টুকরো সুপারি আমার হাতে গুঁজে দেন তিনি। ২৪-২৫ বছরেও তিনি ভোলেননি আমার সুপারিভক্তির কথা। দমদমিয়া ক্যাম্পে কোনো একদিন মাঝিরা আমাকে পান সেজে দিলে আমি পানের খিলি খুলে সুপারি মুখে দিয়েছিলাম। আমিন মাঝি সেটা ভোলেনি—কত সামান্য জিনিস মানুষ মনে রাখে। একেই কি ভালোবাসা বলে! আমিন কেন আমাকে মনে রাখবে, কেন ভালোবাসবে? আমি জুতা পায়ে, বোতলে পানি খাওয়া, ক্যামেরা কাঁধে কর্মী আর সে লুঙ্গি পরা খালি পায়ে, গায়ে গন্ধ মাঝি।
ত্রাণকর্মীদের আচরণ
প্রায় ১০ লাখ মানুষের কাছে ত্রাণ আর তথ্য পৌঁছানোর জন্য প্রায় ছয় হাজার মাঠকর্মী কাজ করছে। এ সংখ্যা অনেকটা বীরবলের কাক গণনার মতো, তবে পুরাটাই আন্দাজ নয়। স্থানীয় ভাষার জ্ঞান থাকা খুব জরুরি হওয়ায় স্কুল-কলেজ খালি করে কাতারে কাতারে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা মুলতবি বা পাঠ চুকিয়ে চলে এসেছে ত্রাণ আর মানবিকতার পেশাদার কাজ করার জন্য। (উখিয়া কলেজũতিনবার তারিখ বদলিয়েও উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় সাড়া পায়নি) গামবুট, টুপি, জ্যাকেট, পানির বোতল সব ঠিকঠাক ফিটফাট। ইংরেজি বলছে ঝরঝর তরতর। সব আছে ঠিকঠাক, নেই শুধু মন। কাজের মধ্যে ঘড়ি দেখে বারবার। মাঝি আমিনের এমন কাব্যিক বর্ণনা আমাকে মুগ্ধ করে। ত্রাণ আর মানবিক কর্মীদের এ রকম যান্ত্রিক আচরণ আগেও চোখে পড়েছে। শুধু যান্ত্রিক বললে ভুল হবে, কিছুটা অমানবিকও বটে।
শরণার্থীরা যে কেউ শখ করে শরণার্থী হয় না, তা এসব ‘শিশু’ ত্রাণকর্মীকে বোঝাবে কে? বিদেশ থেকে হুস করে উড়ে আসা ভুস করে চলে যাওয়া কর্মী-কর্মকর্তাদের মনেও রোহিঙ্গাদের জায়গা কম। তাদের কাছেও এরা ‘নোংরা’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ভবিষ্যৎহীন জাতি’। দাতা সংস্থার এক দরদি কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি তুলতেই তিনি আমিনের পর্যবেক্ষণের জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুরোধ করেন—সবাইকে যেন এক পাল্লায় না মাপি। এটা ঠিক, সবাই এক রকম নয়। তবে অন্য রকমের কর্মীদের সংখ্যা একেবারেই কম। এটা কি তাদের দোষ, না যারা তাদের কাজে নিচ্ছে আর পরিচালনা করছে তাদের দোষ? কোনো সংগঠনই এখন দুই-তিন মাসের বেশি কর্মী নিয়োগ দিতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী গত বছর কক্সবাজার গিয়ে বলেছিলেন, প্ল্যান করেন, কমপক্ষে এক বছরের জন্য তৈরি হন। এনজিও ব্যুরো আর তাদের নতুন বড় ভাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেদিকে মন দিচ্ছে কি? ‘এফডি ৭’, ‘এফডি ৬’-এর মারপ্যাঁচে ত্রাণ আর মানবিক সংস্থাগুলোর ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
দুই মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে শেখাবে কখন আর মানসিকতা পরিবর্তনে ব্যায়াম করাবে কখন? প্রত্যাবাসনের কুচকাওয়াজের গতি-প্রকৃতির প্রাথমিক আলামত দেখে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফেরার ঘড়িতে অনেক অনেক দম লাগবে। গওহর রিজভীর এক বছরের হিসাব কয় বছরে শেষ হবে, তা কে বলতে পারে? ত্রাণকর্মীদের ঘাটতি পূরণের জন্য যেভাবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাতে মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধের হার সাম্প্রতিক কালে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটা নিয়ে এখনই ভাবা দরকার।
শরণার্থীরা কখন ফিরবে
মাঝি আমিনের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে একটু খোঁচা দিয়ে আবার কথা শুরু করি। মাঝি, আপনার তো অনেক আত্মীয় এপারে; আপনার মতো আরও অনেকের আছে। তাই আপনাদের যাওয়ার তাড়া কম; গেলেও সবাই যাবে কি না সন্দেহ। মাঝি আমার ঠাট্টা বুঝতে পারে। হাসে বেশ জোরে। অন্যরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। প্রায় সবাই একসঙ্গে ‘না না’ বলে মাথা ঝাঁকায়, কারও কোনো আত্মীয় নেই এপারে। হঠাৎ একজন উঠে দাঁড়ান। বয়সে মাঝি আমিনের গুরুজন—আমিন তাঁকে ওস্তাদ বলে ডাকে। তার শিক্ষক ছিলেন অনেক আগে। তিনিই মুখ খোলেন আগে। বলেন, ‘আগে তো এটা একই দেশ ছিল।
আসা-যাওয়া বিয়েশাদি সবই চলত। আত্মীয়তা নেই কোন পরিবারের? ব্রিটিশদের সময় রেঙ্গুনে যেতেও পাসপোর্ট-ভিসা লাগত না। সারা বাংলার লোক সেখানে ছুটত—ডাক্তার, উকিল, কেউ কি বাদ ছিল? আমার দাদি টেকনাফের, আবার আমার মা মংডুর—তোমরা ইচ্ছামতো দেশ বানিয়েছ, আমাদের জিগাও নাই। এখন এসব বাৎচিতের কোনো মানে নাই। বর্মার সবাই যুদ্ধের সময় (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের) জাপানি হুকুমতের দলে ছিল। আমরাই (আরাকানিরা) ছিলাম ব্রিটিশদের সঙ্গে। আরাকান আর রোহিঙ্গাদের বুকের ওপর দিয়ে জাপানিদের তাড়া খেয়ে ব্রিটিশ ভারতের আর্মি লোকজন বাঙালি-বিহারি-মাদ্রাজি সবাই জান বাঁচিয়েছিল। ব্রিটিশরা আমাদের কথা দিয়েছিল। আমাদের নেতারা জিন্নাহ সঙ্গে সঙ্গে দেখা করেছিল সঙ্গে রাখার জন্য। আমাদের দোষ কোথায়? কসুর কী?’
ফেরত যাওয়ার কথা যেন আটকে যায় ইতিহাস আলোচনা। মুরব্বি তাঁর ভাষায় বলতে থাকেন, ‘আমরা প্রতারিত, আমরা অবহেলিত, আমরা ব্যবহৃত। আমাদের আত্মীয়স্বজনের হিসাব নিয়ে লাভ নাই।’ তাঁর কথার গোলা যেন বন্ধ হয় না। বলেই ফেলেন, ‘আমাদের নিয়ে তোমরা কেন ভুল রাজনীতি করো?’ প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনার জন্য বলি, ‘কী হলে আপনারা ফেরত যাবেন?’ নড়েচড়ে বসে ভিড়ের মানুষ। দাবির পর দাবি জানাতে থাকেন একে একে: নাগরিকত্ব, স্কুল, চাকরি, চলাফেরার স্বাধীনতা, জমি, বাড়ি ,মসজিদ, নামাজ, আজান—কিছুই বাদ যায় না। মুরব্বি আবার গলা পরিষ্কার করে সবাইকে থামিয়ে দেন। ‘আমরা এত কিছু চাই না। এটা তোমাদের হাতে নাই। তবে একটা কাজ হলেই আমরা ফিরতে রাজি।’
কী সেই কাজ? আমরা শুধু রাখাইনের জেলায় জেলায় জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআরের অফিস চাই। ২৪ ঘণ্টা খোলা সে অফিসে আমরা যখন খুশি যেন যেতে পারি—বলতে পারি আমাদের কথা। তাহলেই যেকোনো সময় ফিরে যেতে রাজি। গাড়ি লাগবে না। যেমন এসেছি, তেমনই চলে যাব। সভা থেমে যায়। আমিন মাঝি আমার কাঁধে ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। আমরা অন্যদিকে হাঁটতে থাকি। নতুন মাঝি আকরাম আমাদের পথ দেখায়। এবার আমরা মায়েদের সঙ্গে কথা বলব। একটা ঘরে ঢুকি প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। আকরামের স্ত্রী এসে যোগ দেন।
লেখক: গওহার নঈম ওয়ারা