হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরের বর্তমান অবস্থা জেনে আমি আশংখা করছি আরও একটি নিশ্চিত দুর্দশার। আমার বাড়ি সুনামগঞ্জের হাওর পাড়ে। খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি যে, হাওররক্ষা বাঁধের কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। খবরের কাগজে পড়েছি, সুনামগঞ্জ জেলার ৮৩৭ টি পিআইসির মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে মাত্র ৫২ টি’র। কী ভয়ানক ব্যাপার! কাজের এমন মন্থর গতিতে পাউবো’র প্রকৌশলীরাও দেখলাম হতাশ। আর এটা তো সহজ কথা যে, পিআইসি’র দায়িত্ব প্রাপ্তদের আরো বেশি দায়িত্বশীল না হলে সময়মত বাঁধের কাজ শেষ করা যাবে না। তবে সুনামগঞ্জের ৩৬টি বৃহৎ হাওরসহ জেলার ১৫৪টি হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে এবারও এমন লেজেগোবরে অবস্থা হবে, তা কেউ ভাবেনি। নীতিমালা অনুযায়ী তো এবার হাওর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে করার কথা।
গত বছর ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়েছিল আমার স্বজনেরা। এবারও বহুমুখি সংকট, একদিকে হাওরের পানি নামছে না, অন্যদিকে ধানের চারা বড় হয়ে নষ্ট হবার উপক্রম। আবার পানি না নামায় বাঁধের কাজের বিলম্বের কারণে হাওররক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে একটা ভয়াবহ অনিশ্চয়তা কাজ করছে সবার মনে। আমি যতদূর জানি, নীতিমালা অনুযায়ী কাজ শুরু করলে এই সময়ে আরো অনেক বেশি কাজ হবার কথা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। পিআইসি’র দায়িত্ব প্রাপ্তদের দায়িত্বশীল হতে তাগদা দেওয়ার কথা না, তারা নিজেরাই কাজে লেগে পরার কথা। কিন্তু সব কিছুই হতাশ করছে আমাদের। তারা সময়মতো কাজ শুরু করেনি।
খবরের কাগজ মারফতে আমরা জেনেছি, হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইসি) কমিটিতে বিস্তর অনিয়মের গল্প। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের দায়িত্ব নাকি পেয়েছেন জেলার ১১টি উপজেলায় ইউপি সদস্য ও তার আত্মীয় স্বজনরা এবং ক্ষমতাশালীরা। প্রকল্প কমিটি প্রকাশ হওয়ার পর হাওরপাড়ের কৃষকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে শুনেছি। এমন অসঙ্গতির বিষয়ে বিভিন্ন উপজেলায কৃষকরা লিখিত ভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন। অভিযোগের অনুলিপি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক বরাবরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও প্রকল্প কমিটির সময় পার হয়ে যাওয়ায় পর দ্রুত নামমাত্র কমিটি গঠন করা হয়েছে। এমন কমিটি দিয়ে হাওরের আসলেই কাজ হবে কিনা তা নিয়ে আমরা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় আছি।
হাওরপাড়ের কৃষকরা গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগে করে বলেছেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনে এমন অসঙ্গতির ঘটনা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখেছি, বিগত বছর ঠিকাদার ও পিআইসিদের দূনীর্তির কারণে অকাল বন্যায় বোর ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে জেলার সব ক’টি বোর ফসলি হাওর তলিয়ে যায়। এবার চলতি বছরও যদি দূর্নীতি গ্রস্থ কিংবা অসাধূ ব্যাক্তিদের দিয়ে আবার বাঁধের কাজ করানো হয়; তাতে গত বছরের মত দূর্নীতি যে হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাওর পাড়ে জন্ম হওয়ার সুবাধে আমি জানি, এ এলাকায় বাঁধ নির্মাণে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তার সম্পূর্ণ টাকা বাঁধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় না। এটা একেবারে প্রচলিত প্রথা হয়ে গেছে। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ এর ৪৯ ধারায় মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। সেখানে উল্লেখ আছে, উপধারা (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃত বা অবহেলাক্রমে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকে কোন কার্য দ্বারা পরিবেশের এইরূপ বিপর্যয় ঘটান যাহা কোন দুর্যোগের কারণ সৃষ্টি করে এবং ফলশ্রুতিতে অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জান, মাল, সম্পদ, স্থাপনা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি সাধিত হয়, তাহা হইলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করিতে পারিবে। উপধারা (২) এই ধারার অধীন ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা পরিচালনায় Code of Civil Procedure, 1908 (Act No. V of 1908) এর বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে।
আমরা জানি, গত দুই বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে ফসল হারিয়ে কৃষকরা বর্তমানে একবারে সর্বস্বান্ত। আর এবছরও পানি যে-হারে কমছে, তাতে করে বীজতলা তৈরি করতে পারলেও তা রোপণ করতে পারবে কিনা এই চিন্তায় রয়েছে হাওরপাড়ের লাখ লাখ কৃষক। তাছাড়া পিআইসি গঠনে বিলম্ব হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এবছরও প্রশ্নবিদ্ধ করছেন হাওরপাড়ের কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। আর দ্রুত পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করতে না পারলে এবারও বোরো ফসল ঝুঁকিতে পড়বে। আর হাওরের ফসলের ক্ষতির প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। কেননা সরকারের হাওর মহাপরিকল্পনার হিসাবে দেশের মোট ধানের ১৮ শতাংশ এবং উন্মুক্ত উৎসের মাছের ২৮ শতাংশ আসে হাওর থেকে। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) হাওরের অবদান ৬ শতাংশ।
সুনামগঞ্জে এবার দুই লাখ ২২ হাজার ৫৫২ হেক্টর বোরো জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ১৫শ’ কোটি টাকা। কিন্তু কচ্ছপের গতিতে পানি কমলে চরম ক্ষতির শিকার হবে কৃষকরা। সেইসাথে এবার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। আর এর প্রভাব পড়বে হাওরের প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন আর দেশের অর্থনীতির ওপর।
শেষ কথা হচ্ছে হোয়াংহো নদী এক সময় ছিল চীনের দুঃখ। সেটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে আশীর্বাদে পরিণত করা হয়েছে। সেই সূত্র ধরে বলতে হয়, হাওরের পানি, মৎস্যসম্পদ এবং ফসল যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার সমাধান আছে। আমাদের হাওর সারা দেশের এক-তৃতীয়াংশ ধান, মিঠাপানির মাছের প্রায় অর্ধেক অংশ জোগান দেয়। তাই হাওরবাসীর দুঃখের সমাধান জাতীয় প্রয়োজনেই করতে হবে। আর এবছর যদি ফসলের ক্ষতি হয়, তবে হাওরবাসীর পক্ষে মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখা শুধু কঠিন হয়ে যাবে না; তারা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা রাষ্ট্র কি নেবে না?