হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরে বোরো ধানের চারা রোপণের সময় প্রায় শেষ হয়ে এলেও এখনো পানি যথাযথ মাত্রায় না কমায় এবার নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের বেশির ভাগ বোরো জমিই এখনো আবাদ করতে পারছেন না কৃষকরা। এতে নতুন সংকটে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
অন্যদিকে, ধানের চারা জমিতে রোপণের সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণে হাওর এলাকার অনেক কৃষকের বোরো ধানের চারা বীজতলায়ই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
গত শনি ও রবিবার নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর, খালিয়াজুরীর চুনাই, চৌতারা হাওর ও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ধারাম হাওর, ডুবাইল, মারাধাইরিয়া, কাইলানি হাওর ও জামালগঞ্জের পাকনার হাওর এলাকা ঘুরে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এসব সমস্যার কথা জানা গেছে।
কৃষকরা জানান, গত বছর আগাম বন্যায় হাওরে তাদের বছরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন তারা। আর এবার তারা গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াসহ নতুন করে বাঁচার আশায় পুরনো ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ নেওয়াসহ তাদের গরু-বাছুর বিক্রি করে এবারো হাওরের বোরো জমি আবাদ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
প্রকৃতির চিরাচারিত নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক বছরের পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই হাওরের জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ শুরু হয়। শেষ হয় মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে।
কিন্তু এবার হাওরের বোরো আবাদের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসলেও নির্দিষ্ট সময়ে হাওরের পানি না কমায় এখনো তারা তাদের বেশিরভাগ জমিতেই বোরো আবাদ করতে পারছেন না। এ ছাড়া ধানের চারার বয়স বেশি হওয়ার কারণে তা বীজতলায়ই বিবর্ণ আকার ধারণ করে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ফলে এখন কী করণীয়- তা ভেবে উঠতে পারছেন না।
কৃষকরা আরো জানান, হাওরের পানি নিষ্কাশনের নালাগুলোসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কয়টি নদীই খননের অভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ায় ওইসব হাওরের পানি কমতে বিলম্ব হচ্ছে বলেই এবার তাদেরকে নতুন এ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ের তেথুলিয়া পূর্বপাড়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম (৫০) বলেন, ‘ডিঙ্গাপোতার মহিষাউড়া আওরে (হাওরে) আমার সাত একর জমি হতি (প্রত্যেক) বছরই পৌষ মাসের পনেরর মধ্যে ক্ষেতের রুয়ার (রোপণের) কাম শেষ অইয়া যায়। ইবার (এবার) ক্ষেত রুয়ার ঘাত (রোপণের সময়) যাইতাছেগা এর পরও কোনো কোনো ক্ষেতের মাঝে অহনও (এখনো) হাঁটু বা কোমর পানি থাকায় অহনও আমি আমার এক কাটা ক্ষেতও লাগাইতাম পারছিনা। এইবার যে আল্লাহ্ আমরারে নতুন কইরা কোনো বিপদে হালাইছে কিছুই বুঝতাছি না।
ধর্মপাশা উপজেলার কাইলানী হাওর পাড়ের শাহ্পুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গত বছরের আড়াই লাখ টাকা ঋণ মাথায় নিয়ে এবার নতুন করে আরো সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ করে কাইলানি হাওরে থাকা আমার প্রায় ৬০ একর বোরো জমি আবাদ করার প্রস্তুতি নিয়েছি। ইতিমধ্যে হাওরের উঁচু এলাকার প্রায় ১৬ একর বোরো জমির রোপণের কাজ শেষ করেছি। কিন্তু হাওরের বাকি সব জমিতে এখনো কোমর পানি থাকায় সেসব জমি রোপণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
কৃষক আবুল কালাম আরো বলেন, ‘সময়মতো ধানের চারা জমিতে রোপণ করতে না পারায় ধানের চারাগুলোও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও বয়সের কারণে বীজতলায়ই লালচে রং ধারণ করে তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘হাওরের পানি নদীতে নামার নালার মুখসহ এর সঙ্গে সংযুক্ত মনাই ও সুরেস্বরী নদী ভরাট হওয়াতেই হাওরের পানি নামতে দেরি হচ্ছে।’
খালিয়াজুরী উপজেলার চুনাই হাওর পাড়ের মকিমপুর গ্রামের কৃষক সুধা রঞ্জন মজুমদার (৬৫) বলেন, ‘গত বছরের ঋণের জের টানতে হচ্ছে আমাকে। তাই এবার চুনাই হাওরে থাকা আমার ১৫ একর বোরো জমির মধ্যে মাত্র পাঁচ একর জমি নিজে আবাদ করার প্রস্তুতি নিয়েছি। আর বাকি সব জমি বর্গা দিয়েছি। কিন্তু হাওরের পানি না কমায় এখনো এক কাটা জমিও আবাদ করতে পারছি না।’
জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনার হাওর পাড়ের ফেনারবাগ গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক সাজেদুর রহমান বলেন, ‘পাকনার হাওরে আমার প্রায় ১৪ একর বোরো জমি রয়েছে। অন্যান্য বছর পৌষ মাসের শেষের দিকে আমার সব জমির রোপণের কাজ শেষ করে ফেলতাম। কিন্তু এবার ওই জমিতে এখনো হাঁটুর ওপরে পানি থাকায় এ পর্যন্ত এক কাটা জমিতেও রোপণ করতে পারিনি।
ধর্মপাশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সোয়েব আহম্মেদ হাওর বার্তাকে বলেন, ‘এবার এ উপজেলায় প্রায় ৩১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এ পর্যন্ত কৃষকরা হাওরের উঁচু এলাকার প্রায় ১৬ হাজার হেক্টরের মতো জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণের কাজ শেষ করতে পেরেছেন। তবে হাওরের নিচু এলাকার জমিগুলোও কৃষকরা আগামী ১৫-১৬ দিনের মধ্যেই রোপণের কাজ শেষ করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম নাফিস হাওর বার্তাকে বলেন, ‘এ উপজেলায় এবার ১৬ হাজার আট শ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে হাওরের উঁচু এলাকার জমিগুলো রোপণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এলেও পানি না কমায় বিশাল ডিঙ্গাপোতা হাওরের নীচু এলাকায় আনুমানিক আড়াই হাজার একরের মতো জমি এখনো রোপণ করতে পারছেন না কৃষকরা।
বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমীন হাওর বার্তাকে বলেন, হাওর এলাকার কৃষকদের নতুন এ সমস্যা দূর করতে হলে প্রথম ধাপেই জরুরি ভিত্তিতে প্রত্যেকটি হাওরের পানি নিষ্কাশনের নালার বাইরের মুখগুলোকে খনন করে দিতে হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে হাওর এলাকার প্রত্যেকটি নদীই খনন করা ছাড়া কৃষকদের এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের আর কোনো বিকল্প দেখছি না।