হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখলেই যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। সব কিছু ঠিক থাকার পরও নানাভাবে হয়রানি করা হয়। অথচ তাঁরা অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন না।’
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হওয়া ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান এভাবেই হাওর বার্তার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাভারের আশুলিয়ার গার্মেন্ট এক্সেসরিজের এই ব্যবসায়ী সম্প্রতি ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের দুর্ব্যবহারের শিকার হন।
মিজানুর রহমানের মতো অনেক বাংলাদেশিই কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে হয়রানি ও অশোভন আচরণের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। বিশেষ করে ট্যুরিস্ট, স্টুডেন্ট, ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন ভিসায় যাঁরা মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন তাঁরাই এই হয়রানিতে পড়ছেন।
তবে সরকারিভাবে কলিং ভিসায় (জিটুজি প্লাস) যেসব শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে তারা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি বেনজির আহমেদ। ট্যুরিস্ট, স্টুডেন্টসহ অন্য ভিসায় যারা যাচ্ছে তাদের অনেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে তিনিও স্বীকার করেন।
বৈধভাবে যাওয়া শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করে বেনজির আহমেদ হাওর বার্তাকে বলেন, দুই দেশের সরকারের চুক্তি অনুযায়ী ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে সেখানে শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে। আর সেখানকার বিমানবন্দরে শ্রমিক পৌঁছলে সংশ্লিষ্ট কম্পানির কর্তৃপক্ষ এসে বিমানবন্দর থেকে তাদের বুঝে নিয়ে যাচ্ছে।
বায়রার সাবেক এক সিনিয়র সহসভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাওর বার্তাকে বলেন, ‘কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে হয়রানি করবে না কেন? ট্যুরিস্ট ও স্টুডেন্ট ভিসার নামে শ্রমিক পাঠাচ্ছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। প্রতিদিন আসল ট্যুরিস্টদের পাশাপাশি শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। কলিং ভিসায় অভিবাসন ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকেই অসাধু সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে স্টুডেন্ট ও ট্যুরিস্ট ভিসায় যাচ্ছে। এদের ঠেকাতে গিয়েই মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন পুলিশ বাংলাদেশিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।’ তিনি বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকেই যেন কোনো শ্রমিক ট্যুরিস্ট ভিসায় যেতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।
এর আগে গত ২০ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হন সিনিয়র যুগ্ম সচিব মাহবুব কবির মিলনসহ বাংলাদেশের ১২ জন কর্মকর্তা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অন্য দেশের যাত্রীরা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে চলে গেলেও বাংলাদেশিদের নিয়ে চলে টানাহেঁচড়া। বিমানবন্দরে যাচাই-বাছাইয়ের নামে চলে হয়রানি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনো কারণ ছাড়াই কাউন্টারের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলাদা করে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে মানসিক নির্যাতন। তা ছাড়া কাউকে বিমানবন্দর ডিটেনশন সেলে রাখা হয়, না হয় দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে হয়রানি প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ হাইকমিশনার মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাওর বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমাদের নজরে এলে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগে জানাই। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগের প্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা আমাদের হাইকমিশন কার্যালয়ে এসেছিলেন। সেই বৈঠকেও আমরা এসব জানিয়েছি। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের ছয় শতাধিক ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। আশা করছি, আগামী দিনে বিমানবন্দরে হয়রানি অনেক কমে যাবে।’
তবে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাওর বার্তাকে বলেন, ‘কলিং ভিসায় যারা আসে তারা দুর্ব্যবহারের শিকার হয় না। হয়রানির শিকার হয় শুধু ট্যুরিস্ট ভিসা ও স্টুডেন্ট ভিসায় যারা শ্রমিক হিসেবে এ দেশে আসে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যেন কোনোভাবেই ট্যুরিস্ট কিংবা স্টুডেন্ট ভিসার নামে কোনো শ্রমিক মালয়েশিয়ায় না আসে। এটা বন্ধ করা খুবই দরকার।’ তা না হলে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে তিন ঘণ্টা আটকে থাকার কথা জানিয়ে পোল্ট্রি ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান হাওর বার্তাকে বলেন, ‘হয়রানির কারণে আমি আর কোনো দিন মালয়েশিয়া যাব না। এমনকি আমার কাছে হয়রানির কথা শুনে আমার বন্ধুরাও মালয়েশিয়া না গিয়ে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। শ্রমিক মনে করেই বাংলাদেশিদের হয়রানি করে থাকে ওরা। আর বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখেই আমাদের অন্য চোখে দেখে।’
মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে থাকা বাংলাদেশি কর্মী রিয়াজুল ইসলাম জানান, তিনিসহ তিন কর্মী দুই মাসের ছুটিতে দেশে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে বিমানবন্দরে তাঁদের চার ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে দুজনকে ছাড়লেও একজনকে ভিসা থাকার পরও দেশে ফিরে যেতে হয়েছে।