হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ভীতি দূর করতে সরকার মাধ্যমিকস্তুরে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক (এসিটি) নিয়োগ দিয়েছিল। কাঙ্খিত ফলও পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্টের (সেকায়েপ) মাধ্যমে এসিটি শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চরম হতাশায় ভুগছেন পাঁচ সহস্রাধিক মেধাবী শিক্ষক।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব শিক্ষকদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেওয়ায় প্রভাব পড়েছে পাঠদানে। বিশেষ করে আসন্ন এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে এসব শিক্ষকদের সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে (এসইডিপি) নেওয়ার নীতিগত সিদ্বান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুর্গম এলাকায় মাধ্যমিকস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নেই। শিক্ষক থাকলেও তাদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে না। মাধ্যমিক শিক্ষার গুনগতমান উন্নত করতে সরকার চালু করে সেকায়েপ প্রকল্পটি। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি চালু করা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় তিন হাজার চারশত ৮০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, দুর্গম ৬৪টি উপজেলার দুই হাজার ১১টি স্কুলে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে ছয় হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বশেষ পাঁচ হাজার ১৮৭ জন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে শিক্ষকরা স্কুলে পাঠদান শুরু করেন। যাদের স্নাতকে ৫০ শতাংশের বেশি নম্বর ছিল তাদেরকেই আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। যাচাই বাছাই করে সর্বোচ্চ যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
কর্মকর্তারা আরও জানান, শুরুতে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ শিক্ষকদের মাসিক বেতন ছিল ১৪ হাজার টাকা। জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী সর্বশেষ ২২ হাজার ২০০ থেকে ২৭ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়। উপজেলা পর্যায়ে আকর্ষণীয় বেতন দেওয়ায় এসব শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠদান করেন। নিয়মিত ক্লাসের বাইরে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মাসে অন্তত ১৬টি অতিরিক্ত ক্লাস নিয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীদের গণিত, ইংরেজি ভীতি কমেছে।
এছাড়া বিষয়ভিত্তিক মান ও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি, ঝড়া পড়া কমেছে। অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ায় প্রাইভেট পড়া ও কোচিং করার প্রবণতা কমেছে। পাবলিক পরীক্ষায় প্র্রকল্পভুক্ত প্রায় সকল স্কুলের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যাভাস গড়ে তুলতে পাঠাগার স্থাপন, মেধাবৃত্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। এসব সুবিধা নিয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করেছে। তবে গত মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় শিক্ষকরা হতাশা হয়ে পড়েছেন।
এসিটি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার আনোয়ারা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মামুন হোসেন বলেন, ক্লাস নিতে আমাদের লিখিতভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়নি। আবার বাদও দেওয়া হয়নি। আমরা দোদুল্যমান অবস্থায় আছি। এসিটি শিক্ষকরা মাধ্যমিক শিক্ষা গুনগতমানে নিয়ে এসেছেন। তা ধরে রাখতে সকল শিক্ষক ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে স্কুল থেকেও কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না। সরকার আমাদের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে অনেক শিক্ষক অন্য পেশায় চলে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, দুর্গম এলাকার স্কুলগুলো এসিটি নির্ভর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। আমরা স্কুলে না থাকলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে স্কুলে পড়াবেন না বলে জানিয়েছেন।
একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক গ্রুপ চাচ্ছেন এসিটি শিক্ষকদের নতুন প্রকল্পে নিয়োগ দিতে। অন্যগ্রুপ শিক্ষকদের বিদায় করতে চান। তাদের ধান্ধা, নতুন প্রকল্পে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিলে বাণিজ্য করা যাবে।
শিক্ষকরা আরও অভিযোগ করেন, নিয়োগ দেওয়ার সময়ে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত বা প্রকল্প শেষে নতুন প্রকল্পে সরাসরি নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। প্রতি বছরে বেতন বাড়ানো শর্ত ছিলো। নিয়োগের প্রথম বছর শুধু বেতন বেড়েছে। তারপর আর বেতন বাড়েনি। প্রকল্পের মেয়াদ যতই শেষ হতে থাকে সুযোগ সুবিধা ততই কমতে থাকে। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ইয়াকুব হাইস্কুলের বিজ্ঞানের এসিটি শিক্ষক মহিউদ্দিন মো. নাইম বলেন, সেকায়েপের কর্মকর্তারা মৌখিকভাবে নিয়মিত ক্লাস নিতে বলেছেন। আমরা কোন ভিত্তিতে ক্লাস করবো? বর্তমানে আমাদের কোনো পরিচিতি নেই। আমরা কি প্রতিষ্ঠানের অতিথি শিক্ষক না কি স্কুল থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে? নাকি মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এই শিক্ষক আরও বলেন, আমাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের সব বুঝিয়ে দিতে। এর ফলে স্কুলের নিয়মিত শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের দুরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন স্কুলে গেলে অন্য শিক্ষকরা আমাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন। এই অবস্থায় ক্লাস নেওয়ার মানুষিকতা নেই।
এসিটি শিক্ষক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারের অনুমতি ছাড়া ক্লাস নিবো এর বৈধতা কী। ক্লাস চালিয়ে নিলেও বেতন পাবো কিনা, নতুন প্রকল্পে নেওয়া হবে কিনা? এসব নানা বিষয়ে চিন্তিত। তিনি আরও বলেন, স্কুলের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে না পারায় আমাদের ওপর শুরু থেকেই ক্ষিপ্ত। এখন স্কুলে গেলে কটাক্ষ করেন।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ইয়াকুব হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, সেকায়েপ প্রকল্পের সফল উদ্যোগ এসিটি শিক্ষক নিয়োগ। শিক্ষার্থীরা খুবই উপকৃত। এসিটি শিক্ষকরা অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন। তারা ভালো মানের দক্ষ শিক্ষক। তাদের পাঠদানের কারণে শিক্ষার্থীদের কোচিং ও প্রাইভেট নির্ভরতা অনেক কমেছে।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যান্ত এলাকায় দক্ষ শিক্ষকের অভাব ও অভিভাবকদের প্রাইভেট পড়ানোর খরচ চালাতে না পারায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘এসিটি শিক্ষকদের এসইডিপিতে অন্তর্ভুক্তকরার নীতিগত সিদ্বান্ত হয়েছে। শুধু এসিটি শিক্ষকদেরই নয়, সেকায়েপ প্রকল্পের সব ভালো কাজ নতুন এই প্রকল্পের অধীনে চালু রাখা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষকদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাদের আরও খুশি হওয়ার কথা।