হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্বাচনের ডামাডোল বাজা শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণে এ সময় দুই বড় দল অর্থাৎ প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কণ্ঠশীলনও শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য সারা বছরই কৌতুকপ্রদ বা কখনও বিরক্তিকর ঝগড়া আমাদের শুনতেই হয়। একপক্ষের কথা মাটিতে পড়ার আগেই আরেক পক্ষের উত্তর ছুড়ে দেয়া। আমার ধারণা বিভিন্ন দেশ বিচারে আমাদের এই সংস্কৃতি অনন্য। অনেকটা কবি গানের মতো। একপক্ষ প্রশ্ন করলে অন্যপক্ষ তাৎক্ষণিক উত্তর দেবেন।
না হলে দর্শক ভাববে তিনি হেরে গেলেন। আমাদের এই দুই পক্ষের রাজনীতিকরাও হয়তো মনে করেন কথার পিঠে উত্তর না দিলে বোধহয় জনগণ বিভ্রান্ত হবেন। মনে করবেন বোধহয় অন্যপক্ষের জিত হয়ে গেল। তবে আমাদের মনে হয় না এদেশের মানুষ এত বোকা। প্রতিদিন নিয়ম করে বিএনপি নেতা দলীয় কার্যালয়ে বসে টিভি ক্যামেরার সামনে একটি কাগজ হাতে নিয়ে যন্ত্রমানবের মতো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ-অনুযোগ করতে থাকেন তা বিএনপি কর্মীদের কতটা উজ্জীবিত করে জানি না, সাধারণ মানুষকে যে যথেষ্ট বিরক্ত করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব বা অন্য কোনো নেতা কোথায় কী বললেন অথবা কী উপস্থাপন করলেন তার উত্তর দু’তিনজন আওয়ামী লীগ নেতা যখন রসিয়ে রসিয়ে দিতে থাকেন, তা বহু শোনার কারণে আর তেমন গুরুত্ব ধারণ করে না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আফসোস এখানেই এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃত কেমন যেন আভিজাত্য হারিয়ে ফেলছে। এখন তো বাৎচিতের প্রধান অংশ নির্বাচন। বিএনপি নেতাদের গতবারের হঠকারী সিদ্ধান্ত যে তারা বিস্মৃত হননি সেটুকু ভালো লাগার বিষয়। সেবারে সংলাপ, নির্বাচনকালীন সরকারে অংশগ্রহণ ইত্যাদি নানা পথ খোলা রেখেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপির বিদগ্ধ রাজনীতিকদের অনেকে এসব সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলার পক্ষেও ছিলেন।
কিন্তু তারপরও নির্বাচন বর্জন এবং নির্বাচন প্রতিহত করার অনড় সিদ্ধান্তে থাকতে হল জামায়াতবন্ধুর কারণে। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল এরা যে কোনো পথে দ্রুত ক্ষমতায় আসতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। তাই নির্বাচন প্রতিহত করার নামে ভয়ানক অরাজকতা ও খুনোখুনি শুরু করে দিল। পেট্রুলবোমার ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠল। শেষ পর্যন্ত এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে লাভের গুড় পুরোটাই পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলল। এবার বিএনপি নেতৃত্ব কিছুটা আত্মচৈতন্য ফিরে পেয়েছে বলে মনে হয়।
দাবিতে অতটা অনড় মনে হয় না। তারা শর্ত ছাড়াই আলোচনায় বসতে চায়। তবে এখনও অভ্যাসবশত কোনো কোনো বিএনপি নেতা নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে করা দাবি না মানলে ‘নির্বাচন হতে দেয়া হবে না’ বলে ফেলছেন। তবে আমাদের ধারণা বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে আর যাবে না। এখন নানাভাবে জামায়াতের ভগ্নদশা। আর জামায়াতের শক্তি ছাড়া এ সময় অরাজকতা তৈরি করার সামর্থ্য বিএনপির নেই।
আমরা মনে করি নির্বাচনের মাঠে জনগণের সামনে বিএনপির নানা বিষয়ে জবানবন্দি দেয়ার প্রয়োজন পড়বে। আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির মুশকিল হচ্ছে, দূরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবে তাৎক্ষণিক সুবিধা লাভের আশায় অনেক সময় বালখিল্য আচরণ করে ফেলি। ফলে তা গেলাও যায় না, ওগরানোও কঠিন। জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে জেনে যেতে পারলেন না যে তিনি ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক। বরং তিনি তার নিজের লেখায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
যে দলের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে, সে দলকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে আওয়ামী লীগকে পেছনে ফেলা যাবে না, এমনি এক ছেলেমিসুলভ চিন্তা থেকে ইতিহাসকে অস্বীকার করে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে ঘোষণা করতে হল জিয়াউর রহমানের নাম। বর্তমান অপরাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বন্দি হওয়ার কারণে দলীয় অবস্থান ঠিক রাখতে বিপাকে পড়ে হলেও অনেক প্রাজ্ঞ বিএনপি নেতাকে কলের পুতুলের মতো এই স্লোগান দিয়েই যেতে হচ্ছে।
একবারও চিন্তা করছেন না সাধারণ মানুষের সামনে দলকে কতটা ছোট করে ফেলা হচ্ছে। আর ইতিহাসের কাঠগড়ায় তো অপরাধী করেই ফেললেন দলকে। দ্বিতীয় অন্যায়টি ছিল, হঠাৎ একদিন ঘোষণা হয়ে গেল ১৫ আগস্ট বিএনপি নেত্রীর জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করুক বা না-ই করুক, বঙ্গবন্ধুর সপরিবার হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য বড় শোকাবহ ঘটনা। কোনো সুস্থ, বিবেকবান মানুষ জাতির এই শোকাবহ দিনে প্রকাশ্যে আনন্দ করে না। আর একজন জাতীয় নেত্রীর বেলায় তো প্রশ্নই ওঠে না। ধরে নিই, খালেদা জিয়ার নব-আবিষ্কৃত এটিই সঠিক জন্ম তারিখ।
সেক্ষেত্রে দায়িত্বশীল বিবেকবান মানুষ এবং দলীয় নেতাকর্মীদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা শোকের দিনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুদিন পর একটি দিন নির্ধারণ করে উৎসব পালন করার। অথচ যেদিন দেশজুড়ে কাঙালিভোজ হয়, মিলাদ মাহফিল হয়, এদেশের বেশির ভাগ মানুষ সেদিন তাদের ছেলেমেয়ে, ভাই-বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান এদিনে ফেলতে চান না। অথচ একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেত্রী হঠাৎ সুসজ্জিত হয়ে সাড়ম্বরে বিশাল কেক কেটে জন্মদিনের উৎসব পালন করেন। সারা দেশেই এর অনুকরণ চলে বিএনপি নেতানেত্রী ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। একবার বিএনপিদলীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্নেহভাজন সহকর্মীকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের বিবেক কি প্রতিবাদ করে না? সে সঙ্গোপনে বলল, বিবেক ঠিকই প্রতিবাদ করে স্যার, কিন্তু এই আয়োজনে অংশ না নিলে দলে আমার অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে।
সহজেই অনুমান করা যায়, ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করা হলে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু জীবন্ত হয়ে উঠবেন। এটাকে নিষ্প্রভ করার জন্য একটি উৎসব আয়োজন করে দৃষ্টি সরাতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর ইমেজ দুর্বল করার জন্য ১৯৯৬ থেকে পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিব নামের আগে বসানো ‘বঙ্গবন্ধু’ উঠিয়ে দেয়া হল। বিএনপি নেতানেত্রীরা বঙ্গবন্ধু বলা বন্ধ করে দিলেন। কতটা অর্বাচীন যে, একই আসরে একদিকে বলাছেন ‘শহীদ জিয়াউর রহমান’, আবার অন্যদিকে বলছেন ‘মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান’। কিন্তু তারা ভুলে গেলেন ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়া’ ও ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা’ আর ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিন্ন ধারার উপাধি নয়।
প্রথম দুটি দলীয় উপাধি। দলের মানুষ যত খুশি বলুন- বাধা নেই। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’ জনগণের অনুমোদিত উপাধি। তা বলতে না দেয়া জনগণকে অসম্মানিত করা। ১৯৯৬-এর ২৩ মার্চ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পরদিন বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। এই সভায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ লাখ লাখ মানুষকে সাক্ষী রেখে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়ার প্রস্তাব করলে জনগণ দ্বারা তা অনুমোদিত হয়। বিএনপির বর্তমান অনেক সিনিয়র নেতা জীবনে বহুবার বঙ্গবন্ধু বলেছেন। আজ তারা দলীয় সংকীর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে জনগণের দল দাবি করেও জনগণের অনুমোদিত উপাধিকে অগ্রাহ্য করে নিজেদেরই সংকীর্ণ করে ফেলেছেন।
আরেকটি ঘৃণিত কাজ ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। সৌভাগ্যবশত শেখ হাসিনা রক্ষা পেলেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী হতাহত হন। ক্ষমতায় তখন বিএনপি। এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে ক্ষমতাসীন থেকেও বিএনপি এই হামলার রহস্য উদ্ঘাটনে কেন ভূমিকা রাখল না?
দুর্নীতিতে কম-বেশি সব পক্ষই সিদ্ধহস্ত। কিন্তু উপরের বড় দাগের অন্যায়গুলো দেশের অধিকাংশ মানুষের চোখেই স্পষ্ট। তারা বিশ্বাস করে, বিশ্বাস না করার সুযোগও নেই। আজ নির্বাচনের মাঠে বিএনপি নেতারা চষে বেড়াতে পারেন। টিভি ক্যামেরার সামনে নানা শব্দবাণ ছুড়তেই পারেন; কিন্তু নৈতিক জায়গায় তারা দুর্বল হয়ে আছেন। দুর্ভাগ্য দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কর্মী-সমর্থকদের। বড় নেতাদের এতসব ছোট কাজের দায় তাদেরও বহন করতে হচ্ছে। সারা দেশে বিএনপির ভোটার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু রাজহাঁসের স্বর্ণডিম্ব একসঙ্গে খেতে গিয়ে ভোটারদেরও বিক্ষুব্ধ করে তুলছেন নেতানেত্রীরা।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা ও পাতিনেতাদের দৌরাত্ম্য কিছু কম নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অর্জনকে এরা অনেক ক্ষেত্রেই বিবর্ণ করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। অতীতে যারা আওয়ামী লীগে ভোট দিয়েছেন, আমি বিশ্বাস করি তাদের অনেকেই বিকল্প জায়গা পেলে সেখানেই ভোট দেবেন। এই বিকল্প হওয়ার কথা ছিল বিএনপির। কিন্তু বিএনপি নেতারা দলটিকে যেভাবে অমার্জিত করে তুলেছেন, তাতে মন্দের ভালো বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সুবিধাটি পেয়ে যাবে বলে আমাদের ধারণা।
বিএনপির যে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ একেবারেই নেই আমরা তা বলব না। তবে এর আগে মোটা দাগের অন্যায়গুলোর জন্য বিএনপি নেতাদের জনগণের কাছে পরিতাপ করা উচিত। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের বোমা হামলায় মানুষ পোড়ানো পর্যন্ত সব অপকীর্তির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এমন শোভন সংস্কৃতি তো আর আমাদের রাজনীতিতে চালু নেই। বিএনপি নেতারা গৎবাঁধা শব্দাবলী দিয়ে কণ্ঠশীলন করতেই থাকবেন আর দূরত্ব বাড়তে থাকবে জনগণের সঙ্গে।
আমি বিশ্বাস করি এসব অশোভন অমার্জিত কাজের জন্য অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রুচিবান বিএনপি সমর্থকও দারুণ বিব্রত ও ক্ষুব্ধ। নির্বাচনে তাদের আন্তরিকভাবে সক্রিয় করা কঠিন হবে। পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও বিএনপির জন্য কুসুমাস্তীর্ণ পথ করে দেবে না। সব মিলিয়ে বিএনপির নির্বাচনী পথ খুব সরল বলে মনে হয় না। এসব কারণেই বলব, দলকে সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় রেখে শক্তিশালী হওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়াই হবে বিএনপির জন্য উত্তম। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যদি নিজেদের না শুধরে ক্রমে সাধারণ মানুষের বিরক্তির কারণ হতে থাকেন, তবে পাপ স্বীকার করতে পারলে নববিএনপি সামনে চলে আসার সুযোগ পাবে। সে সুযোগ সাধারণ মানুষই তাদের দেবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়