ক্ষুধা নিবারণ ও খাদ্য অপচয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ খাবারের ব্যাপারে লাজু ভারতীয় খাবারেই লেগে থাকলো। ইতালিয়ান পর্ব শেষ করে হেলেনও যোগ দিল ভারতীয় খাবারে। পুত্ররা জাপান পর্ব শেষ করে ইতালিতে চলে গেল পিজ্জা পাস্তার জন্য। আর আমি ঘুরে ঘুরে মেডিটেরিনিয়ান, ইতালিয়ান, এরাবিয়ান ডিস থেকে একটু একটু করে পছন্দসই খাবার নিয়ে উদেরকে বানিয়ে দিলাম পুরোপুরি ইন্টারন্যাশনাল।
মূল খাওয়ার পার্ট শেষ করে তখন চাখছিলাম ডেজার্ট। অভ্র ডেজার্ট খাওয়া শেষ করে মহা আনন্দে ঘুরে বেরাচ্ছিল রেস্টুরেন্টময়। দু’তিনটা টেবিলে তখনো আরো কিছু গেস্ট ধীরে সুস্থে ডেজার্ট খেতে খেতে গল্প করছিল। রেস্টুরেন্ট কর্মীরা ব্যস্ত গোছগাছ করে আজ রাতের বুফের আয়োজনে যতি টানায়। হন্তদন্ত হয়ে এসময় অভ্র এসে বললো : ‘দেখো দেখো বাবা ওরা না সব ডেজার্টগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে, এতোগুলো মজার মজার খাবার কেনো ফেলে দিচ্ছে ওরা এ রকমভাবে?।
আরে তাইতো, অভ্রর কথাতো ঠিক টেবিলে বসেই গলা উঁচু করে দেখতে পেলাম দু’তিন জন এপ্রন পড়া হোটেল কর্মী, লম্বা ডেজার্ট টেবিলে সাজিয়ে রাখা নানা ধরনের কেক, পেষ্ট্রি , পুডিং, কাস্টার্ড , কাটা ফল টেনে টেনে নিচে রাখা পলিথিন মোড়ানো বাকেটে ফেলছে। বোঝাই যাচ্ছে এগুলোর জায়গা হবে অবশেষে রেস্টুরেন্টের বাইরের কোন ডাস্টবিনে।
পুরো দৃশ্যটি খুবই হৃদয়বিদারক মনে হলো। বুঝলাম এ রেস্টুরেন্টের নিয়ম নিশ্চয়ই এরকম, যে এক বেলার খাবার তারা অন্য বেলায় পরিবেশন করবে না। কিন্তু তার মানে তো এমন নয় যে খাবারগুলোকে ফেলে দিতে হবে ডাস্টবিনে! এ শহরে কি কি তবে এমন কোন লোক নেই যারা ঘুমাতে যাবে , আজ রাতে না খেয়ে? আসলে ক্ষুধাতো মানুষকে ঘুমুতেও দেয় না সহজে। সারাদিনের আনন্দে যে মন ছিলো আমার এতক্ষণ রৌদ্রকরোজ্জ্বল , এ ঘটনা এক ঝটকায় ওখানে টেনে দিল ঘোর ঘন কালো মেঘের চাদর।
আচ্ছা ঢাকার এ জাতীয় হোটেলগুলোর রেস্টুরেন্টও কি একই কাজ করে নাকি ? যদি তা করে বাংলাদেশে তবে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কি হতে পারে। যদিও বাংলাদেশ আজ আর আগের মতো ক্ষুধার্ত নয়, কিন্তু তা বলে তো আমরা এক্কেবারে ক্ষুধা মুক্ত হয়ে গেছি তাও তো বলা যায় না। এ সব প্রশ্ন আর ভাবনার ফাঁকেই চট করে ধরতে পারলাম দুপুর বেলায় লাঞ্চের সময় আমাদের ফ্রি ফ্রুট প্লেটার পাওয়ার মাজেজা!
বোঝা গেল প্রতিবেলায় বেঁচে যাওয়া খাবার যেহেতু ফেলে দেয়াই নিয়ম এদের, তাই দুপুরের খাবারের বেঁচে যাওয়া ফ্রুট ডেজার্ট যেগুলো তাদের ফেলে দিতে হতো, তার থেকে কিছুটা আমাদের দিয়েছিল কমপ্লিমেন্টারী হিসাবে। কারণ দুপুরের খাবারের সময় আমরা কোন ডেজার্টের অর্ডার করিনি। আর খেতেও এসেছিলাম আমরা একেবারে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার অল্প আগে।
অতএব ঐ সময়ের বেঁচে যাওয়া ফল পুরোটা ফেলে দেয়ার চেয়ে, কিছুটা আমাদের ফ্রি দেয়াটাই ভাল মনে করেছিল হয়তো রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার। এটা মনে হতেই কেমন যেন একটু সম্মানে লাগলো, এই ভেবে যে ; ফেলে দেবে যে খাবার সেটা কিনা দিয়েছে আমাদের! কেমন যেন কাংগাল ফকির মনে হলো নিজেদের। ছোটবেলায় যেমন, আম্মা বেঁচে যাওয়া খাবার ফকির মিসকিনের জন্য বরাদ্দ করতেন; তেমন মনে হলো ঘটনাটা।
ফিসফাস করে ডিনার টেবিলে এদিকে সবাই, হোটেলের খাবার এভাবে ফেলে দেয়াটা নিয়ে তুলেছে আপত্তির প্রবল ঝড়। বিশেষতঃ দীপ্র অভ্রর তীব্র আপত্তি ওতে। আমার নিজেরও কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে এটা। মনে হলো, দুপুরে পুরোটা না ফেলে দিয়ে, তার থেকে কিছুটা আমাদের ফ্রি দিয়েছে তাতেও ইগোতে লাগছে, আবার এখন সব ফেলে দিচ্ছে তাতেও খারাপ লাগছে!
খদ্দের হিসেবে নিজের মনেই যখন চলছে এমন দ্বন্দ্ব, তাহলে সমাধানটা কি করবে এরা ? মনের দ্বান্দ্বিক অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অচিরেই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম যে নাহ, না ফ্রি দেয়াটাই বরং ভালো। আজকালতো ঘরেও একবেলার বেঁচে যাওয়া খাবার আমরা নিজেরাই পরের বেলা খেয়ে ফেলি। খাবার চাওয়ার জন্য কোন ফকিরওতো আসে না বা আসতে পারে না অন্ততঃ আমরা যারা ঢাকাবাসী তাদের কাছে। এটাও মনে হলো যে আজকাল আমাদের খাদ্য সমস্যা অতো প্রকটও নয়।
তাই যে ভিক্ষা করে জীবনধারণ করে আজো আমাদের দেশে , সেও আজকাল টাকাই চায়, ভিক্ষা হিসাবে ; যা দিয়ে সে নিজ পছন্দ মতো খাবার কিনে খেতে চায়। আগের মতো কোন ঘরের বেঁচে যাওয়া খাবার বা উচ্ছিষ্ট নির্ভর নয় তারা। ভিক্ষুকের এই পছন্দ করার সামর্থ্যটুকু যে হয়েছে আজ আমাদের দেশে , তা মনে হতেই, মন ভালো হয়ে গেলো আবার। বাহ্‌ তরমুজটা তো বেশ মিষ্টি, কাটা চামচ দিয়ে ডেজার্ট প্লেট থেকে এক ফালি কমলা হলুদ রংয়ের তরমুজ মুখে দিতেই মনে হলো। এই এক অবাক ব্যাপার ! দেশে তরমুজের ভেতরটা টকটকে লাল হলেও মিষ্টি তেমন হয়না। অথচ ব্যাংকক এমনকি শ্রীলংকায় দেখেছি এখানকার এই কমলা হলুদ রংয়ের তরমুজগুলোও হয় চিনির মতো মিষ্টি!
আবারো ঘুরে মনে আসলো এদের খাবার ফেলে দেয়ার ব্যাপারটা, হজম হচ্ছে না চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা। ভাবলাম আচ্ছা ঢাকার এ জাতীয় হোটেলগুলোও কি একই কাজ করে না কি? মনে পড়লো তখন এক দিনের অভিজ্ঞতার কথা। আর তা হলো ঢাকার রাস্তায় কিছু কিছু এলাকায় ঠেলাগাড়ি, রিকশা ভ্যান এসবের উপর স্থাপিত কিছু ভ্রাম্যমাণ হোটেল, সবার মতো আমিও দেখি সবসময়।
এও জানি যেগুলোতে বেশ অল্প দামে কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাউ বিক্রি হয়। শ্রমিজীবী মানুষদের রাস্তার পাশে হাটুমুড়ে বসে ওগুলো বেশ আরাম করে খেতেও দেখেছি বহুবার। একবার ভাবলাম, এই চলমান রেস্টুরেন্ট মালিকের সাথে একটু কথা বলে জেনে নেই তার ব্যবসার গোমর। কিভাবে সে এত কমদামে কাচ্চি, মোরগ পোলাও এসব খাওয়াচ্ছে। নিশ্চয় এর থেকে সে লাভও করছে। আর না হলে তারই বা পেট চলবে কেন?
যেই ভাবা সেই কাজ, হাতে নিয়ে নিলাম ‘প্রজেক্ট ভাসমান রেস্টুরেন্ট’। টার্গেট হলেন একজন হোটেল মালিক যিনি নাকি তার ভ্যান রেস্টুরেন্ট নিয়ে বসেন ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৫ বা ৬ নম্বর রোডের কাছে। ব্যবসার গোমর জানতে হলে আগে খাতির জমাতে হবে তার সাথে। ছুটির দিনের দুপুরগুলোতে হাঁটতে গিয়ে দেখেছি তার জমজমাট ব্যবসা। কিন্তু শুরু করি কিভাবে প্রজেক্ট? আমিতো তার কাষ্টোমার না, হলাম তথাকথিত ‘স্যার’ নামের দূরের লোক। যে কিনা অসময়ে রাস্তায় হাঁটে খিদে বাড়ানোর জন্য, মেদ কমানোর জন্য! অতএব তার সাথে জমবে কথা কিভাবে?
কথায় আছে না ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়’ আমারো তাই হয়ে গেল উপায়। দেখলাম, নানান রাস্তায় , এলাকায় আমাদের ছোট বড় রেস্টুরেন্টগুলোর সামনে যেমন অতি অবশ্যই অন্তত একটি পান বিড়ি সিগারেটের টং থাকে , এই ভাসমান রেস্টুরেন্টের পাশেও বসেন বড় ফ্লাস্ক ভর্তি গরম চা আর ব্যাগভর্তি পান সিগারেট নিয়ে আরেক ভাসমান ব্যবসায়ী। তার কাছে পর পর ক’দিন চা খেতে খেতে এটা ওটা বলে ভাব জমিয়ে নিলাম, মোবাইল রেস্টুরেন্টের মালিকের সাথে।
এক সপ্তাহান্তের দিনে হাঁটতে বেড়িয়ে চা তৃষ্ণা মিটাতে গিয়ে দেখলাম রেস্টুরেন্ট মালিক ভ্যানের উপর বসে মহা আরামে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। কারণ তার খদ্দেরদের আসার সময় হয়নি তখনো। চা খেতে খেতে সুযোগ বুঝে জিজ্ঞাসা করলাম, কি কেরামতিতে তিনি এত কম দামে মোগলাই খাবার খাওয়ান মানুষদের। প্রথম বলতে চাচ্ছিলেন না। মজা করে বললাম দেখেন, আমার কিন্তু এরকম দোকান খুলে আপনার পাশে বসে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা নেই। অতএব নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আর এছাড়া আপনি যে একটা ভাল কাজ করছেন , মানে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে এত ভাল খাবার খাওয়াচ্ছেন এত কম দামে তা কিভাবে সম্ভব এটা জানার খুব ইচ্ছা আমার। ওতে একটা জিনিস শেখা হবে আমার, আপনার কাছ থেকে।
একথায় একটু মন গললো মনে হয় ভাই সাহেবের। তারপরও সরু চোখে সন্দেহ মাখা গলায় বললেন, “স্যার মজা করছেন আমার সাথে, আপনাদের মতো শিক্ষিত বড়লোককে আর আমি কিছু শিখাইতে পারুম? বুঝতে পারতেছি আপনে আমি কোন দুই নম্বরী করি কিনা খাওয়ার মধ্যে এইডা বুঝতে চান। আমি আসলে খারাপ কোন খাবার খাওয়াই না বা কমদামে এগুলো রান্না করার কোন পথও জানি না।
প্রতি রাইতে এই খাবার গুলি কিনি আমি দু তিনটা কমিউনিটি সেন্টার ঘুইরা। প্রতি রাইতের বাইচা যাওয়া কাচ্চি, মোরগ পোলাউ কমিউনিটি সেন্টারের বয় বেয়ারা বাবুর্চিরা অনেক রাতে বেইচা দেয়। তারা অনেক কমে টেবিলের ঝুটা খাওন ও বেচে। তয় আমি ওগুলো কিনি না। বেচুম ধানমন্ডিতে, দাম একটু বেশি নিমু। কিন্তু ঝুটা কিইন্যা বেশি দামে বেইচা হারাম লাব আমি করি না”।
শুনে ভাবি বলে কি এই ‘অশিক্ষিত’ লোক! আমরা বড় বড় ডিগ্রিধারীরা কত গলদঘর্ম হয়ে মুখস্থ করেছি বিপণন শাস্ত্রের ‘এমলর ’আর ইনি কিনা রাস্তার পাশে বসে কোন কিছু না পড়েই করে ফেলছেন ফোর পি’র সার্থক প্রয়োগ! আসলে স্বশিক্ষার উপরে কোন শিক্ষাই নাই। না না আপনি যে দুই নম্বরি করেন না তা আমি বুঝি, মুখে বললাম।
‘স্যার আমার জানামতে একজনতো পায় হোটেল সোনারগাঁর সাপ্লাই। অতএব আমাগো খাওন এট্টু বাসি কইতে পারেন কিন্তু দুই নম্বর না”। বলেন তিনি। এর মধ্যে চলে এসেছে দু’তিনজন বান্ধা কাস্টমার তার। ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি, আমিও আবার শুরু করি আমার দ্বিপ্রাহরীকহন্টন।
হাঁটতে হাঁটতে চট করে বুঝতে পারি কমিউনিটি সেন্টারের বিয়েতে হঠাৎ খাওয়ার সর্ট পড়ার কারণ। আর সোনারগাঁ এর ব্যাপারে ভাবলাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখেছি , বিভিন্ন জন বুফের নিয়ম মাফিক তার পছন্দের খাবার টুকু অল্প অল্প করে না নিয়ে, সব খাবারই বেশি বেশি প্লেটে তুলে নিয়ে খাবার মৈনাক পর্বত বানিয়ে নিয়ে খেতে বসেন টেবিলে। অতঃপর ঐ হিমালয়ের এক তৃতীয়াংশও অতিক্রম করতে না পেরে বেশির ভাগটা টাবিলে ফেলে রেখে দৌড়া ন ডেজার্ট পাহাড় বানানোর জন্য। ভাবলাম হায় উচ্ছিষ্ট খাবারগুলোই তাহলে বিক্রি করে রেস্টুরেন্টের লোকজন!
‘দেশটার আসলে কোনই ভবিষ্যত নেই, কারণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর ঢুকে গেছে দুর্নীতি’, প্রচলিত সকলের এই মতামতের সাথে একমত হয়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। কিন্তু হলাম না , কারণ তক্ষুণি মনে হলো আমাদের মার্সিডিজ, পাজেরো , বিএমডব্লিউ হাঁকানো ঋণখেলাপি ব্যাংক চোরদের কাছে তো এরা কিছুই না। কেন খালি খালি কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার ম্যানেজারদের এত খারাপ ভাবছি।
আর আজ এ কানমিংএর হোটেলটির রেস্টুরেন্টের বেঁচে যাওয়া খাবার নির্দয়ভাবে ফেলে দেয়া দেখে মনে হলো, নাহ আমাদের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোকে ও তো তাহলে একই নিয়ম মানতে হয়। তাদের রেস্টুরেন্টের বেঁচে যাওয়া খাবারও নিশ্চয় ফেলে দেয়াই নিয়ম। তবে হ্যাঁ; না ফেলে ওরা হয়তো একটু দুর্নীতি করে বিক্রি করে দেয় ওগুলো। কিন্তু এই ফেলে দেয়ার চেয়ে তো ওটা শতগুণ ভাল।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর