ঢাকা ০৮:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শীতের কুয়াশা ভেজা ফোটানোর থাকে আমাদের চেনা-অচেনা ফুল

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৪৭:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭
  • ৬২০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে ছয় ঋতুর মধ্যে শীতেই নানা বৈচিত্র্যের ফুল ফুটতে দেখা যায়। যদিও শীত ঋতুতে অনেক গাছের পাতা ঝরে যায়, প্রকৃতি হয়ে ওঠে রুক্ষ ও ধূসর। কিন্তু পাতাশূন্য গাছগুলোই কুয়াশায় ভিজে ফুল ফোটানোর আয়োজন করতে থাকে। শীতের রুক্ষ ও ধূসর প্রকৃতির ভেতর নানা রঙের বৈচিত্র্যময় এসব ফুল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আশ্চর্য সৌন্দর্য ছড়ায়।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে চেনা-অচেনা বিচিত্র বৃক্ষ। ফুলের সংখ্যাও নিতান্তই কম নয়। তবে যেগুলো আমরা এখন দেশি ফুল বলে জানি, তাদের অনেকগুলো এদেশে এসেছে বিভিন্ন শাসকের আমলে। আবার অনেক ফুল সৌখিন পুষ্পপ্রেমীদের মাধ্যমে আমাদের দেশে এসেছে। ক্রমেই এসব ফুলও আমাদের দেশের মাটি, জলবায়ু ও প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। যেমন গোলাপ। ভারতীয় উপমহাদেশে গোলাপ নিয়ে আসেন সম্রাট বাবর। পারস্যের এই গোলাপ ‘বসরা গোলাপ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। যদিও গোলাপ সারা বছরই ফোটে, তবে শীতেই গোলাপের সংখ্যা, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য বেশি লক্ষ করা যায়। কেবল গোলাপই-বা কেন, শীতের অসংখ্য ফুল রূপে, রঙে ও ঘ্রাণে আমাদের মন-প্রাণ মুগ্ধ ও আন্দোলিত করে।

দুই

শীতের অধিকাংশ ফুলের জন্মস্থান মূলত শীতপ্রধান দেশে। বাংলাদেশে শীত ঋতুতে ঘন কুয়াশা এসব বিদেশি ফুলের গাছ রোপণ ও ফুল ফোটার জন্য বেশ উপযুক্ত আবহাওয়া। বিদেশি এসব ফুলের মধ্যে অন্যতম হল— ডালিয়া, ক্রিসেন্থেমাম, বাটন, কারনেশন, জিনিয়া, কসমস, পিটুনিয়া, হলিহক, এস্টার, সুইটপি, ফ্লকস্, পর্টুলেখা, ডেইজি, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, ক্যালেন্ডুলা, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস প্রভৃতি। এসব বিদেশি ফুল কবে কীভাবে এদেশে এসেছে তা আজ অনেকটাই অজানা। তবে এসব বিদেশি ফুল এদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। এখন এসব ফুল আমাদের বাগান বা বাড়ির বারান্দা ও ছাদের টবে শোভা বিস্তার করে চলেছে।

বিদেশি ফুলের পাশাপাশি বাংলাদেশের মাটির নিজস্ব ফুলও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশের নিজস্ব ফুলের মধ্যে অনেকগুলোই বনজঙ্গলে ফোটে, আধুনিক নগরে হয়ত সেসব ফুলের স্থান খুব একটা নেই। তবু তাদের হদয়কাড়া সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ অকৃত্রিম। এসব ফুলের আবার কোনো কোনোটি ফল, সবজি বা শস্য হিসেবেও মানুষ দৈনন্দিন জীবনে গ্রহণ করেছে। যেমন শিম ফুল, লাউ ফুল, ফুল কপি, সরিষা ফুল, পেঁয়াজ ফুল, ধনিয়া ফুল ইত্যাদি। এছাড়া সবজি হিসেবে খুবই জনপ্রিয় টমেটো বা বেগুন— এদের ফুল ছোট হলেও বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে অনন্য। এছাড়া শ্বেত-শিমুল, তুলসি, কণ্টিকারি, ধাইরা, শিয়ালমুতি, উলটচ্লাল, খেজুর প্রভৃতি গাছে শীত মওসুমে ফুল ফোটে।

বনজঙ্গল, ক্ষেতখামার থেকে শুরু করে পাহাড়ি এলাকায় শীতের সময় প্রচুর ফুটতে দেখা যায় শেয়ালকাঁটা ফুল। এটির কাঁটাযুক্ত কাণ্ড ও পাতা তীক্ষ্ম ও ধারালো কাঁটায় পূর্ণ, হালকা সবুজ রঙের। ২ থেকে ৩ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট। ফুল হলুদ রঙের ও হালকা গন্ধযুক্ত। শেয়ালকাঁটা ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ। জ্বর, কৃমি, পিত্ত ও কফনাশক হিসেবে শেয়ালকাঁটা উদ্ভিদ ব্যাবহূত হয়। বাংলার নিজস্ব প্রজাতির আরেক ফুল হল দশবাইচ্লী। নামটা বিদঘুটে হলেও ফুলটি দেখতে খুবই সুন্দর। ছোট ছোট গাছের দেহজুড়ে প্রজাপতির মতো দেখতে এক একটি ফুল ফোটে। ফুলের রঙ সাধারণত নীল। তবে হলুদ ও গোলাপি রঙের ফুলও দেখা যায়। এসব ফুল গাছের জন্য আলাদা কোনো যত্ন বা পরিচর্যার দরকার হয় না। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বনজঙ্গলে এসব ফুল ফুটতে দেখা যায়।

তিন

শীতে বাংলাদেশে জন্মানো ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গাঁদা ফুল। বিভিন্ন রঙ ও প্রজাতির গাঁদা ফুল রয়েছে। কোনোটা ঝলমলে হলুদ, কোনোটা হলদে কমলায় মেশানো, কোনোটা দেখতে একেবারে কমলা রঙের, আবার হলুদ পাপড়ির থোকার মধ্যে খয়েরি রঙের পাপড়িও রয়েছে। ফুলের আকার আকৃতির পার্থক্যও একেবারে কম নয়। কোনোটা ছোট কোনোটা বেশ বড়।

শীতের আরেক বৈচিত্র্যময় ও নজরকাড়া ফুল ডালিয়া। বিভিন্ন প্রজাতির ডালিয়া রয়েছে। এদের পাপড়ির সৌন্দর্য আর চমত্কার বিন্যাস সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। ফুলের মঞ্জুরির আকার আকৃতি ভেদে ডালিয়ার কমপক্ষে দশটি শ্রেণি রয়েছে। মূলত ডালিয়ার কন্দজাতীয় মূল দিয়ে নতুন চারা তৈরি করা হয়। তাছাড়া কচি ডালের কাটিং করেও চারা তৈরি করা যায়। কাটিং থেকে তৈরি চারার ফুল সাধারণত আকারে বড় হয়।

শীতের আরেকটি সুদৃশ্য ফুলের নাম ক্রিসেন্থেমাম। এর বাংলা নাম চন্দ্রমল্লিকা। শতাধিক প্রজাতির চন্দ্রমল্লিকা রয়েছে। রঙের দিক থেকেও এরা অতুলনীয়। বীজ, কলম বা মূল থেকে প্রকাশিত কুশির মাধ্যমেও এদের বংশবিস্তার করা যায়। শীতের আরেক ফুল কসমসের আদিনিবাস মেক্সিকোতে। প্রজাতি ভেদে এদেরও রঙে রয়েছে ভিন্নতা। গ্যাজানিয়া সামপ্রতিক সময়ে শীত মৌসুমের জনপ্রিয় ফুল। এই ফুল অনেকটা সূর্যমুখীর মতো। সাদা, লাল, কমলা, হলুদ রঙের ফুল হয়। পাহাড়ি এলাকায় এরা ভালো জন্মে। এর আদিনিবাস দক্ষিণ আফ্রিকা। সালভিয়া মেক্সিকোর আরেক ফুল। এক-একটি লম্বা দ্লের ওপর এক-একটি ফুল ফোটে। প্রজাতি ভেদে ফুলের রঙও ভিন্ন হয়। কসমসের যেমন লাল রঙের ফুল রয়েছে তেমনি রয়েছে গোলাপি রঙের ফুলও। আবার নীল রঙের ফুল যেমন আছে, তেমনি আছে সাদা রঙের ফুল। শীতের ফ্যাকাশে ভাবকে রঙে রঙে রঙিন করে তোলে সালভিয়া নামের এই বিদেশি ফুল। ক্যালেন্ডুলা শীতের ফুল কমলা রঙের। তবে লাল ও হলুদ রঙের ক্যালেন্ডুলাও দেখা যায়। দক্ষিণ আমেরিকার সুগন্ধী ফুল পিটুনিয়া। ঘণ্টাকৃতির ফুল ফোটে গাছের ডালে। সাদা, বেগুনি, গোলাপি প্রভৃতি রঙের ফুল ফোটে এদের জাতভেদে। শীতের আরেক ফুল অ্যাস্টার। বিভিন্ন প্রজাতির অ্যাস্টারের রয়েছে বাহারি রঙের মুগ্ধতা।

বাংলাদেশে শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল কম হলেও বিভিন্ন দেশের ফুল চমত্কারভাবে মানিয়ে গেছে এদেশের পরিবেশের সঙ্গে। পরিকল্পিতভাবে ফুলের গাছ লাগাতে পারলে কনকনে শীত মৌসুমে বাগান ও পরিবেশ নানা রঙের ফুল ফোটানো সম্ভব। এতে একদিকে আমাদের চারপাশ হয়ে উঠবে সৌন্দর্যম্লিত, মন হবে প্রফুল্ল এবং ফুল রপ্তানি করেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।

চার

শীতের ফুল ফোটানোর জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে গাছ লাগানো প্রয়োজন। এ জন্য রোদেলা জায়গা বেছে নিতে হবে। পুরোনো গাছ ফেলে দিয়ে কলম বা কন্দ থেকে তৈরি গাছ লাগালে তাতে ফুল সংখ্যায় বেশি ও আকারে বড় হয়। পানি দেয়ার সময় শুধু গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে ঝাঁজরি দিয়ে গাছের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো গাছ-পাতা ভিজিয়ে হালকা পানি দিতে হবে। তবে গাছের গোড়া ভেজা থাকলে পানি না দেয়াই ভালো। গাছের চেহারা দুর্বল দেখা গেলে পরপর তিন-চার দিন এক ঝাঁজরি পানির মধ্যে দুই চা চামচ ইউরিয়া সার গুলে ওপরের নিয়মে সেচ দিতে হবে। সরিষার খইল কয়েক দিন একটি পাত্রে ভিজিয়ে রেখে তা গুলে ১৫ দিন পরপর গাছের গোড়ার চারদিকে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া কেঁচো সার ব্যবহার উত্তম। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ভালো ফুল পেতে হলে প্রতি ১০-১৫ দিন পরপর গাছের গোড়ার মাটি হালকা নিড়িয়ে দিতে হবে। গাছের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ডাল ও বাড়তি পাতা কেটে দিলে ফুল আকারে বড় হয়।

পাঁচ

শীতের ফুল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা উত্সব, বিয়ে, জন্মদিন থেকে শুরু করে প্রেম নিবেদন, এমনকি মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বা প্রয়াতদের স্মরণ-অনুষ্ঠানে ব্যবহূত হয়।

তাছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস শীতে বা শীতের আবহাওয়ার আমেজে অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের এই মহান দিবসগুলো স্মরণের জন্য এদেশের মানুষ ফুলে ফুলে ঢেকে দেয় শহিদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ। শীতের ফুল তাই আমাদের জীবন ও জাতিসত্তার পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

লেখক: প্রকৃতি ও নগর সৌন্দর্যবিদ

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

শীতের কুয়াশা ভেজা ফোটানোর থাকে আমাদের চেনা-অচেনা ফুল

আপডেট টাইম : ০৬:৪৭:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে ছয় ঋতুর মধ্যে শীতেই নানা বৈচিত্র্যের ফুল ফুটতে দেখা যায়। যদিও শীত ঋতুতে অনেক গাছের পাতা ঝরে যায়, প্রকৃতি হয়ে ওঠে রুক্ষ ও ধূসর। কিন্তু পাতাশূন্য গাছগুলোই কুয়াশায় ভিজে ফুল ফোটানোর আয়োজন করতে থাকে। শীতের রুক্ষ ও ধূসর প্রকৃতির ভেতর নানা রঙের বৈচিত্র্যময় এসব ফুল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আশ্চর্য সৌন্দর্য ছড়ায়।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে চেনা-অচেনা বিচিত্র বৃক্ষ। ফুলের সংখ্যাও নিতান্তই কম নয়। তবে যেগুলো আমরা এখন দেশি ফুল বলে জানি, তাদের অনেকগুলো এদেশে এসেছে বিভিন্ন শাসকের আমলে। আবার অনেক ফুল সৌখিন পুষ্পপ্রেমীদের মাধ্যমে আমাদের দেশে এসেছে। ক্রমেই এসব ফুলও আমাদের দেশের মাটি, জলবায়ু ও প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। যেমন গোলাপ। ভারতীয় উপমহাদেশে গোলাপ নিয়ে আসেন সম্রাট বাবর। পারস্যের এই গোলাপ ‘বসরা গোলাপ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। যদিও গোলাপ সারা বছরই ফোটে, তবে শীতেই গোলাপের সংখ্যা, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য বেশি লক্ষ করা যায়। কেবল গোলাপই-বা কেন, শীতের অসংখ্য ফুল রূপে, রঙে ও ঘ্রাণে আমাদের মন-প্রাণ মুগ্ধ ও আন্দোলিত করে।

দুই

শীতের অধিকাংশ ফুলের জন্মস্থান মূলত শীতপ্রধান দেশে। বাংলাদেশে শীত ঋতুতে ঘন কুয়াশা এসব বিদেশি ফুলের গাছ রোপণ ও ফুল ফোটার জন্য বেশ উপযুক্ত আবহাওয়া। বিদেশি এসব ফুলের মধ্যে অন্যতম হল— ডালিয়া, ক্রিসেন্থেমাম, বাটন, কারনেশন, জিনিয়া, কসমস, পিটুনিয়া, হলিহক, এস্টার, সুইটপি, ফ্লকস্, পর্টুলেখা, ডেইজি, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, ক্যালেন্ডুলা, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস প্রভৃতি। এসব বিদেশি ফুল কবে কীভাবে এদেশে এসেছে তা আজ অনেকটাই অজানা। তবে এসব বিদেশি ফুল এদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। এখন এসব ফুল আমাদের বাগান বা বাড়ির বারান্দা ও ছাদের টবে শোভা বিস্তার করে চলেছে।

বিদেশি ফুলের পাশাপাশি বাংলাদেশের মাটির নিজস্ব ফুলও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশের নিজস্ব ফুলের মধ্যে অনেকগুলোই বনজঙ্গলে ফোটে, আধুনিক নগরে হয়ত সেসব ফুলের স্থান খুব একটা নেই। তবু তাদের হদয়কাড়া সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ অকৃত্রিম। এসব ফুলের আবার কোনো কোনোটি ফল, সবজি বা শস্য হিসেবেও মানুষ দৈনন্দিন জীবনে গ্রহণ করেছে। যেমন শিম ফুল, লাউ ফুল, ফুল কপি, সরিষা ফুল, পেঁয়াজ ফুল, ধনিয়া ফুল ইত্যাদি। এছাড়া সবজি হিসেবে খুবই জনপ্রিয় টমেটো বা বেগুন— এদের ফুল ছোট হলেও বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে অনন্য। এছাড়া শ্বেত-শিমুল, তুলসি, কণ্টিকারি, ধাইরা, শিয়ালমুতি, উলটচ্লাল, খেজুর প্রভৃতি গাছে শীত মওসুমে ফুল ফোটে।

বনজঙ্গল, ক্ষেতখামার থেকে শুরু করে পাহাড়ি এলাকায় শীতের সময় প্রচুর ফুটতে দেখা যায় শেয়ালকাঁটা ফুল। এটির কাঁটাযুক্ত কাণ্ড ও পাতা তীক্ষ্ম ও ধারালো কাঁটায় পূর্ণ, হালকা সবুজ রঙের। ২ থেকে ৩ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট। ফুল হলুদ রঙের ও হালকা গন্ধযুক্ত। শেয়ালকাঁটা ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ। জ্বর, কৃমি, পিত্ত ও কফনাশক হিসেবে শেয়ালকাঁটা উদ্ভিদ ব্যাবহূত হয়। বাংলার নিজস্ব প্রজাতির আরেক ফুল হল দশবাইচ্লী। নামটা বিদঘুটে হলেও ফুলটি দেখতে খুবই সুন্দর। ছোট ছোট গাছের দেহজুড়ে প্রজাপতির মতো দেখতে এক একটি ফুল ফোটে। ফুলের রঙ সাধারণত নীল। তবে হলুদ ও গোলাপি রঙের ফুলও দেখা যায়। এসব ফুল গাছের জন্য আলাদা কোনো যত্ন বা পরিচর্যার দরকার হয় না। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বনজঙ্গলে এসব ফুল ফুটতে দেখা যায়।

তিন

শীতে বাংলাদেশে জন্মানো ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গাঁদা ফুল। বিভিন্ন রঙ ও প্রজাতির গাঁদা ফুল রয়েছে। কোনোটা ঝলমলে হলুদ, কোনোটা হলদে কমলায় মেশানো, কোনোটা দেখতে একেবারে কমলা রঙের, আবার হলুদ পাপড়ির থোকার মধ্যে খয়েরি রঙের পাপড়িও রয়েছে। ফুলের আকার আকৃতির পার্থক্যও একেবারে কম নয়। কোনোটা ছোট কোনোটা বেশ বড়।

শীতের আরেক বৈচিত্র্যময় ও নজরকাড়া ফুল ডালিয়া। বিভিন্ন প্রজাতির ডালিয়া রয়েছে। এদের পাপড়ির সৌন্দর্য আর চমত্কার বিন্যাস সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। ফুলের মঞ্জুরির আকার আকৃতি ভেদে ডালিয়ার কমপক্ষে দশটি শ্রেণি রয়েছে। মূলত ডালিয়ার কন্দজাতীয় মূল দিয়ে নতুন চারা তৈরি করা হয়। তাছাড়া কচি ডালের কাটিং করেও চারা তৈরি করা যায়। কাটিং থেকে তৈরি চারার ফুল সাধারণত আকারে বড় হয়।

শীতের আরেকটি সুদৃশ্য ফুলের নাম ক্রিসেন্থেমাম। এর বাংলা নাম চন্দ্রমল্লিকা। শতাধিক প্রজাতির চন্দ্রমল্লিকা রয়েছে। রঙের দিক থেকেও এরা অতুলনীয়। বীজ, কলম বা মূল থেকে প্রকাশিত কুশির মাধ্যমেও এদের বংশবিস্তার করা যায়। শীতের আরেক ফুল কসমসের আদিনিবাস মেক্সিকোতে। প্রজাতি ভেদে এদেরও রঙে রয়েছে ভিন্নতা। গ্যাজানিয়া সামপ্রতিক সময়ে শীত মৌসুমের জনপ্রিয় ফুল। এই ফুল অনেকটা সূর্যমুখীর মতো। সাদা, লাল, কমলা, হলুদ রঙের ফুল হয়। পাহাড়ি এলাকায় এরা ভালো জন্মে। এর আদিনিবাস দক্ষিণ আফ্রিকা। সালভিয়া মেক্সিকোর আরেক ফুল। এক-একটি লম্বা দ্লের ওপর এক-একটি ফুল ফোটে। প্রজাতি ভেদে ফুলের রঙও ভিন্ন হয়। কসমসের যেমন লাল রঙের ফুল রয়েছে তেমনি রয়েছে গোলাপি রঙের ফুলও। আবার নীল রঙের ফুল যেমন আছে, তেমনি আছে সাদা রঙের ফুল। শীতের ফ্যাকাশে ভাবকে রঙে রঙে রঙিন করে তোলে সালভিয়া নামের এই বিদেশি ফুল। ক্যালেন্ডুলা শীতের ফুল কমলা রঙের। তবে লাল ও হলুদ রঙের ক্যালেন্ডুলাও দেখা যায়। দক্ষিণ আমেরিকার সুগন্ধী ফুল পিটুনিয়া। ঘণ্টাকৃতির ফুল ফোটে গাছের ডালে। সাদা, বেগুনি, গোলাপি প্রভৃতি রঙের ফুল ফোটে এদের জাতভেদে। শীতের আরেক ফুল অ্যাস্টার। বিভিন্ন প্রজাতির অ্যাস্টারের রয়েছে বাহারি রঙের মুগ্ধতা।

বাংলাদেশে শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল কম হলেও বিভিন্ন দেশের ফুল চমত্কারভাবে মানিয়ে গেছে এদেশের পরিবেশের সঙ্গে। পরিকল্পিতভাবে ফুলের গাছ লাগাতে পারলে কনকনে শীত মৌসুমে বাগান ও পরিবেশ নানা রঙের ফুল ফোটানো সম্ভব। এতে একদিকে আমাদের চারপাশ হয়ে উঠবে সৌন্দর্যম্লিত, মন হবে প্রফুল্ল এবং ফুল রপ্তানি করেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।

চার

শীতের ফুল ফোটানোর জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে গাছ লাগানো প্রয়োজন। এ জন্য রোদেলা জায়গা বেছে নিতে হবে। পুরোনো গাছ ফেলে দিয়ে কলম বা কন্দ থেকে তৈরি গাছ লাগালে তাতে ফুল সংখ্যায় বেশি ও আকারে বড় হয়। পানি দেয়ার সময় শুধু গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে ঝাঁজরি দিয়ে গাছের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো গাছ-পাতা ভিজিয়ে হালকা পানি দিতে হবে। তবে গাছের গোড়া ভেজা থাকলে পানি না দেয়াই ভালো। গাছের চেহারা দুর্বল দেখা গেলে পরপর তিন-চার দিন এক ঝাঁজরি পানির মধ্যে দুই চা চামচ ইউরিয়া সার গুলে ওপরের নিয়মে সেচ দিতে হবে। সরিষার খইল কয়েক দিন একটি পাত্রে ভিজিয়ে রেখে তা গুলে ১৫ দিন পরপর গাছের গোড়ার চারদিকে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া কেঁচো সার ব্যবহার উত্তম। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ভালো ফুল পেতে হলে প্রতি ১০-১৫ দিন পরপর গাছের গোড়ার মাটি হালকা নিড়িয়ে দিতে হবে। গাছের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ডাল ও বাড়তি পাতা কেটে দিলে ফুল আকারে বড় হয়।

পাঁচ

শীতের ফুল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা উত্সব, বিয়ে, জন্মদিন থেকে শুরু করে প্রেম নিবেদন, এমনকি মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বা প্রয়াতদের স্মরণ-অনুষ্ঠানে ব্যবহূত হয়।

তাছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস শীতে বা শীতের আবহাওয়ার আমেজে অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের এই মহান দিবসগুলো স্মরণের জন্য এদেশের মানুষ ফুলে ফুলে ঢেকে দেয় শহিদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ। শীতের ফুল তাই আমাদের জীবন ও জাতিসত্তার পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

লেখক: প্রকৃতি ও নগর সৌন্দর্যবিদ