হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের স্বস্তি এসেছে সরকারে। কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি। এই স্বস্তি ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তির মূল কারণ জাতীয় রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বেশ কিছু সফলতা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। এর ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী রাজনীতির মাঠেও অনেকটা ভালো অবস্থানে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচন পর্যন্ত এই অবস্থান ধরে রাখতে তাই খুবই কৌশল ও সতর্কতার সঙ্গে সামনে এগোচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগ।
সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুই সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে সামনে নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে ও সাড়া ফেলে দিয়েছে সরকার; তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা ও নানামুখী উদ্যোগের কারণে মিয়ানমারকে চাপে ফেলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাশে পেয়েছে বাংলাদেশ। এরই ফলে শেষপর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করছে নানা মহল। এর আগে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে বিএনপিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে দিয়ে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি না দেওয়ায় রাজনৈতিক সফলতা দেখিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। বেশ সফলভাবেই উতরাতে পেরেছে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের ইস্যুটিও। সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) এবং ৫২ দেশের ১৮০টি সংসদ প্রতিনিধিনের উপস্থিতিতে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) সম্মেলন। এই দুই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছায় বলে মনে করা হচ্ছে।
একইভাবে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অগ্রগতি, রাজধানীতে বেশ কিছু ফ্লাইওভার উদ্বোধনসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সরকারকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পুরণে জনগণের আরো কাছে নিয়ে গেছে বলে মনে করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতিদান এবং সেই স্বীকৃতিকে দেশজুড়ে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যাপন-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে আরো বেশি আস্থাশীল করে তুলেছে। পাশাপাাশি ১৭৩ দেশের সৎ রাজনীতিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় অবস্থানে থাকার বিষয়টি বিশ্ব স্বীকৃতির অংশ হিসেবেই দেখছে দলটি। এসব ঘটনাকে সরকার ও আওয়ামী লীগ যে নিজেদের অর্জন হিসেবে দেখছে এবং তাতে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি এসেছে, তা গত কয়েক দিনে মন্ত্রী ও দলের নেতাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতা ও দলীয় ফোরামের সভায় ফুটে উঠেছে। এমনকি স্বস্তি ও আস্থার মনোভাব প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও।
এসব অর্জনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনেও জয়লাভ করবে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা। সরকারের প্রতি আস্থাশীল হওয়ায় জনগণ বিএনপিকে আর ভোট দেবে না বলেও মনে করছেন দলের নেতারা। এমনকি এই মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে চাঙা আওয়ামী লীগ এমনটাও ভাবছে, বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে আসবে। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সরকারের এসব অর্জনকে আমলে নিতে নারাজ। দলের মতে, সরকারকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করতেই হবে।
তবে ক্ষমতাসীনদের এমন স্বস্তি ও আস্থার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে পারছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকারের কিছু অর্জন আছে সত্য; কিন্তু অস্বস্তির ঘটনাও আছে। উন্নয়ন বা ইতিবাচক কিছু ঘটনার সংখ্যা দিয়ে জনপ্রিয়তা বা জনসমর্থন যাচাই করলে হবে না। নিজেদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা খাদ্য সংকটসহ কোনো কারণে জনগণ যেন কষ্ট না পায়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন যেটিকে ইতিবাচক মনে করছে, তার ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ইতিবাচক ও উন্নয়নের রাজনীতি করে। সহিংসতায় বিশ্বাস করে না। সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও উন্নয়নকাজের জন্য আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হবে। জনগণের মধ্যে আমরা ইতিবাচক আস্থা তৈরি করতে পেরেছি। নির্বাচন যত সামনে আসবে, সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। আশা করছি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। সে নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নেবে।’
সরকার ও আওয়ামী লীগের ভেতর যে স্বস্তির মনোভাব, তা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দলীয় ফোরামের সভায় ফুটে উঠেছে। দলীয় সূত্র মতে, এসব ফোরামে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি দলীয় ফোরামের অন্তত দুটি সভায় দলের সহকর্মীদের কাছে এই কথা ব্যক্ত করেন তিনি। পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে আবার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। গত ১১ নভেম্বর দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা তাদের কাছে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। ওই সভার উদ্ধৃতি দিয়ে এক নেতা জানান, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার নজির বাংলাদেশে নেই এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সেই নজির স্থাপন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তবে তিনি এ কথাও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জনগণের জন্য রাজনীতি করা ও তাদের ভাগ্য বদল করা।’
এমন স্বস্তির কারণ কী—জানতে চাইলে কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, আবার ক্ষমতায় আসার মতো কাজ করে দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাই তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার আত্মবিশ্বাস আওয়ামী লীগের থাকাটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করেছে। জনগণ এর প্রতিদান দেবে, এটাই নিয়ম। বিশেষ করে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস দলের নেতাদের উজ্জীবিত করেছে। আওয়ামী লীগকে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া তার পক্ষেই সম্ভব।
সর্বশেষ গত শনিবারের সমাবেশেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসার দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজকার-আলবদর-আলশামস, খুনি ও ইতিহাস বিকৃতকারীরা আর যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে। আগামীর বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিক মুক্তির ও সমৃদ্ধির বাংলাদেশ। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে দেশের ‘বিবেকবান’ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে না দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।
একইভাবে মন্ত্রী ও দলের শীর্ষ নেতারাও সরকারের স্বস্তির কথা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে গত শুক্রবার সেতুমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও উন্নয়নকাজের জন্য আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। আরো এক ধাপ এগিয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ২০২৯ সালেও বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এমন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচনী মাঠে থাকে, তখন নিজেদের বিজয়ের কথা বলে। অর্জনের কথা বলে। এটি রাজনৈতিক কৌশল। তবে এর বাইরে আওয়ামী লীগের জন্য কিছু স্বস্তিদায়ক বিষয় আছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্বীকৃতি, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সম্মতি ও চুক্তি-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সফলতা। এর বাইরেও আরো কিছু সফলতা আছে। তবে খুব বেশি স্বস্তিতে থাকা যাবে না। কিছু অস্বস্তিও আছে। এখনো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এখানে সরকারের মনিটরিং দুর্বলতা রয়েছে। যেসব বিষয়ে মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ থাকে, সেগুলো যেন না হয়ে দেখতে হবে। ব্যাংক খাতে ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ আস্থাহীন হয়ে উঠতে পারে।
একইভাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, যখন কোনো দল বা সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন নিজেদের শক্তিশালী ও জনপ্রিয় মনে করে। মনে করে ভালো করছে। ভালো হতে পারে। তবে সেটি নিজেদের অবস্থান থেকে বিচার করলে হবে না। এখানে ব্যক্তি প্রবল হয়। ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে সাম্প্রতিক আওয়ামী লীগের বেশ কিছু অর্জন আছে। দলটি জনগণের মধ্য থেকে উচ্চারিত রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে ভালো কিছু কাজও করেছে। তবে সফলতা বা অর্জন যে এক তরফা-তা মনে করার কারণ নেই। অন্যপক্ষের দুর্বলতা বা ব্যর্থতার কারণেও হতে পারে। তবে বিএনপি যে জনপ্রিয় দল, সেটিও মনে রাখতে হবে। ‘সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই হয় না। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয়। অনেক উন্নয়ন হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু সেটা কেন হলো, সেটাও ভাবতে হবে। নতুবা বড় ধরনের সংকটে পড়বে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে। যতটা সম্ভব সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য সমঝোতা দরকার’—বলেও মত দেন এই বিশ্লেষক।