হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওর, নদীর মিলনস্থল এই এলাকা। ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি জনপদ কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানা ।
জেমস রেনেলের মানচিত্রে অষ্টগ্রামের পূর্ব নাম “আটগাঁও” বলে খ্যাতি। ড. দীনেশ চন্দ্রের ময়মনসিংহ লিটারেরী মানচিত্রে অষ্টগ্রাম নামটি উল্লেখ আছে। ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানচিত্রটি প্রকাশ হয়। এই জনপদের নামটি ঠিক কবে থেকে অষ্টগ্রাম বলা হয় তা জানা যায়নি। তবে আটটি গ্রাম নিয়ে গঠিত বলে লোকমুখে আটগাঁও নামটি এখনও বিদ্যমান আছে।
নামকরনের দিক দিয়ে কথিত আছে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সাথে আসা আউলিয়াদের মধ্যে আটজন এই এলাকায় এসেছিলেন বলে এই উপজেলার নাম আট আউলিয়ার গ্রাম বা অষ্টগ্রাম করা হয়।
খ্রিষ্ট্রীয় দ্বাদশ শতকে বঙ্গাধিপতি বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বল্লাল সেনের অধিসামত্ম অনমত্ম দত্ত অষ্টগ্রামের কাস্তুল নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। অনমত্ম দত্তের সঙ্গে তার গুরু শ্রী কষ্ঠদ্বিজ এবং অনচরবর্গ এই এলাকায় আসেন। তারা এই এলাকার আটটি গ্রামে বসতি স্থাপন করার পর অষ্টগ্রাম নামের উৎপত্তি হওয়ার জনশ্রুতি আছে।
কবে কখন প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চল হিসেবে কিশোরগঞ্জের মানচিত্রে অষ্টগ্রামের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয় তা বলা মুশকিল। তবে পূর্বে বাজিতপুর থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল অষ্টগ্রাম। ১৯০৬ সালে অষ্টগ্রামে আউট পোস্ট থানা স্থাপিত হয়। ১৯৬২ সালে প্রশাসনিক থানা স্থাপিত ও ১৯৮৩ সালে উন্নীত থানা বা উপজেলা করা হয়।
আটটি গ্রাম/ইউনিয়নঃ অষ্টগ্রাম সদর, পূর্ব অষ্টগ্রাম, কাস্তুল, দেওঘর, বাঙ্গালপাড়া, কলমা, আদমপুর ও আবদুল্লাহপুর।
অষ্টগ্রামের আয়তন: ৩০০.৪৪ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°১৩´ থেকে ২৪°২৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°৫৯থেকে ৯০°১৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে মিটামইন, দক্ষিণে ব্রাহ্মণবড়ীয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলা, পূর্বে হবিগঞ্জের লাখাই ও বানিয়াচং উপজেলা, পশ্চিমে বাজিতপুর ও নিকলী উপজেলা।
জনসংখ্যা ১,৪৫,৫৫২; পুরুষ ৭৪৫৮০, মহিলা ৭০৯৭২। মুসলিম ১২৩১১৬ , হিন্দু ২২৩৪৭ , বৌদ্ধ ১৬ এবং অন্যান্য ৭৩ । (পুরোনো তথ্যানুযায়ী)
জলাশয় প্রধান নদী: মেঘনা, বরাক, কালনী ও ঘোড়াউত্রা। পদ্মা বিল, টোপা বিল, বাদ্রা বিল, চামিল বিল, মামদা বিল, মাটিহাটা বিল, ধোপা বিল, মোজানা বিল, বলিয়ান বিল, মনখোলা বিল উল্লেখযোগ্য।
প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদঃ পাথরের মসজিদ (কাসতাইল, আনুমানিক ১৪৪৬ খ্রি.), কুতুব মসজিদ (আনুমানিক ১৬ শতক)।
বিখ্যাত খাবারঃ অষ্টগ্রামের পনির, ইকরদিয়ার মুরালি।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিঃ ১৯৭১ সালে ৩ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পূর্ব অষ্টগ্রামের ইকরদিয়া গ্রামে ৩৫ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ৫ সেপ্টেম্বর সাভিয়ানগর গ্রামে পাকসেনারা আরও ২৫ জন লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অষ্টগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিসের তালিকা অনুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৩৭ জন।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানঃ মসজিদ ৮২, মন্দির ১৩, মাযার ১২, আখড়া ২১। কাস্ত্তল পাথরের মসজিদ (১৪৪৬), কুতুব মসজিদ (আনুমানিক ১৬ শতক)।
শিক্ষার হার গড় হার ৩৭.৪%; পুরুষ ৪২.৫%, মহিলা ৩২.০%।
হাটবাজার ও মেলাঃ অষ্টগ্রাম বাজার, মৌলভীবাজার, পূর্ব অষ্টগ্রাম বাজার, সাবিয়ানগর বাজার, কাস্তুল বাজার, বাঙ্গালপাড়া বাজার, আদমপুর বাজার, কলমা বাজার, খয়েরপুর বাজার ও আব্দুল্লাহপুর বাজার এবং বাঙ্গালপাড়ার চৌদ্দমাদালের মেলা (ভাটি এলাকার সবচেয়ে বড় মেলা) উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ অষ্টগ্রাম রোটারী ডিগ্রি কলেজ (সরকারিকরণ-২০১৬), অষ্টগ্রাম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় (সরকারিকরন-২০১৬), অষ্টগ্রাম হোসেনিয়া মাদ্রাসা, আব্দুল ওয়াদুদ উচ্চ বিদ্যালয়, হক সাহেব উচ্চ বিদ্যালয়, বাঙ্গালপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বঃ কাজী আবদুল বারী, শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার এমদাদুল হক, শহীদ বুদ্ধিজীবি ডাঃ আব্দুল আলীম, সৈয়দ নঈম (লাল সাব), বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক হায়দারী বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু নির্মল চন্দ্র সাহা রায়, হেনা রায়, ডিআইজি (প্রিজনস) শেখ তৌহিদুল ইসলাম শরীফ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবুবকর সিদ্দিক ও হাসনাত লালন, প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্থানঃ ঐতিহাসিক শাহ কুতুব মসজিদ, কাস্তুল পাথরের মসজিদ, কাস্তুল ঈশা খাঁ মানসিংহ যুদ্ধস্থল, মসজিদজাম ব্রহ্মাণী মন্দির, হাবিলী বাড়ি, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেতু, অষ্টগ্রাম-বাজিতপুর সড়ক, অষ্টগ্রাম উপজেলা অডিটরিয়াম, বড় হাওর সাব মার্সিবল সড়ক ইত্যাদি।
ইউটিউবে দেখতেঃ Austagram view লিখে সার্চ করতে পারেন।
বইঃ অষ্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আবুল কাশেম এর লেখা “অষ্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য” বইটি পড়তে পারেন। রকমারি ডট কম এ বইটি পাওয়া যায়।
অষ্টগ্রাম আসবেন কিভাবেঃ অষ্টগ্রাম উপজেলার সৌন্দর্য উপভোগের উত্তম সময় বর্ষাকাল। অষ্টগ্রামের হাওর দেখতে যেতে চাইলে নিম্নে প্রদত্ত নির্দেশনা মানতে হবে। ঢাকা থেকে বাস অথবা ট্রেনে করে কুলিয়ারচর, ভৈরব বাজার কিংবা বাজিতপুর এসে আপনাকে ট্রলার ভাড়া করতে হবে অথবা লঞ্চে চড়তে হবে। তবে, ট্রলার ভাড়া করাই শ্রেয় কারন লঞ্চে সব যাত্রী আপনাকে প্রত্যক্ষ করবে তাই আপনি হাওর’র সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেন না। কুলিয়ার চর, ভৈরব বাজার এবং বাজিতপুর থেকে আপনি ট্রলার ভাড়া করতে পারবেন। তবে, নৌকা ভাড়ার পূর্বে ঠিক করে নিন আপনি কতদুর যেতে চান।
কিশোরগঞ্জ থেকে আসতে হলে ট্রেনে সকাল ৭.৪৫ মিনিটের এগারোসিন্দুর ধরতে হবে, দুপুরে আসলে দুপুর ১২.৪৫ মিনিটের এগারোসিন্দুর ধরে আপনাকে নামতে হবে কুলিয়ারচর স্টেশনে। সেখান থেকে লঞ্চঘাটে এসে সকালের ৮.৩০ মিনিটের লঞ্চ, দুপুরে আসলে ১২.৩০ মিনিট অথবা ২.০০ টা এবং ৪.০০ টার লঞ্চে আসতে পারেন। এছাড়া সিএনজিতে আসলে কিশোরগঞ্জ বটতলা ও বত্রিশ আমলিতলা থেকে সিএনজিতে আসতে পারেন কুলিয়ারচর।
সেক্ষেত্রে ভাড়া জনপ্রতি পড়বে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। বাসে আসতে চাইলে কিশোরগঞ্জ গাইটাল বাসস্ট্যান্ড থেকে যাতায়াত বা অনন্যা পরিবহণের বাসে করে নামতে হবে কুলিয়ারচরের দ্বাড়িয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে জনপ্রতি অটো রিকশা ভাড়া ১০ টাকা করে লঞ্চঘাটে আসতে হবে।
কোথায় থাকবেনঃ জেলা পরিষদ ডাক বাংলো। কেয়ারটেকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সাথে আগেই যোগাযোগ করে বুকিং দিয়ে রাখবেন। কেয়ারটেকারের সাথে যোগাযোগ করলে রান্নার ব্যবস্থাও উনি করবেন।