সুস্থ রাজনীতি ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যের সনদ’ ঘোষণা করেছেন গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি রবিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ১১ দফার এই সনদের ঘোষণা দেন। এ সময় ড. কামাল হোসেন এই ১১ দফা বাস্তবায়নে ঝুঁকি নেবেন বলেও জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছি। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েই চলছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নীতি-আদর্শবহির্ভূত রুগ্ন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হচ্ছে। দুর্নীতি আজ রাষ্ট্র ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।’
প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘আমরা যদি সংবিধানের প্রতি অনুগত হই এবং ৩০ লাখ শহীদ ও আত্মত্যাগী নেতাদের নীতি আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত হই, তবে আমাদের উপর তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালনের সময় এখনই, যা একটি স্থিতিশীল সমাজ, পরিচ্ছন্ন সরকার, আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দেবে।’
তিনি বলেন, ‘আর সেই লক্ষ্যেই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে আমরা এ ১১ দফা জাতীয় ঐক্যের সনদ ঘোষণা করছি।’
ড. কামাল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১১ দফার জাতীয় ঐক্যের এই সনদ। এটি বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। এই ঐক্যের প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। বাঁধা আসলে তা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে।’
আপনি তো ঐক্যের ঘোষণা দিয়ে বিদেশ চলে যান, এবারো সে রকম হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের এই সংবিধান প্রণেতা বলেন, ‘ঝুঁকিতো আমি সারাজীবন নিয়েছি। এবার ১১ দফা জোরদার করতেও আমি ঝুঁকি নিব।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘জনগণের কাছে যাব। তারা যেভাবে বলবে, সেভাবেই নির্বাচন হবে। তাদের চাহিদা অনুসারেই নির্বাচন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
১১ দফা সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১১ দফা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব। গণসংযোগ, গণজাগরণ ও জাতীয় ঐক্য গড়ব। জনগণ যে পদ্ধতিতে বলবে সেই পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।’
ঘোষিত ১১ দফা সনদ
১. সমগ্র জাতি আজ একটি অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। যে পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। জাতীয় ঐক্য ও জনগণের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে যে জনগণ, তারাই ক্ষমতার মালিক। জনগণ সে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে।
২. কেবল কালোটাকা, সন্ত্রাস ও সশস্ত্র ক্যাডারমুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ সৎ, যোগ্য ও কার্যকর জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে।
৩. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সচেতনভাবে লালন করা।
৪. বহুদলীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় ও জনস্বার্থে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই জাতীয় লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে হবে।
৫. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে চরমপন্থা, অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাসবাদ ও বৈষম্যমূলক আচরণের কোনো স্থান আমাদের সমাজে অবশ্যই থাকবে না।
৬. সংবিধান অনুযায়ী আইনের প্রতি অনুগত থেকে জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যথেচ্ছা গ্রেফতার, বিনাবিচারে আটক, আটক অবস্থায় নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ বাংলাদেশ সংবিধান অনুমোদন করে না।
৭. সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী সুরক্ষিত মানবাধিকারের প্রতি অবশ্যই সকলকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অবশ্যই মুক্ত রাখতে হবে এবং শিক্ষার পরিবেশ, একাডেমিক মর্যাদা ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে অনুষদগুলোর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও পদন্নতি এবং ছাত্র ভর্তি ও ছাত্রের মান নির্ধারণে দলীয় বিবেচনার পরিবর্তে মেধা ও যোগ্যতাকে বিবেচনা করতে হবে।
৯. রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের যেকোনো প্রভাব থেকে মুক্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
১০. সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজ ও পরিবার সমূহের মধ্যকার বৈষম্যসমূহ দূর করার লক্ষ্যে সকল জনগণের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও জীবিকা নির্বাহের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে সমাজ থেকে শুধু দারিদ্র্যতাই দূর হবে না; বরং নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে।
১১. জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে কৃষক-শ্রমিকসহ সমাজের সকল মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেন জাতীয় সম্পদ ও মানবসম্পদকে সমন্বিত করে জাতীয় অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করা যায়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নীতি-কৌশল গ্রহণ করা আবশ্যক।