হাওর বার্তা ডেস্কঃ উন্নত দেশগুলোতে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে অনেক আগ থেকেই মাটিবিহীন ঘাস চাষ হয়ে আসছে। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগায় বর্তমানে আমাদের দেশেও মাটিবিহীন ঘাস চাষ শুরু হয়েছে। হাইড্রোফনিক পদ্ধতি আমাদের দেশে এখনও এতটা প্রসার লাভ না করলেও কৃষি বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করছেন।
গবাদিপশুর খাবারের চাহিদা পূরণ করতে এই পদ্ধতি দ্রুত কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। এই পদ্ধতির প্রসার ঘটনো গেলে কৃষিক্ষেত্রে সম্ভাবনার নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হবে-এমন আশা করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
মাটির স্পর্শ ছাড়াই পানির ওপর ফসল উৎপাদনের হাইড্রোফনিক পদ্ধতি আমাদের দেশে আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই ঘাসের পাশাপাশি সবজি ও ফসল উৎপাদনও করা সম্ভব। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিবিধ কারণে ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। তাই মাটি ছাড়াই পশুখাদ্যের চাহিদা পূরণে হাইড্রোফনিক চাষ পদ্ধতি হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট কৌশল।
জমিতে ঘাস চাষের প্রচলিত ধারণা বদলে ঘরের ভেতরে মাটি ছাড়া কেবল পানি ছিটিয়ে পশুখাদ্য উৎপাদিত হয় হাইড্রোফনিক ফডার নামের এই প্রযুক্তিতে। এই প্রযুক্তির ব্যবহারে পশুখাদ্য উৎপাদনে খরচও কম। এই খাদ্যে বাজারের দানাদার ও মাঠের সবুজ ঘাসের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান আছে। তাই ধীরে ধীরে বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, হাইড্রোফনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পশুখাদ্য তৈরি খুবই সম্ভাবনাময়। শুধু এই খাদ্য দিয়ে গরু, ছাগল, ভেড়া, খরগোশ ও রাজহাঁস পালন করা সম্ভব।
আমাদের দেশে এ পদ্ধতি নতুন হলেও উন্নত বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোফনিকপদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম সেখানে ঘরের ছাদ, পলি টানের, নেট হাউসে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। হাইড্রোনিক পদ্ধতিতে বীজ হিসেবে গম, বার্লি অথবা ভুট্টা ব্যবহৃত হয়। খামারিরা বাণিজ্যিকভাবে এই পদ্ধতি চালু করতে চাইলে তাদেরকে কারিগরি বিষয়ে সহযোগিতা করবে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ।
এছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) আওতায় বিভিন্ন এনজিও এবং উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ শুরু করেছেন। সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা তাদের মধ্যে একটি।
বাংলাদেশের যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামে ‘কৃষক বাড়ি’ও ‘যশোর ডেইরি’ খামারের উদ্যোক্তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করছেন। গম, ছোলা, খেসারি, ভুট্টা, সয়াবিন, মাষকলাইসহ বিভিন্ন শস্যের অঙ্কুরোদগম বীজ ব্যবহার করে খাদ্যটি উৎপাদন করা যায়।
সম্প্রতি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) আয়োজিত উন্নয়ন মেলায় ‘সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা’ সম্পর্কে জানা যায়। এ সংস্থা পিকেএসএফের সহায়তায় সাতক্ষীরা অঞ্চলে মাটি ছাড়াই ঘাসের এ চাষ প্রকল্প চালু করেছে। কৃষকদের এ বিষয়ে পরামর্শসহ কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা উন্নয়ন প্রচেষ্টার কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে গম ও ভুট্টা দিয়ে মাটি ছাড়াই ঘাষ চাষ করে সহজেই ঘাষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এছাড়া সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হলে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই কৃষকরা লাভবান হতে পারে।
তিনি বলেন, কৃষকরা এ নতুন পদ্ধতির সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে। এরইমধ্যে দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে এ পদ্ধতিতে ঘাস চাষ শুরু হয়েছে। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় পদ্ধতিটি কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে।
চাষ পদ্ধতি
হাইড্রোপনিক পদ্ধতি হলো এমন এক আধুনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে নিয়মিত পানির সঙ্গে খনিজ মিশ্রণ স্প্রের মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাটির কোনোরূপ সংস্পর্শ ছাড়াই ঘাস উৎপাদন সম্ভব। প্রথমে ভুট্টার বীজকে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর পানি ঝরিয়ে ভেজা চটের বস্তা অথবা কালো সুতি কাপড়ের ভেতরে করে ২৪ ঘণ্টা অন্ধকার স্থানে রাখতে হয়। শেষে এক পাশ ছিদ্রযুক্ত ট্রের ভেতরে পাতলা করে ওই বীজ বিছিয়ে কালো কাপড় দিয়ে দুই দিন ঢেকে রাখতে হবে। এই দুই দিন খেয়াল রাখতে হয়, বাইরের আলো-বাতাস যেন না লাগে। কাপড়টি সারাক্ষণ ভেজা রাখতে হয়। তৃতীয় দিন কাপড় সরিয়ে আধঘণ্টা পরপর পানি ছিটাতে হবে।
তারপর টিনশেডের একটি ঘরে বাঁশ বা কাঠের তাক বানিয়ে ট্রেগুলো সাজিয়ে রাখতে হয়। এক কেজি বীজ থেকে ৯ দিন পরে ৭ থেকে ৮ কেজি ঘাস পাওয়া যায়। পাঁচ বিঘা জমিতে যে পরিমাণ ঘাস উৎপাদিত হয়, মাত্র ৩০০ বর্গফুটের একটি টিনশেডের ঘরে সেই পরিমাণ হাইড্রোফনিক খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব।
হাইড্রোফনিক ফডার খাওয়ানোর উপকারিতা
গবেষণায় দেখা গেছে, গাভীকে আঁশ জাতীয় খাদ্যের ৪০-৫০% হাইড্রোফনিক খাদ্য খাওয়ালে ভাল ফল পাওয়া যায়। প্রায় ১০-১৫% দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এ ফডার খাওয়ার মাধ্যমে গাভীর ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ হার বৃদ্ধি পায়। এটি গাভীর আঁশ জাতীয় খাদ্যের পাশাপাশি উদ্ভিজ আমিষ ও নানাবিধ প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের উৎস হিসাবে কাজ করে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, হাইড্রোফনিক ফডার গাভীকে খাওয়ালে ৩ লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে পাশাপাশি দুধের ফ্যাট ও এসএনএফ (সলিড নট ফ্যাট) পর্যাক্রমে ০.৩%-০.৫% বৃদ্ধি পায়।