ঢাকা ০৬:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুই জোড়া খুনের নেপথ্যে পরকীয়া

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২৬:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৭
  • ২৭৪ বার
হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাত্র ১১ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীতে দুই জোড়া খুনেরই নেপথ্যে পরকীয়া। কাকরাইলে মা-ছেলেকে আর বাড্ডায় বাবা-মেয়েকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে কাকরাইলে একাধিক বিয়ের পরও বিভিন্ন অভিনেত্রীর সঙ্গে পরকীয়া চলছিল তার বাবা আবদুল করিমের। পরিবারের দাবি, তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তার পূর্ব পরিকল্পনায় শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাওনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ ইসলাম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে রামনা থানায় তিন জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার আসামিরা হলেন আবদুল করিম, তার তৃতীয় স্ত্রী শারমীন আক্তার মুক্তা ও মুক্তার ভাই আল-আমীন। এদের মধ্যে আবদুল করিম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তাকে গ্রেফতারের পর ছয়দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অপরদিকে বাড্ডায় মায়ের পরকীয়ার বলি বাবা শেখ জামিল ও তার শিশু কন্যা নুসরাত আক্তার জিদনীর মূল ঘাতক শাহিন মল্লিককে খুলনা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ঘাতক শাহিন।
পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে স্ত্রীর পরকীয়ার জেরেই বাবা-মেয়ে খুনের ঘটনা। স্ত্রী আরজিনার প্রেমিক শাহিন মল্লিক গতকাল খুলনায় পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। আরজিনা চেয়েছিল শাহিনকে জীবন সঙ্গী করতে। এ হত্যাকাণ্ডে প্রেমিক শাহিনসহ কমপক্ষে আরো চার ভাড়াটিয়া খুনি অংশ নেয়। খুনের ঘটনা ঘটিয়ে শাহিন প্রথমে কুমিল্লা পরে খুলনায় পালিয়ে যায়। পুলিশ বলেছে, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শেখ জামিল ও তার মেয়েকে হত্যা করা হয়। জামিলের স্ত্রী আরজিনা এ বিষয়ে সবকিছু জানতো। ওই বাড়ির মালিকের স্ত্রী নাসিমা দুলালও তাদের পরকীয়ার বিষয়টি জানতো।
মামলার তদনন্তকারী কর্মকর্তা ও বাড্ডা থানার এসআই শাখাওয়াত হোসেন বলেন, জোড়া খুনের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আরজিনার পরকীয়া প্রেমিক প্রধান সন্দেহভাজন ও দায়েরকৃত মামলার আসামি শাহিন মল্লিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামিলের স্ত্রী এবং শাহিনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরো বলেন, শুক্রবার সকালে খুলনা থেকে শাহিন ও তার স্ত্রী মাসুমাকে গ্রেফতার করা হয়। নিহত জামালের ভাই শেখ শামীম হোসেন বাদী হয়ে নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগম ও তার পরকীয়া প্রেমিক শাহিন মল্লিককে আসামি করে বাড্ডা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৪। বৃহস্পতিবার রাতে মামলাটি নথিভুক্ত হয়। মামলা নথিভুক্ত হওয়ার পর নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তিনি আরও বলেন, শাহিন মল্লিক পেশায় রং মিস্ত্রি। মামলায় পরকীয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। নিহতের পরিবারও একই দাবি করেছে। স্ত্রী আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহিনের যোগসাজশে জোড়া খুন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বুধবার রাতে হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যায় শাহিন ও তার স্ত্রী। পরে বিষয়টি জানাজানি হয় বৃহস্পতিবার ভোরে। অথচ বাড়ির মালিক বলছে রাত ১০টার পর তাদের গেট বন্ধ থাকে। শামীম হোসেন বলেন, শাহিনকে সাব-লেট ভাড়া দেওয়াই ছিল ভুল। জামিল অফিসে চলে গেলে তার স্ত্রী অরজিনার সঙ্গে আড্ডা দিতো শাহিন। এমনকি শাহিন কাজেও যেত না। শাহিনের স্ত্রী চাকরি করতো। এ সুযোগে তারা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে এ হত্যাকাণ্ড। গত বৃহস্পতিবার সকালে মধ্যবাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নারবাগের একটি চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলা থেকে গাড়িচালক  শেখ জামিল (৩৮) ও তার নয় বছর বয়সী মেয়ে নুসরাতের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে কাকরাইলে নিহত শামসুন্নাহারের স্বজনরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ তিন দিন আগেও স্বামীর মালিকানাধীন বাড়িতে ওঠার তৎপরতা চালিয়েছিলেন মুক্তা। প্রতিবেশীদের দাবি, এর আগে তিন দফায় একই চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। একাধিক বিয়ে আর বিপুল সম্পত্তির ভাগ-ভাটোয়ারার দ্বন্দ্বে মা-ছেলের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। নিহত শামসুন্নাহারের স্বামী আবদুল করিমের একাধিক বাড়ি থাকলেও তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা থাকতেন ভাড়া বাসায়। পুলিশ জানিয়েছে, আড়ত ব্যবসার পাশাপাশি পলওয়েল মার্কেটে বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে আবদুল করিমের। রাজমণি সিনেমা হলের পাশে একটি ভবনে চলচ্চিত্র প্রযোজনার অফিস বানিয়ে সেখানেই বসতেন করিম। এফডিসি কেন্দ্রিক কয়েকটি চলচ্চিত্রে অর্থলগ্নি করেছিলেন বলেও জানা যায়। এছাড়া নয়াপল্টন ও কাকরাইল এলাকায় তিনটি বাড়ি রয়েছে তার।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুল হক জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত করিমের তিন স্ত্রীর কথা জানতে পেরেছেন। এদের মধ্যে নিহত শামছুন্নাহার প্রথম স্ত্রী। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে তার এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর খোঁজ করছেন তারা। আর শারমিন মুক্তা করিমের তৃতীয় স্ত্রী। চলচ্চিত্র প্রযোজনার সুবাধে ২০১৩ সালে শারমিন মুক্তার সঙ্গে পরিচয়ের পর ২০১৫ সালে বিয়ে করেন তারা। শারমিন মুক্তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। ভাই ও মাকে নিয়ে নয়াপল্টন এলাকার ৩৮/বি গলির একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। কয়েকটি চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী জানান, তার বোন ধর্মানুরাগী ছিলেন। নিয়মিত তাবলিগ জামাতে অংশ নিতেন। তার বাড়িতেও ‘তালিমে’ অংশ নিতেন অনেকে। শামসুন্নাহারের নামে দুটি বাড়ি আর পলওয়েল মার্কেটের কয়েকটি দোকান লিখে দিয়েছিলেন করিম। তবে তিনি থাকতেন ভাড়া বাসায়। এসব নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা। আশরাফ আরও জানান, ভাড়া বাসা ছেড়ে কাকরাইলের বাসায় ওঠার জন্য অনেকবার চেষ্টা চালিয়েছেন মুক্তা। আর তাতে বাধা দেওয়ার কারণে শামসুন্নাহারের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ তিনদিন আগে বাসায় ঢুকে শামসুন্নাহারকে বেধড়ক মেরে বাসার জিনিসপত্র ভেঙে চলে আসেন মুক্তা। এই ঘটনা ফোনে আশরাফকে জানিয়ে মৃত্যুর শঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন শামসুন্নাহার। আশরাফ থানায় জিডি করার পরামর্শ দিলেও তা আর করেননি শামসুন্নাহার।
আবদুল করিমের পরিবার, প্রতিবেশী ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে আবদুল করিম শ্যামবাজারে মাথায় করে সবজি বিক্রি করতেন। এছাড়া গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজের বাইরে থেকে আলু কুড়িয়ে তা রাজধানীতে বিক্রি করতেন। এরপর হঠাৎ করেই শ্যামবাজারে পেঁয়াজ ও আদার আড়তের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে রাজধানীতে তিনটি বাড়ি, আড়তের দোকান ছাড়াও রাঙ্গামাটিতে ১৫০ বিঘা, গাজীপুরে ৫০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন আবদুল করিম। এসব জমি বিভিন্ন সময়ে দখল করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে তার নামে বিভিন্ন থানায় ৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। রমনা থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম আরও বলেন, তৃতীয় স্ত্রীকে ঘিরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করছি। পারিবারিক কলহ, তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম স্ত্রীর বনিবনা না হওয়া ও শামসুন্নাহারের ওপর কয়েকবার হামলাসহ নানা বিষয়কে কেন্দ্র করেই তদন্ত চলছে। একটি সূত্র জানায়, এর বাইরেও একাধিক নারীর সঙ্গে করিমের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। কাকরাইরের অফিসে নারীদের আনাগোনা ছিল প্রায় প্রতিদিন।
মা ও ছেলেকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার নিহতের স্বামী আবদুল করিম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী কথিত নায়িকা শারমিন আক্তার মুক্তাকে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম খুরশীদ আলমের আদালতে হাজির করে তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) আলী হোসেন ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের ছয়দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন রমনা থানা থেকে মামলাটির এজাহার আদালতে আসে। ঢাকা মহানগর হাকিম এজাহারটি গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৪ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দুই জোড়া খুনের নেপথ্যে পরকীয়া

আপডেট টাইম : ১২:২৬:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৭
হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাত্র ১১ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীতে দুই জোড়া খুনেরই নেপথ্যে পরকীয়া। কাকরাইলে মা-ছেলেকে আর বাড্ডায় বাবা-মেয়েকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে কাকরাইলে একাধিক বিয়ের পরও বিভিন্ন অভিনেত্রীর সঙ্গে পরকীয়া চলছিল তার বাবা আবদুল করিমের। পরিবারের দাবি, তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তার পূর্ব পরিকল্পনায় শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাওনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ ইসলাম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে রামনা থানায় তিন জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার আসামিরা হলেন আবদুল করিম, তার তৃতীয় স্ত্রী শারমীন আক্তার মুক্তা ও মুক্তার ভাই আল-আমীন। এদের মধ্যে আবদুল করিম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তাকে গ্রেফতারের পর ছয়দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অপরদিকে বাড্ডায় মায়ের পরকীয়ার বলি বাবা শেখ জামিল ও তার শিশু কন্যা নুসরাত আক্তার জিদনীর মূল ঘাতক শাহিন মল্লিককে খুলনা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ঘাতক শাহিন।
পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে স্ত্রীর পরকীয়ার জেরেই বাবা-মেয়ে খুনের ঘটনা। স্ত্রী আরজিনার প্রেমিক শাহিন মল্লিক গতকাল খুলনায় পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। আরজিনা চেয়েছিল শাহিনকে জীবন সঙ্গী করতে। এ হত্যাকাণ্ডে প্রেমিক শাহিনসহ কমপক্ষে আরো চার ভাড়াটিয়া খুনি অংশ নেয়। খুনের ঘটনা ঘটিয়ে শাহিন প্রথমে কুমিল্লা পরে খুলনায় পালিয়ে যায়। পুলিশ বলেছে, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শেখ জামিল ও তার মেয়েকে হত্যা করা হয়। জামিলের স্ত্রী আরজিনা এ বিষয়ে সবকিছু জানতো। ওই বাড়ির মালিকের স্ত্রী নাসিমা দুলালও তাদের পরকীয়ার বিষয়টি জানতো।
মামলার তদনন্তকারী কর্মকর্তা ও বাড্ডা থানার এসআই শাখাওয়াত হোসেন বলেন, জোড়া খুনের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আরজিনার পরকীয়া প্রেমিক প্রধান সন্দেহভাজন ও দায়েরকৃত মামলার আসামি শাহিন মল্লিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামিলের স্ত্রী এবং শাহিনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরো বলেন, শুক্রবার সকালে খুলনা থেকে শাহিন ও তার স্ত্রী মাসুমাকে গ্রেফতার করা হয়। নিহত জামালের ভাই শেখ শামীম হোসেন বাদী হয়ে নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগম ও তার পরকীয়া প্রেমিক শাহিন মল্লিককে আসামি করে বাড্ডা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৪। বৃহস্পতিবার রাতে মামলাটি নথিভুক্ত হয়। মামলা নথিভুক্ত হওয়ার পর নিহতের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তিনি আরও বলেন, শাহিন মল্লিক পেশায় রং মিস্ত্রি। মামলায় পরকীয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। নিহতের পরিবারও একই দাবি করেছে। স্ত্রী আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহিনের যোগসাজশে জোড়া খুন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বুধবার রাতে হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যায় শাহিন ও তার স্ত্রী। পরে বিষয়টি জানাজানি হয় বৃহস্পতিবার ভোরে। অথচ বাড়ির মালিক বলছে রাত ১০টার পর তাদের গেট বন্ধ থাকে। শামীম হোসেন বলেন, শাহিনকে সাব-লেট ভাড়া দেওয়াই ছিল ভুল। জামিল অফিসে চলে গেলে তার স্ত্রী অরজিনার সঙ্গে আড্ডা দিতো শাহিন। এমনকি শাহিন কাজেও যেত না। শাহিনের স্ত্রী চাকরি করতো। এ সুযোগে তারা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে এ হত্যাকাণ্ড। গত বৃহস্পতিবার সকালে মধ্যবাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নারবাগের একটি চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলা থেকে গাড়িচালক  শেখ জামিল (৩৮) ও তার নয় বছর বয়সী মেয়ে নুসরাতের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে কাকরাইলে নিহত শামসুন্নাহারের স্বজনরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ তিন দিন আগেও স্বামীর মালিকানাধীন বাড়িতে ওঠার তৎপরতা চালিয়েছিলেন মুক্তা। প্রতিবেশীদের দাবি, এর আগে তিন দফায় একই চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। একাধিক বিয়ে আর বিপুল সম্পত্তির ভাগ-ভাটোয়ারার দ্বন্দ্বে মা-ছেলের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। নিহত শামসুন্নাহারের স্বামী আবদুল করিমের একাধিক বাড়ি থাকলেও তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা থাকতেন ভাড়া বাসায়। পুলিশ জানিয়েছে, আড়ত ব্যবসার পাশাপাশি পলওয়েল মার্কেটে বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে আবদুল করিমের। রাজমণি সিনেমা হলের পাশে একটি ভবনে চলচ্চিত্র প্রযোজনার অফিস বানিয়ে সেখানেই বসতেন করিম। এফডিসি কেন্দ্রিক কয়েকটি চলচ্চিত্রে অর্থলগ্নি করেছিলেন বলেও জানা যায়। এছাড়া নয়াপল্টন ও কাকরাইল এলাকায় তিনটি বাড়ি রয়েছে তার।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুল হক জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত করিমের তিন স্ত্রীর কথা জানতে পেরেছেন। এদের মধ্যে নিহত শামছুন্নাহার প্রথম স্ত্রী। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে তার এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর খোঁজ করছেন তারা। আর শারমিন মুক্তা করিমের তৃতীয় স্ত্রী। চলচ্চিত্র প্রযোজনার সুবাধে ২০১৩ সালে শারমিন মুক্তার সঙ্গে পরিচয়ের পর ২০১৫ সালে বিয়ে করেন তারা। শারমিন মুক্তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। ভাই ও মাকে নিয়ে নয়াপল্টন এলাকার ৩৮/বি গলির একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। কয়েকটি চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী জানান, তার বোন ধর্মানুরাগী ছিলেন। নিয়মিত তাবলিগ জামাতে অংশ নিতেন। তার বাড়িতেও ‘তালিমে’ অংশ নিতেন অনেকে। শামসুন্নাহারের নামে দুটি বাড়ি আর পলওয়েল মার্কেটের কয়েকটি দোকান লিখে দিয়েছিলেন করিম। তবে তিনি থাকতেন ভাড়া বাসায়। এসব নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা। আশরাফ আরও জানান, ভাড়া বাসা ছেড়ে কাকরাইলের বাসায় ওঠার জন্য অনেকবার চেষ্টা চালিয়েছেন মুক্তা। আর তাতে বাধা দেওয়ার কারণে শামসুন্নাহারের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ তিনদিন আগে বাসায় ঢুকে শামসুন্নাহারকে বেধড়ক মেরে বাসার জিনিসপত্র ভেঙে চলে আসেন মুক্তা। এই ঘটনা ফোনে আশরাফকে জানিয়ে মৃত্যুর শঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন শামসুন্নাহার। আশরাফ থানায় জিডি করার পরামর্শ দিলেও তা আর করেননি শামসুন্নাহার।
আবদুল করিমের পরিবার, প্রতিবেশী ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে আবদুল করিম শ্যামবাজারে মাথায় করে সবজি বিক্রি করতেন। এছাড়া গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজের বাইরে থেকে আলু কুড়িয়ে তা রাজধানীতে বিক্রি করতেন। এরপর হঠাৎ করেই শ্যামবাজারে পেঁয়াজ ও আদার আড়তের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে রাজধানীতে তিনটি বাড়ি, আড়তের দোকান ছাড়াও রাঙ্গামাটিতে ১৫০ বিঘা, গাজীপুরে ৫০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন আবদুল করিম। এসব জমি বিভিন্ন সময়ে দখল করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে তার নামে বিভিন্ন থানায় ৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। রমনা থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম আরও বলেন, তৃতীয় স্ত্রীকে ঘিরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করছি। পারিবারিক কলহ, তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম স্ত্রীর বনিবনা না হওয়া ও শামসুন্নাহারের ওপর কয়েকবার হামলাসহ নানা বিষয়কে কেন্দ্র করেই তদন্ত চলছে। একটি সূত্র জানায়, এর বাইরেও একাধিক নারীর সঙ্গে করিমের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। কাকরাইরের অফিসে নারীদের আনাগোনা ছিল প্রায় প্রতিদিন।
মা ও ছেলেকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার নিহতের স্বামী আবদুল করিম ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী কথিত নায়িকা শারমিন আক্তার মুক্তাকে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম খুরশীদ আলমের আদালতে হাজির করে তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) আলী হোসেন ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের ছয়দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন রমনা থানা থেকে মামলাটির এজাহার আদালতে আসে। ঢাকা মহানগর হাকিম এজাহারটি গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৪ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন।