হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত ফেনী-১ আসনের নির্বাচনী এলাকায় জমে উঠেছে প্রাক-নির্বাচনী প্রচারণা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা ও পৌরসভা নিয়ে গঠিত ফেনী-১ আসন।
১৯৯০ থেকে ২০১৪, দীর্ঘ ২৪ বছর এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে কোনো প্রার্থী জয়লাভ করেননি। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এর বদল ঘটে জাসদ নেত্রী শিরিন আখতারের হাত ধরে। তবে তিনি মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচিত হন তিনি। এ ছাড়া নারীনেত্রী ও শ্রমিকনেত্রী হিসেবে তার রয়েছে জাতীয় পরিচিতি। সর্বশেষ কাউন্সিলে জাসদ একাংশের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় স্থানীয়ভাবেও তার ইমেজ আরো বেড়েছে। এমপি হওয়ার পর সংসদীয় আসনে নিয়মিত জনসংযোগে জাসদের সাংগঠনিক ভিত্তি পুনর্গঠনেও তিনি ভূমিকা রাখছেন। এ সময় সাতজন ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জাসদ থেকে। বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে কমিটি গঠন, নিয়মিত এলাকায় কর্মীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করে চলেছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ফলে তার স্থানীয় জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। সেদিক দিয়ে এই আসনে তিনি ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী হিসেবেই আবির্ভূত হবেন।
‘আমি এখন এই আসনে এমপি এবং আগামী নির্বাচনেও আমি এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব’ জানিয়ে শিরিন আখতার বলেন, এবারের নির্বাচন রীতিমতো যুদ্ধের মতো। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি জিতবে, না রাজাকারের শক্তি জিতবে-সেটা দেখার বিষয়। ফলে সেখানে জাসদ নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে যিনিই প্রার্থী হবেন তার সপক্ষে সবাই কাজ করবেন। আগামী নির্বাচনে এই আসনে প্রার্থী বদলের সম্ভাবনা ‘আমার ধারণা মতে নেই’ বলেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চাওয়া প্রসঙ্গে জোট কার্যক্রমে সাফল্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থিতা চায়, এটা অস্বাভাবিক মনে করি না। তবে সিদ্ধান্তটা কেন্দ্র থেকেই হবে। জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী শিরিন আখতার মহাজোট প্রার্থিতা না পেলেও প্রার্থী হবেন কিনা-এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ওই সময় দেখা যাবে।
এদিকে ফেনী-১ আসনে ইতোপূর্বে কোনো এমপি নির্বাচিত না হলেও স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি বেশ মজবুত। ইউপি নির্বাচনে মেম্বার থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র এবং সর্বশেষ জেলা পরিষদ সদস্য সবাই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত। খালেদা জিয়ার আসনকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত করার অন্যতম দাবিদার হলেন সাবেক আমলা ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। স্থানীয় উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী পরিবারের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। এ আসনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইলে অন্য কেউ প্রার্থী হবেন না বলেও জানা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত তার প্রার্থী হওয়ার কোনো আগ্রহ নেই বলে জানা গেছে।
এই আসনের সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম ১৯৭৯ সাল থেকে বিএনপি, পরে জাপা থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এমপি-মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ সালে জাপা প্রার্থী হিসেবে এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এ আসন থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। দলীয় মনোনয়ন পেলে আবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান তিনি।
এ ছাড়া আ.লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খায়রুল বাশার তপন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিই দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে আসনটি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশে জাসদকে ছেড়ে দেন। দলের নেতাকর্মীরা তাকেই সাংগঠনিক এমপি হিসেবে সমীহ ও মান্য করেন। আলাউদ্দীন নাসিম নির্বাচনে না গেলে এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। খায়রুল বাশার তপন বলেন, তিনি দলের কর্মী হিসেবে সাংগঠনিক কাজ করছেন। দল মনোনয়ন দিলে প্রার্থী হবেন।
এ আসনে মনোনায়ন দৌড়ে আছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। তার বাড়ি ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে। আগামী নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু তিনি ঢাকা থেকে না-কি এলাকা থেকে প্রার্থী হবেন তা এখনো অনিশ্চিত। তবে আগামী নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে। এদিকে ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও দলের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেলও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। নাসিম ও তপন নির্বাচনে না এলে তিনি প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি জানান, এই আসনে খালেদা জিয়াকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত করতে হলে দলের প্রার্থীর বিকল্প নেই।
এ নির্বাচনী আসনের ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পৈতৃক বাড়ি। ১৯৯০-পরবর্তী চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে এ আসনে নিশ্চিতভাবেই প্রার্থী হবেন খালেদা জিয়া।
এদিকে খালেদা জিয়া এমপি হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে প্রধানমন্ত্রী ও দলের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে নির্বাচনী এলাকা অভিভাবকশূন্য হয়ে যায়। এতসব জাতীয় দায়িত্ব পালন করে তিনি নির্বাচনী এলাকায় সময় দিতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভোটারদের অভিযোগ, শুধু নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া ফেনীর মেয়ে বলে পরিচয় দেন, আর অন্য সময় তার দেখা পাওয়া যায় না। তাই আওয়ামী লীগের শক্ত প্রার্থী থাকলে তার সহজ বিজয় কঠিন হতে পারে। তা ছাড়া এ আসনে বর্তমানে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দলের উপজেলা কমিটিগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর ধরে কোনো সম্মেলন হয় না। কেন্দ্র ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের দুর্বলতা ও মামলায় অসহযোগিতার কারণে রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন।
এ ছাড়া বিএনপির তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র কোন্দল। নেতারা একে অপরকে ঘায়েল করতে ব্যস্ত। ‘এক নেতা এক পদ’ দলের এমন নীতি মানা হচ্ছে না। ত্যাগী কর্মীরা জেল খেটে, মামলায় জর্জরিত হলেও তাদের খবর কেউ রাখেন না। কয়েক মাস আগে কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগেও ভাটা পড়ে গেছে। সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল বিএনপি খালেদা জিয়াকে প্রার্থী হিসেবে নিয়ে সুশৃঙ্খল আওয়ামী লীগের সামনে কতটুকু দাঁড়াতে পারবে-তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
তবে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন ভিপি বলেন, আগামী নির্বাচনে নেত্রী (খালেদা জিয়া) এ আসন থেকে প্রার্থী হবেন। পৈতৃক বাড়ি হওয়ায় এ আসনের প্রতি নেত্রীর বাড়তি দুর্বলতা রয়েছে। এ আসনে খালেদা জিয়া আগের মতোই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন বলেও তিনি আশা করেন।
এ আসনে এক সময় জাপার সাবেক মন্ত্রী জাফর ইমাম পরপর দুই মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হন। বর্তমানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা নাজমা আক্তারকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপির অন্যতম শরিক দল জামায়াত ফেনীর অন্তত একটি আসনে প্রার্থী দিতে পারে বলে জানা গেছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ও রোম করপোরেশনের এমডি দিদারুল আলম মজুমদার এ আসনে প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া ফেনী জেলা জামায়াতের আমির এ কে এম সামছুদ্দিনও এ আসনে মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে ঢাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আলহাজ এম এ কাসেম নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলে জানা গেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি তার অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম চেম্বারস অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি, ইলেকট্রো মার্ট লিমিটেডের মালিক ও এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ সেলিম এবং ট্রুথ পার্টির কেন্দ্রীয় মহাসচিব এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন।