হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঋতু বৈচিত্র্যের পালাক্রমে প্রকৃতিতে বিরাজ করছে স্বর্ণঋতু হেমন্ত। ঋতুর রানী শরতের প্রস্থানের পরই হিমবায়ুর পালকি চড়ে হালকা কুয়াশার আঁচল টেনে আসে এই ঋতু। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ, এই দু’মাস একান্তই হেমন্তের। এ সময় বাংলার আকাশে, বাতাসে, বৃক্ষ চরাচরে ছড়িয়ে পড়ে হেমন্তের সুন্দর রূপবিভা।
দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠে নির্মল হাওয়ায় নেচে ওঠে উজ্জ্বল ধান ক্ষেতের ধানের সোনালি গুচ্ছ। পাকা ধানের সোনালি রং দেখে কৃষকের মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। উঠানভরা সোনালি ধানের স্তূপ হৃদয়ে বয়ে আনে প্রশান্তির বান। শুকরিয়া জানায় আল্লাহর কাছে ।সত্যি! এই যে এত নাজ নেয়ামত,
এ সবকিছু তো তারই কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। তিনিই আপন কুদরতে শক্ত মাটির বুক চিড়ে এই ফসল আর ফলফলাদির ব্যবস্থা করেন। যা তিনি পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায়ই জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি তো অঝর ধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। অতঃপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্যাদি, আঙুর, শাকসবজি, জলপাই, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফলফলাদি ও ঘাস। এসব তোমাদের ও তোমাদের পালিত পশুকুলের জীবন ধারণের জন্য।’
(সূরা আবাছা : আয়াত ২৪-৩২)
হেমন্ত মানেই যেন উচ্ছ্বাস। নতুন সুর, শিহরণ। হেমন্তের জাগরণে কাননে কাননে ফুটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, পদ্ম, হাসনাহেনা, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজ অশোকসহ নানা রং ও ঘ্রাণের অসংখ্য জাতের ফুল। সেসব ফুলের পাপড়ি ও গাছের পাতায় পাতায় ভোরের মৃদু স্পর্শ জানিয়ে দেয় শীত আসছে।
হেমন্তের ব্যস্ত দুপুরে মাঠ থেকে সোনালি ফসল ঘরে আনার দৃশ্য, নয়া ধানের মৌ মৌ গন্ধে কৃষাণীর ব্যস্তমুখর হাসি, কিশোর-কিশোরীদের মেতে ওঠা ডাঙ্গুলি, গোল্লাছুট আর বৌছি খেলা, শেষ বিকালে রাঙানো শিল্পিত দৃশ্য দাগ কেটে যায় কবিদের মনে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে আজকের অনেক কবিও এই হেমন্তকে নিয়ে লিখেছেন, লিখে যাচ্ছেন উদারচিত্তে।
হেমন্তের আগমনী, এর প্রকৃতি ও স্বভাবের এক চঞ্চল রূপ এঁকেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায়। ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরনীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হ’ল মাৎ। মাঠের সাগরে জোয়ারের পরে লেগেছে ভাটির টান।
রাখাল ছেলের বিদায়-বাঁশিতে ঝুরিছে আমন ধান! কৃষক-কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুর রোয়ে রোয়ে মরে বিদায়-বিধূর!
ধান ভানে বৌ, দুলে দুলে ওঠে রূপ-তরঙ্গে বান! বধূর পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকিও প্রাণ!…
তিনি এই কবিতায় শুধু হেমন্তের প্রকৃতির ছবিই আঁকেননি, একই সঙ্গে পারিবারিক সংস্কৃতির চিত্রও তুলে ধরেছেন। ‘গিন্নি-পাগল’ চা’লের ফিরনী তশতরী ভ’রে নবীনা গিন্নী
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশীতে কাঁপিছে হাত। শিরনী রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ী গন্ধে তেলেসমাত!’
নজরুল হেমন্তের দিনের চেয়ে রাতের সৌন্দর্যেই যেন বেশি মোহিত হয়েছেন। সে চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে তার এই পঙ্ক্তিতে, ‘চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ নতুন পথের চেয়ে চেয়ে হল হরিৎ পাতারা পীত।’
হেমন্ত মানেই হচ্ছে নবান্নের আনন্দ। একটা সময় ছিল যখন নবান্নের উৎসবে গ্রামবাংলার লোকেরা মেতে উঠতেন। ধনী-গরিব সবাই মিলে অগ্রহায়ণের প্রথম বৃহস্পতিবার পালন করতেন নবান্নের উৎসব। গাঁয়ের বধূরা গুড়, নারিকেল, কলা, দুধ প্রভৃতির সঙ্গে নতুন আতপ চাল মিশিয়ে ক্ষীর রাঁধতেন। জনে জনে তা বিলাতেন। এতে করে ধনী-গরিব সবার মনে তৈরি হতো সম্প্রীতির বন্ধন। তা যেন আজ-কালের গর্ভে বিলীন হওয়া অতীত। অথচ কল্যাণময় স্রষ্টা কিন্তু এরকম আনন্দোৎসবে উৎসাহ প্রদান করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,
‘হে হাবিব! বলুন, যখন আল্লাহর অনুগ্রহ, রহমত, সম্মান ও করুণা অর্জিত হয়, তখন তারা যেন আনন্দোৎসব করে।’ (সূরা ইউনুছ : ৫৮)
তবে কথা হচ্ছে, এই উৎসবের ব্যাপারে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে। কোনোভাবেই যেন তা সীমালঙ্ঘন না করে। কেন না ইসলাম সে উৎসবকেই উৎসাহিত করে যে উৎসব মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।
এ কথা প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে খুব ভালো করে গেঁথে নিতে হবে যে, আমরা জমিনে যে বীজ রোপণ করি সেই বীজ থেকে চারা গজানো, ভূগর্ভস্থ থেকে সেচ, শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করানো, প্রত্যেকটি কাজই হয় আল্লাহতায়ালার অপার কুদরতি ব্যবস্থাপনায়। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কেভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা থেকে
উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী? ইচ্ছা করলে, আমি তা খড়কুটা করে দিতে পারি। অতঃপর তোমরা হয়ে যাবে হতভম্ব।’ (সূরা ওয়াকিয়া : ৬৩-৬৫)।
অতএব, নবান্নের উৎসব পালিত হোক মহান আল্লাহকে শুকরিয়া জ্ঞাপনের মাধ্যমে। আর এটাই হবে মুমিন মুসলমানের কাজ। কেন না আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যদি তোমরা আমার অনুগ্রহ বা নেয়ামতপ্রাপ্তির শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তবে তোমাদের নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেয়া হবে, আর অকৃতজ্ঞ হলে কঠিন আজাবে (শাস্তিতে) পড়তে হবে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৭)
লেখক : প্রাবন্ধিক