হাওর বার্তা ডেস্কঃ পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, হাওরে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় হরিলুট হয়নি তবে লুট ও দুর্নীতি হয়েছে। তিনি বলেন, পানিসম্পদ অধিদপ্তর সমাজের ও সিস্টেমের বাইরের কোনো অংশ নয়। সমাজে যে ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে এখানে সেটি আছে। তবে দুর্নীতি ধরা যায় না। গতাকল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বন্যা ২০১৭ পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক এক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি। এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডির গবেষণায় বলা হয়, এবারের দফায় দফায় বন্যায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এবার তিন বার বন্যা হয়েছে। তবে বাঁধ ভেঙ্গে বন্যা হয়নি। অতিবৃষ্টির কারণে পানি বাঁধ দিয়ে উপচে পড়েছে। তিনি বলেন, বন্যার পর ব্যবস্থা নিতে কয়েকটি সমস্যা ছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে দুর্নীতি ও কিছুটা গাফিলতি। দুর্নীতি হয় তবে তা ধরা যায় না।
অনুষ্ঠানে আইনুন নিশাত বলেন, বন্যার পরবর্তী সময়ে রাস্তা মেরামত ও অন্যান্য উন্নয়নের নামে হরিলুট হচ্ছে। প্রতিবছরই রাস্তা হচ্ছে। কিন্তু তা টেকসই হচ্ছে না। দুর্নীতি বন্ধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সংস্কারমূলক কাজে সংসদ সদস্যের অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানান তিনি।
আইনুন নিশাতের এসব অভিযোগের জবাবে পানিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, বাঁধ নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ করা হয় তা মোটেও সত্য নয়। এখানে বরাদ্দ মাত্র ৪২০ কোটি টাকা। সুতরাং এর মধ্যে হরিলুট হওয়ার সুযোগ নেই। তবে লুট ও দুর্নীতি কিছু হচ্ছে। কিন্তু হরিলুট হচ্ছে না। মন্ত্রী বলেন, সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সচেষ্ট থেকে কাজ করে যাচ্ছে। ড্রেনেজ করা হচ্ছে। নদীগুলো খনন করা হচ্ছে। এসব করতে গিয়ে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
পানিসম্পদমন্ত্রী বলেন, এবারের বন্যা গাফিলতি বা অব্যবস্থাপনার কারণে হয়নি, হয়েছে অন্য কারণে। এ বছরের মতো পানি ও বৃষ্টিপাত আর হয়নি। এ বছর বন্যা দীর্ঘমেয়াদি ছিল না, অধিকাংশ জায়গার পানি ৫-৬ দিনেই নেমে গেছে। কিছু এলাকায় পানি আছে। তিনি বলেন, বন্যা হয়েছে লেখা হয়, কেন হচ্ছে সেটা মিডিয়ায় আসে না। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় চায় হাওরে কৃষকরা বিআর২৮ চাষ করুক। ফসল এক মাস আগে উঠবে, বন্যায় ক্ষতি কম হবে। কিন্তু চাষিরা বিআর২৯ই উৎপাদন করবে।
আনিসুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাঁধগুলোতে অনেক বেশি অত্যাচার করা হয়। ফসল তুলতে বাঁধ কাটা হয়। বাঁধে গরু, ছাগল রাখা হয়। ঘরবাড়ি তোলা হয়। ফলে বাঁধ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর দিনাজপুরে বাঁধের ওপরে একটি ফুলগাছ ছিল। সেটি ভেঙে গিয়ে ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে বন্যা হয়েছে। দেশের অনেক এলাকায় ইঁদুর এসে বাঁধ ফুটো করে দেয়ায় সেখান দিয়ে পানি ঢুকেছে। মন্ত্রী জানান, বাঁধ রক্ষায় আমেরিকায় ইদুর মারার জন্য ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের তা নেই। তিনি বলেন, হাওরে অন্তত ৫০০ জায়গায় ফসল তুলে বাঁধ কাটা হয়েছে। এগুলো মেরামতের মাটি তো বাইরে থেকে আনতে পারছি না। হাওরের মাটি দিয়েই পূরণ করতে হবে। ডিসেম্বরের আগে কাজ শুরু সম্ভব না, পানি নামলে কাজ শুরু হবে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু বন্যাপরবর্তী সংস্কারকাজে সংসদ সদস্যদের দূরে রাখার বিষয়ে অধ্যাপক আইনুন নিশাতের পরামর্শের সমালোচনা করে বলেন, সংসদ সদস্যরা জনপ্রতিনিধি। তারা এলাকার উন্নয়নের কাজে সব সময় সম্পৃক্ত থাকেন। বন্যাপরবর্তী কাজে তাদের দূরে রাখা হবে কেন, তা আমি বুঝতে পারছি না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বিশেষ ফেলো এম আসাদুজ্জামান বলেন, দেশে বড় অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ বেশি। কিন্তু তা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায় না।
সিপিডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০১৭ সালে দফায় দফায় বন্যা হানা দেয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দফায় দফায় ওই বন্যায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সিডিপি জানিয়েছে, এই বন্যায় ফলসহানি, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়ে ক্ষতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উপস্থাপিত তথ্যে দেখা গেছে, এবারের বন্যায় ৩২ জেলায় কমপক্ষে ১ কোটি ২৮ লাখ মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া এবারের বোরো মৌসুমে বন্যাকবলিত ওইসব এলাকায় প্রায় ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ১৫ লাখ ৩০ হাজার ধান বিনষ্ট হয়েছে।
সংলাপে পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, দেশে বন্যা এখনও আছে। উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি দেরিতে নামার কারণে ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ধান উৎপাদন ৩০ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। বন্যাকবলিত অনেক এলাকার মানুষ এখনও বাঁধের ওপর অবস্থান করছেন।