ঢাকা ০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৌন্দর্য হারাচ্ছে পাথর শিকারিদের থাবায় জাফলং

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:৩৯:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর ২০১৭
  • ৩৫৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাথর শিকারিদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং পর্যটন স্পট পিয়াইন নদীর নয়া বস্তি, কান্দী বস্তি, বল্লাঘাট। বছরের পর বছর সরকারের উদাসীনতা আর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখানকার নির্মল প্রকৃতি বিরান হয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়-নদের সবুজ প্রকৃতির সেই জাফলং দিনে দিনে বিরান এক রূপ ধারণ করছে। এর মূলে রয়েছে ‘বোমা মেশিন’ নামের একটি যন্ত্র। নিষিদ্ধ এই যন্ত্র দিয়ে ভূগর্ভ থেকে পাথর তোলায় ধসে যাচ্ছে নদীর তীর, আশপাশের চা-বাগান, বিলীন হচ্ছে গ্রামের ঘরবাড়ি। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত হচ্ছে নিষিদ্ধ এ যন্ত্র। জাফলংয়ের দুই নদী পিয়াইন ও ডাউকির তীরের নয়া বস্তি, কান্দী বস্তিতে শতাধিক বোমা মেশিন বসিয়ে অবাধে চলছে পাথর উত্তোলন। বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করলে আশপাশের ভূমি ধসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিটের ফলে বোমা মেশিন নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। বোমা মেশিন চালানোয় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘টাস্কফোর্স’ প্রতিমাসে অন্তত দুটি করে অভিযান চালায়।

টাস্কফোর্স-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অভিযানের খবর আগে থেকে পেয়ে যান বোমা মেশিন পরিচালনায় থাকা ব্যক্তিরা। এ কারণে সুফল মিলছে না। আর টাস্কফোস গেলে ও ২/১টি পাটাতনে আগুন দিয়ে শেষ হয় অভিযান আর শত শত বোমা মেশিন থেকে যায় ভালো।

জাফলংয়ের বাসিন্দারা জানান, পাথর কোয়ারি এলাকায় একসময় সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন চলত। পানিতে নেমে হাত দিয়ে পাথর উত্তোলনের কর্মযজ্ঞে তখন হাজার হাজার পাথরশ্রমিক আর বারকি নৌকার আনাগোনা ছিল। জাফলংয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি তখন। কিন্তু কম সময়ে অনেক বেশি পাথর তোলার জন্য একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী বোমা মেশিনের ব্যবহার শুরু করে। বড় বড় পাইপ দিয়ে মাটির প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে পাওয়ার পাম্প যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন শুরু হয়।

ওই যন্ত্র দিয়ে পাথর তোলার সময় বোমার মতো শব্দ হয় বলে নাম হয় ‘বোমা মেশিন’। নদের তীরজুড়ে সারি সারি বোমা মেশিন। বড় বড় পাইপ বসিয়ে মাটির অনেক গভীর থেকে পাথর উত্তোলন করায় ধসের মুখে পড়েছে পিয়াইন নদীর মোহনার পার্শ্ববর্তী নয়া বস্তি, কান্দী বস্তির গ্রাম ও কৃষি জমি। আর এই বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের কারণে পিয়াইন নদীতে গত ১২ বছরে সাঁতার দিতে ও গোসল করতে নেমে ৩৭ পর্যটকের সলিল সমাধি হয়েছে। নদীতে সাঁতার কাটতে, নৌকা চড়তে কিংবা গোসল করতে গিয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন তারা। সর্বশেষ ২২ জুলাই জিরো পয়েন্টে সাঁতার কাটতে গিয়ে ঢাকার কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগ ঘোষ ও আবদুল্লাহ অন্তরের সলিল সমাধি ঘটে। অরক্ষিত পিয়াইন নদীতে গত ২৫/৩০ বছরে পিয়াইন নদীতে কত পর্যটক মৃত্যুবরণ করেছেন, তার সঠিক কোন হিসেব কারো কাছে নেই।

বাংলাদেশে জাফলং একটি অতিপরিচিত স্থান। সিলেট নামের সঙ্গে জাফলংয়ের নাম জড়িয়ে আছে আদিকাল থেকে। প্রতিদিন সৌন্দর্যপিপাসুরা আগ্রহ নিয়ে এখানে ছুটে এসে নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হন। নয়া বস্তি, কান্দী বস্তি, বল্লারঘাট এলাকায় মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলনর কারণ পরিবেশ এখন হুমকির সম্মুখীন। জাফলং এলাকার ধ্বংস হয়ে যাওয়া সবুজ বনাঞ্চল পুনঃস্থপন করা হলে জাফলং বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিগণিত হবে। জাফলংকে রক্ষা করতে এখনই সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানিয়রা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সৌন্দর্য হারাচ্ছে পাথর শিকারিদের থাবায় জাফলং

আপডেট টাইম : ০২:৩৯:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাথর শিকারিদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং পর্যটন স্পট পিয়াইন নদীর নয়া বস্তি, কান্দী বস্তি, বল্লাঘাট। বছরের পর বছর সরকারের উদাসীনতা আর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখানকার নির্মল প্রকৃতি বিরান হয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়-নদের সবুজ প্রকৃতির সেই জাফলং দিনে দিনে বিরান এক রূপ ধারণ করছে। এর মূলে রয়েছে ‘বোমা মেশিন’ নামের একটি যন্ত্র। নিষিদ্ধ এই যন্ত্র দিয়ে ভূগর্ভ থেকে পাথর তোলায় ধসে যাচ্ছে নদীর তীর, আশপাশের চা-বাগান, বিলীন হচ্ছে গ্রামের ঘরবাড়ি। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতি, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত হচ্ছে নিষিদ্ধ এ যন্ত্র। জাফলংয়ের দুই নদী পিয়াইন ও ডাউকির তীরের নয়া বস্তি, কান্দী বস্তিতে শতাধিক বোমা মেশিন বসিয়ে অবাধে চলছে পাথর উত্তোলন। বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করলে আশপাশের ভূমি ধসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রিটের ফলে বোমা মেশিন নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। বোমা মেশিন চালানোয় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘টাস্কফোর্স’ প্রতিমাসে অন্তত দুটি করে অভিযান চালায়।

টাস্কফোর্স-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অভিযানের খবর আগে থেকে পেয়ে যান বোমা মেশিন পরিচালনায় থাকা ব্যক্তিরা। এ কারণে সুফল মিলছে না। আর টাস্কফোস গেলে ও ২/১টি পাটাতনে আগুন দিয়ে শেষ হয় অভিযান আর শত শত বোমা মেশিন থেকে যায় ভালো।

জাফলংয়ের বাসিন্দারা জানান, পাথর কোয়ারি এলাকায় একসময় সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন চলত। পানিতে নেমে হাত দিয়ে পাথর উত্তোলনের কর্মযজ্ঞে তখন হাজার হাজার পাথরশ্রমিক আর বারকি নৌকার আনাগোনা ছিল। জাফলংয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি তখন। কিন্তু কম সময়ে অনেক বেশি পাথর তোলার জন্য একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী বোমা মেশিনের ব্যবহার শুরু করে। বড় বড় পাইপ দিয়ে মাটির প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে পাওয়ার পাম্প যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন শুরু হয়।

ওই যন্ত্র দিয়ে পাথর তোলার সময় বোমার মতো শব্দ হয় বলে নাম হয় ‘বোমা মেশিন’। নদের তীরজুড়ে সারি সারি বোমা মেশিন। বড় বড় পাইপ বসিয়ে মাটির অনেক গভীর থেকে পাথর উত্তোলন করায় ধসের মুখে পড়েছে পিয়াইন নদীর মোহনার পার্শ্ববর্তী নয়া বস্তি, কান্দী বস্তির গ্রাম ও কৃষি জমি। আর এই বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের কারণে পিয়াইন নদীতে গত ১২ বছরে সাঁতার দিতে ও গোসল করতে নেমে ৩৭ পর্যটকের সলিল সমাধি হয়েছে। নদীতে সাঁতার কাটতে, নৌকা চড়তে কিংবা গোসল করতে গিয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন তারা। সর্বশেষ ২২ জুলাই জিরো পয়েন্টে সাঁতার কাটতে গিয়ে ঢাকার কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগ ঘোষ ও আবদুল্লাহ অন্তরের সলিল সমাধি ঘটে। অরক্ষিত পিয়াইন নদীতে গত ২৫/৩০ বছরে পিয়াইন নদীতে কত পর্যটক মৃত্যুবরণ করেছেন, তার সঠিক কোন হিসেব কারো কাছে নেই।

বাংলাদেশে জাফলং একটি অতিপরিচিত স্থান। সিলেট নামের সঙ্গে জাফলংয়ের নাম জড়িয়ে আছে আদিকাল থেকে। প্রতিদিন সৌন্দর্যপিপাসুরা আগ্রহ নিয়ে এখানে ছুটে এসে নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হন। নয়া বস্তি, কান্দী বস্তি, বল্লারঘাট এলাকায় মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলনর কারণ পরিবেশ এখন হুমকির সম্মুখীন। জাফলং এলাকার ধ্বংস হয়ে যাওয়া সবুজ বনাঞ্চল পুনঃস্থপন করা হলে জাফলং বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিগণিত হবে। জাফলংকে রক্ষা করতে এখনই সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানিয়রা।