হাওর বার্তা ডেস্কঃ ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী ক্যাট স্টিভেন্স তরুণ বয়সেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। পরিণত বয়সে তার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। একপর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম রাখেন ইউসুফ ইসলাম। ক্যারোলাইন হাটন নামে এক ব্যক্তির কাছে তিনি নিজের জীবনের নানা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেটাই এখানে তুলে ধরা হলো। অনুবাদ করেছেন মোতালেব জামালী
…আমার মনে পড়ে বাবার সেই রেস্টুরেন্টের কথা। এটি ছিল লন্ডনের শ্যাফটব্যুরি এভিনিউয়ে। বাবা নিয়মিত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। তিনি ছিলেন সাংঘাতিক পরিশ্রমী মানুষ। আমরা ভাইবোনরা তাকে উদাহরণ হিসেবে মনে করতাম, তার কাছ থেকে সব কিছু শিখে নিতে চেষ্টা করতাম। আমরা হোটেলের কাজে কিভাবে পরিশ্রম করতাম তা আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না। বাবুর্চি, ওয়েটার, থালা-বাসন পরিষ্কারসহ রান্নাঘরের যাবতীয় কাজকর্ম সবই আমরা মিলেমিশে করতাম। আমার বাবার আদি নিবাস ছিল সাইপ্রাসে। কিন্তু তিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে লন্ডনে এসে থিতু হন। আর আমার মা ছিলেন সুইডিশ। ইংল্যান্ডে এসে নার্স হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এক রাতে লন্ডনে প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের। সেই পরিচয় থেকেই তারা পরে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।
…লন্ডনের আলো ঝলমলে রাস্তা, কফিবার, সিনেমা হল, থিয়েটার এ সব কিছুর মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে বসবাসের কারণে এসব কিছুই আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। দ্রুতই আমি সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কৈশোর ও তারুণ্যের ওই দিনগুলো প্রায় রাস্তাতেই কেটেছে আমার। এ সময় মার্সিবিট আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আর ওই সময়টাতেই মঞ্চে এসে হাজির হয়েছিল বিটলস। তখন মনে হতো সব কিছুই সম্ভব। ১৯৬০-এর দশকে মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই আশাবাদী হয়ে উঠেছিল।
…আমার প্রথম গিটারটি কেনার জন্য বাবা আমাকে দিয়েছিলেন ৮ পাউন্ড (এখন ১২ ডলার)। কিন্তু অন্যের লেখা গান গাওয়া আমার জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়ল। কারণ এতে নানা ধরনের সুরের মিশ্রণ ছিল। ফলে প্রথম দিন থেকেই আমি নিজের লেখা গানই গাইতে শুরু করলাম। আমার গানগুলো ছিল তখনকার প্রচলিত গানগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। গান লেখা আদতে একটি শিল্প এবং নতুন ধরনের গান লেখার ক্ষেত্রে আমার মধ্যে একটা দক্ষতা ছিল। ফলে প্রচলিত পুরনো ধাঁচের গানগুলো থেকে আমার লেখা গান সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে উঠল। ফুটে উঠল নতুনত্ব। নিজের লেখা ও সুর করা গানের মধ্যেই আমি পুরনো ধারাকে খোঁচা দিয়েছি।
…আমার গানের প্রথম রেকর্ডিং হয় ১৯৬৬ সালে। তখন আমার বয়স মাত্র ১৮ বছর। ডেকা রেকর্ডিং স্টুডিওতে অডিশনের পর তারা আমার ‘আই লাভ মাই ডগ’ ও ‘ম্যাথু অ্যান্ড সান’ এই দু’টি গান বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিল আমার জন্য এক দারুণ সূচনা। এ জন্য প্রডিউসার মাইক হার্স্টকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার বয়স কম হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আমার মধ্যে বিশেষ কিছু রয়েছে। রেকর্ডিংয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও তিনি আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন।
…এর দুই বছর পর আমি মারাত্মক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হই। আমার বেঁচে থাকা নিয়েই দেখা দেয় সংশয়। সাসেক্সের গ্রামাঞ্চলের একটি হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করা হয়। এ সময় অত্যন্ত কঠিন দিনগুলো আমি অতিবাহিত করেছি। এ অবস্থার মধ্যেও গান নিয়ে আমি যথেষ্ট কাজ করেছি। দিনের পর দিন পিঠে ভর দিয়ে একাকী শুয়ে থাকার সময় আমি বাইরের গাছগুলোর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম। আর এ সময়ই আমার আত্মার মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আর আমি নিজেও জানতাম যে, আমি যা করছি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু জীবনে করার আছে। আর সেটি হচ্ছে চেতনার দিক থেকে। এ সময়ই উদঘাটন করতে সক্ষম হই যে, আমার মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে এবং আমি অনেকা নতুন ধরনের বা ভিন্ন আঙ্গিকের গান লিখে ফেলেছি।
…‘ফাদার অ্যান্ড সান’সহ বেশ কিছু নতুন গান আমি আইল্যান্ড রেকর্ডিং কোম্পানির ক্রিস ব্ল্যাকওয়েলকে গেয়ে শোনালাম। তিনি খুবই খুশি হলেন এবং ১৯৭০ সালে তার সাথে আমার চুক্তি হলো। আমার প্রডিউসার হলেন পল স্যামওয়েল স্মিথ। তিনি অ্যালুন ডেভিসের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। গিটারে তার ছিল অসাধারণ দক্ষতা। তিনি গিটার বাজানোয় আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছেন। স্টেজে আমাদের চমৎকার জুটি গড়ে উঠল। পরে প্রায় ৪০ বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক টিকে ছিল।
…গান থেকে প্রচুর আয় হতে থাকল এবং আস্তে আস্তে সব কিছুই অধিকতর বাণিজ্যিক হয়ে উঠল। যুক্তরাষ্ট্রেও আমার গান জনপ্রিয়তা পেল। কিন্তু আমার গানের সাথে নিজের আত্মিক বা আধ্যাত্মিক আকাক্ষার ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া আমার জন্য খুবই কঠিন হয়ে উঠল। ৪০ হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে গান গেয়েও আমার মধ্যে কেন জানি আত্মতৃপ্তি আসছিল না। নিজের প্রকৃত চেতনার প্রতিফলনও ঘটছিল না।
…সেই ঢেউটির কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। ১৯৭৬ সালে আমি এক বন্ধুর সাথে মালিবুতে অবস্থান করছিলাম। সেখানে সমুদ্রটা এত চমৎকার দেখাচ্ছিল যে, আমি সাঁতার কাটতে নেমে যাই। অকস্মাৎ জোয়ারের স্রোতে আমি অনেক দূরে চলে যাই এবং সেখান থেকে সাঁতরে ফিরে আসাটা আমার জন্য অসম্ভব একটি কাজ ছিল। আর ঠিক তখনই আমার হৃদয়ে জেগে উঠল ধর্মবিশ্বাস। আমি বলে উঠলাম ‘সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাকে বাঁচাও, আমি তোমার জন্য কাজ করব।’ আর সেই মুহূর্তেই একটি বিশাল ঢেউ পেছন থেকে এসে এক ধাক্কায় আমাকে তীরে পৌঁছে দিলো। আমার মনে হলো যেন আমি দ্বিতীয়বারের মতো জীবন পেলাম।
…আমি জীবনে প্রথমবারের মতো পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করলাম এবং এটাই আমার জীবনকে চিরদিনের মতো বদলে দিলো। আমার জন্মদিনে আমার ভাই আমাকে কুরআন উপহার দিয়েছিলেন। আমি অন্যান্য ধর্ম ও দর্শন অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু কুরআন আমার জন্য ছিল এক বিস্ময়। এই ধর্মগ্রন্থটি এতই সুগভীর জ্ঞানের ভাণ্ডার যে, আমি আমার জীবনে কুরআনের শিক্ষার প্রয়োগ শুরু করলাম। আমি যতই আমার জীবনাচরণে পরিবর্তন আনতে থাকলাম, জীবন আরো তত বেশি বিস্ময়কর হয়ে উঠতে থাকল আমার কাছে। আমি এক নতুন দিকনির্দেশনায় সাঁতরাতে শুরু করলাম। অবশেষে ১৯৭৭ সালে আমি ইসলাম গ্রহণ করি। নাম পরিবর্তন করি ১৯৭৮ সালে। যেহেতু ইসলামে অংশীদারিত্ব উপভোগের একটিমাত্র পন্থাই নির্দেশিত আছে, (আমার কাছে একটি মহৎ ধারণা) তাই ১৯৭৯ সালে রিজেন্টস পার্ক মসজিদে গিয়ে আমি বিয়ে করি।
…মুসলমান হওয়ার পর আমি পরম মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। সেই প্রশান্তি আমি আজো অনুভব করি। আমি শিখেছি ও জেনেছি কে আমি। আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার আমার নাম ও স্টাইল পরিবর্তন করেছি। আমরা আমাদের নিজের কাজ ও আমাদের চার পাশে যারা আছে তাদের ওপর এই কাজের যে প্রভাব পড়ে তার জন্য আমরা দায়ী। আপনি নিজেকে দিয়েই এটি পরীক্ষা করুন। ঘরের বাইরে গিয়ে কারো প্রতি এটি প্রয়োগ করে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করুন। ভদ্রভাবে কথা বললে এবং দয়ালু আচরণ করলে তার প্রতিক্রিয়াও হয় সম্পূর্ণ আলাদা।
…এক দিন আমি আমার গিটারটি রেখে দিলাম। ২৭ বছর আগে আমি শেষবারের মতো গিটার বাজিয়েছি। গানের পরিবর্তে আমি শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ি। আমি নিজেই বুঝতে পারলাম যে, শিশুদের উন্নয়নে আমার কিছু অবদান রাখার সুযোগ আছে। তাদের হৃদয় ও চেতনায় পরিবর্তন আনার শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। আমার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম স্কুলটি যখন প্রথম অনুদানের অর্থ পেল তখন নিজেকে খুবই গর্বিত মানুষ মনে হয়েছে। আমি নানাভাবে নানা দিক থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইসলাম সম্পর্কে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ধারণার ক্ষেত্রে যে পার্থক্য বিরাজ করছে তা কমিয়ে আনার জন্য আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
…আমার ছেলে এক দিন একটি গিটার কিনে বাড়িতে নিয়ে এলো। আমিও বুঝতে পারলাম যে, গানের জগতে আবার ফিরে যাওয়ার এটাই সঠিক সময়। ২০০৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আমার ‘অ্যান আদার কাপ’ ও ‘রোড সিঙ্গার’ নামে দুটো অ্যালবাম বাজারে এসেছে। অবশ্য অতি রক্ষণশীল মুসলমানরা গান নিয়ে ভিন্ন ধারণা পোষণ করে থাকে। গান কী উপকারে আসে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে তাদের। তবে আমি মনে করি গান একটি প্রাকৃতিক ও সৌন্দর্যময় জিনিস। আমি উদঘাটন করেছি যে, কয়েক হাজার বছর আগে যখন সঙ্গীত ও কলার গৌরবময় বুদ্ধিবৃত্তিক স্বর্ণযুগ চলছিল তখন স্পেনের মুসলমানরাই ইউরোপে গিটারের প্রচলন করে।
…২০০৪ সালে আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয় (কারণ ইউসুফ নামের কোনো একজন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল এবং সাথে আমার নাম মিলে গেছে। ওই ব্যক্তিকে পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়)। ভিসা না দেয়ার এই ঘটনা থেকে আমার মনে হয়েছে যে, আল্লাহর ইচ্ছাতেই এটা ঘটেছে। যদিও মিডিয়া এ নিয়ে নানা কিচ্ছা-কাহিনী ছেপেছে। আগের দিনে যদি কেউ আমার গান পছন্দ না করত তা হলে মনে কষ্ট পেতাম। কিন্তু এখন আর সেই অনুভূতি হয় না। এখন যা-ই ঘটুক না কেন আমি মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়েছি। কারণ আপনার চার পাশের লোকজন যখন আপনার সম্পর্কে খারাপ চিন্তা করতে থাকবে তখন আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত হতেই হবে।
…আমার গান অন দ্য রোড টু ফাইন্ড আউট-এ আমি লিখেছি, ‘পথের শেষ প্রান্তে গিয়ে আমি জানতে পারব কিন্তু চলার পথে আমি বিস্মিত হই।’ এ গান ক্যাট স্টিভেন্স হিসেবে আমার যাত্রা শুরু এবং আজকের ইউসুফ ইসলাম হয়ে ওঠার কাহিনীকেই তুলে ধরেছে। আপনি আপনার জীবনের জন্য পরিকল্পনা করলেন কিন্তু দেখা গেল সেই পরিকল্পনা সঠিকভাবে কার্যকর বা বাস্তবায়িত হলো না। এর কারণ হচ্ছে এটাই যে, আপনার জন্য আল্লাহর উত্তম একটি পরিকল্পনা রয়েছে। আমি সর্বদাই এ কথাটি স্মরণ রাখার চেষ্টা করি।