হাওর বার্তা ডেস্কঃ সংসদীয় আসন ২৩৯। একদিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক আর অন্যদিকে হাওর। দেশের বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছে হবিগঞ্জ-১ আসন। আসনটিতে বর্তমানে জাতীয় পার্টির এমপি থাকলেও কার্যত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই চলছে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। এ আসনের বাসিন্দার দখলে রয়েছে হবিগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি পদ ও একাধিক প্রবাসী হেভিওয়েট আওয়ামী লীগ নেতা পদ। ওই এলাকার এক নারী সংরক্ষিত আসন হবিগঞ্জ তথা সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি। আবার ওই দুই উপজেলার চেয়ারম্যানও আওয়ামী লীগ সমর্থিত। সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ওই দুই উপজেলায় হওয়ার ফলে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন থেকে খুব একটা বঞ্চিত হতে হয়নি নবীগঞ্জ-বাহুবল উপজেলাবাসীকে।
এলাকার উন্নয়নে স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে কেউ বেশি বা কম মোটামোটি সবাই অবদান রেখে চলেছেন। আর আগামী নির্বাচনে এ আসনে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে এবার দখলে নিতে মরিয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে ছাড় দিতে একেবারেই নারাজ বর্তমান সরকারের বিরোধী দলে থাকা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত জাতীয় পার্টির এমপি এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু। আওয়ামী লীগের ছয় প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপির দুই ও জাতীয় পার্টির দুই প্রার্থী প্রচারণায়।
এ আসনে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান এমপি এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবদুল হামিদ চৌধুরীর নামও নেতাকর্মীদের মধ্যে শোনা যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ এবার এ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিতে নারাজ। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আলমগীর চৌধুরী চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যাপক প্রচারণা। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে নবীগঞ্জের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তুলে ধরছেন বর্তমান সরকারের উন্নয়ন চিত্র।
রাজনীতিতেও অনেকটাই স্বচ্ছ হিসেবে রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। ১৯৮২ সালে বৃন্দাবন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে রাজনীতি শুরু করা আলমগীর চৌধুরী হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জেলা যুবলীগের সভাপতি, জাতীয় শ্রমিক লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদকের রাজনীতি করে ২০০৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠিনক ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এর ফলে নবীগঞ্জ-বাহুবলসহ জেলার তৃণমূলেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। তাই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি অনেকটাই আশাবাদী।
এ আসনে মনোনয়নের আশায় কাজ করে যাচ্ছেন সংরক্ষিত এমপি অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। তিনিও ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংরক্ষিত আসনের এমপি হওয়ার সুবাদে তিনি মাঠ পর্যায়ে বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জনগণের কাছে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী ২০১১ সালের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তিনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হওয়ায় তাকে মনোনয়ন দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে তার কর্মী-সমর্থকের মধ্যে রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
এ আসনে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজীর পুত্র শাহনেওয়াজ মিল্লাদ গাজী। তিনি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে জোটগত নির্বাচনের কারণে শেখ হাসিনার নির্দেশে ছেড়ে দেন জাতীয় পার্টিকে। এ ছাড়াও মনোনয়ন পাওয়ার আশায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী মেজর (অব.) সুরঞ্জন দাস ও কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা মুকিত চৌধুরীও এলাকায় প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে এ আসনটিতে ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরীকে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হলেও তিনি বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়ার কাছে পরাজিত হন। দলের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকা ও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়েও তার এমন পরাজয় আওয়ামী লীগকে অনেকটাই হতাশ করে। যার ফলশ্রুতিতে পরে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে আর মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। তার স্থলে মনোনয়ন দেয়া হয় সাবেক এমপি মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজীর পুত্র দেওয়ান শাহ নেওয়াজ মিলাদ গাজীকে। তবে জোটগত নির্বাচনের জন্য দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মিলাদ গাজী আসনটি ছেড়ে দেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে। আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের আশায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সমান তালে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
এ আসনটিতে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নযুদ্ধে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও উপনির্বাচনে বিজয়ী সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়া এগিয়ে রয়েছেন। তবে বিগত আন্দোলন সংগ্রামের সময় ইংল্যান্ডে অবস্থান করার ফলে তার ভূমিকা তৃণমূলে প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপির টানা একশ’ দিনের আন্দোলনের সময় তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। নেতাকর্মীরা যখন একের পর এক মামলা-হামলায় জর্জরিত তখন দলের শীর্ষ নেতা প্রবাসে অবস্থানের ফলে আন্দোলন খুব একটা কার্যকর করতে পারেনি। অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে স্থানীয় বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনগুলো। তবে বিএনপি নেতা শেখ সুজাত মিয়ার রয়েছে হাইকমান্ডের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। এ ছাড়া এ আসনে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিএনপি নেতা প্রফেসর আবদুল হান্নান চৌধুরীও মনোনয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ আসনে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল খেলাফত মজলিশ হবিগঞ্জ জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আবদুল কাইয়ূম জাকিও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তৃণমূল নেতাকর্মীসহ সাধারণ ভোটাররা অপেক্ষায় আছেন কে পাচ্ছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন। আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট কেয়া চৌধুরী নাকি দেওয়ান শাহ নেওয়াজ মিলাদ গাজী, মেজর (অব.) সুরঞ্জন দাস? আর বিএনপি থেকে শেখ সুজাত মিয়া নাকি প্রফেসর আবদুল হান্নান? কে হচ্ছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী বর্তমান এমপি এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু নাকি আবদুল হামিদ চৌধুরী? এমন আলোচনা এখন হাটবাজারসহ চায়ের স্টলগুলোতে।
হবিগঞ্জ-১ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবদুল আজিজ চৌধুরী, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান চৌধুরী ছানু মিয়া, ১৯৭৯ সালে জাসদের মাহবুবুর রব সাদী, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের ইসমত আহমদ চৌধুরী, ১৯৮৮ সালে জাসদের অ্যাডভোকেট আবদুল মোছাব্বির, ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির প্রয়াত খলিলুর রহমান চৌধুরী রফি এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এমপি হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী। ২০০১ সালে তিনি ফের এমপি হন। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ফরিদ গাজী এমপি হন। এর দু’বছর পর ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর দেওয়ান ফরিদ গাজী মৃত্যুবরণ করেন। পরে ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুর্গে প্রথম হানা দেন বিএনপির প্রার্থী হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ সুজাত মিয়া। তিনি আসনটি বিএনপিকে উপহার দেন। উপনির্বাচনে বিএনপির এ বিজয় সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ওই উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি পরাজিত হন বিএনপি প্রার্থীর কাছে। পরে ২০১৪ সালে মহাজোট গঠন হলে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন মুনিম চৌধুরী বাবু।