জাকির হোসাইন : প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হাওরবাসির জন জীবন নাগরিক সুবিধা হতে বঞ্চিত । গুচ্ছ গ্রামের মতো সংকীর্ণ, পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন, বিশাল হাওর/সায়রের মাঝে কচুরি পানার মতো ভাসমান এবং দ্বীপসম ছোট ছোট গ্রামে হাওরবাসিকে স্বল্প পরিসরে অনেক মানুষকে একত্রে গাদাগাদি করে কাদা জলে মাখামাখি করে নারকীয় অবস্থায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে । কারন, হাওরে নতুন গ্রাম সৃজন বা রক্ষা, এ দু’টোই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় সাপেক্ষ কাজ । তাই, হাওরে এক খন্ড শুকনো উঁচুঁ জায়গা, বসত বাড়ি সোনার মতো দামী । এসব গ্রামে নূন্যতম নাগরিক সুবিধা নাই । বসবাসের স্থান-স্বস্থি নাই, ঝুঁকিপূর্ণ, বেঁচে থাকাই কষ্টের কাজ, নাগরিক সুবিধা সেখানে বড়ই দুর্লভ । বিদ্যুত নাই, সুপেয় পানি নাই, নাই স্বাস্থ্যকর সেনিটেশান, ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা । অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অপুষ্টি, অশিক্ষা, নিরক্ষর আর রোগ বালাইকে সঙ্গী করেই তাঁদেরকে জীবন যাপন করতে হচ্ছে ।
হাওরের গ্রামগুলো দেশের অন্য দশটি গ্রাম হতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তৈরী করা হয় । গ্রামগুলো সাধারণ সমতল ভূমি হতে ১০-১৫ ফুট উচুঁ করে বানানো হয় । আমারা জানি যে, বর্ষার ৬-৭ মাস হাওর অথৈ পানিতে সয়লাব থাকে । পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতেই এ কৌশল । ‘হাওর মহা পরিকল্পণা’র হিসাব মোতাবেক হাওর-ভাটি বাংলায় ৭টি জেলার ৩৯টি উপজেলায় ৩৭৩ টি হাওরে এ রকম ১৫,৩৭৪টি গ্রাম আছে । এ সব গ্রামে ৩২, ৪,৩৯০ পরিবারে (Haousehold) প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন লোক, দেশের মোট লোকের ১২%, বসবাস করে । এ সব বসত ভিটার আয়তন ৩,০৩,১২০ হেক্টর।
‘আফালের তাফালিং’ এ্ ঢেউ এর আঘাতে গ্রামগুলো ভেঙ্গে লন্ড-ভন্ড এবং ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । খড় কুটা দিয়ে রক্ষার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয় । মানুষ বাড়ছে, কিন্ত সেই অনুপাতে হাওরে বসত ভিটা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না । দেশের অন্য এলাকার মতো ইচ্ছে করলেই পাশের জায়গায় বাড়ির অংশ বাড়ানোর সুযোগ খুবই কম । পর্যাপ্ত বসত বাড়ির অভাবে একই ঘরে রান্নার ব্যবস্থাসহ গরু বাছুরের সাথে ২-৩ প্রজন্মকে এক সাথে মানবেতরভাবে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন । চর্ম চুক্ষে না দেখেল তাঁদের দুর্গতি লিখে বুঝানো সম্ভব নয় । মাটি কেটে উচুঁ ভিটাবাড়ি তৈরী এবং ঢেউ আর স্রোত থেকে রক্ষা করাই বড় চেলেঞ্জ । প্রতি বছর হাওরের গ্রামে বসত ভিটা ভাঙ্গণ হতে রক্ষা এবং মেরামতে তাঁদের আয়ের একটা বিরাট অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে । তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে সর্বত্র কিছু কিছু গ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় । তাঁরা আরো বড়, বেশী নারকীয় সমস্যার সস্মুখিণ হতে হচ্ছে । এতে করে একটা ছন্দে, পছন্দে তৈরী গ্রামগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্য হারাচ্ছে । প্রতি বছর নতুন বসত ভিটা, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন কাজে হাওরাঞ্চলের শতকরা প্রায় ০.৩৩ ভাগ হারে মূল্যবান কৃষি জমি চলে যাচ্ছে । এটাও আমাদের দ্রুত বর্ধনশীল জন সংখ্যার খাদ্য উতপাদন ঝুঁকির মুখে ফেলবে ।
এমতাবস্থায়, হাওরের ১৫,৩৭৪টি গ্রামকে যতটা সম্ভব একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপণার মাধ্যমে একটা শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে । নাগরিক সুবিধাদি প্রদাণের ব্যবস্থা নিতে হবে । এ গ্রামগুলো সৃজন কালে চারি পার্শ্ব হতে মাটি তোলে ১০-১৫ লাখ পুকুর/গর্ত সৃষ্টি করা হয়েছিল । কালের বিবর্তনে তার অধিকাংশই ভরাট বা মুজে গেছে । ফালগুণ-চৈত্র মাসে কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় এ ভরাট হওয়া পুকুর/গর্ত গুলো পূনঃখনন করে বসত বাড়ির আয়তন বাড়ানো সম্ভব । এর পানি মাছ, মুক্তার চাষ, গৃহস্থালী এবং শুষ্ক সময়ে সম্পূরক সেচ কাজে ব্যবহার ও পরিবেশ রক্ষায় নিমায়ক হিসাবে কাজ করবে । সবচেয়ে বড় যে কাজটি হবে তা হচ্ছে, বর্ষার শুরুতেই চারিদিকের বৃষ্টির পানি ধারণ করে, নদীতে পতিতি হতে না দিয়ে আগাম বন্যাকে প্রলম্বিত করে ফসল রক্ষা করবে । হাওরাবচলে ৩,০০০ টিরও অধিক জলমহাল আছে, এগুলোতে সারা বছর পানি থাকে, যদি শুকিয়ে না ফেলে, যার আয়তন ৮, ৬৯, ০০০ হেক্টর । তাছাড়া প্রায় ৬ হাজারেরও অধিক জলাশয় আছে, যেগুলো শুষ্ক সময়ে শুকিয়ে যায় । এগুলোও খনন করে গভীরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের উতপাদন বাড়ানো এবং জনবসতি গড়ে তোলা সম্ভব ।
হাওরের মূল্যবান কৃষি জমিতে নতুন করে, বিচ্ছিন্নভাবে, যত্রতত্র, ইচ্ছে মতো বাড়ি ঘর তৈরী করতে দেয়া যাবে না । তাই বলে তো মানুষের এই মৌলিক চাহিদাকে কোনভাবেই দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়, উচিতও নয় । আমার স্বপ্নের এ সমন্বিত গ্রামটি সর্ব যোগাযোগ সুবিধা সম্বলিত, সুবিধাজনক স্থানে, পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলতে হবে । এতে বিছিন্নভাবে নতুন গ্রাম সৃজন এবং ভাঙ্গণ প্রতিরোধ খরচ অনেক কমে যাবে । কমে যাবে এ খাতে মূল্যবান কৃষি জমি দখলের । নাগরিক সুবিধা প্রদাণ সহজতর হবে । এ গ্রামের সাথে আবাদি জমি ও জলাশয়ের ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলতে হবে ।
প্রস্তাবিত এ সমন্বিত গ্রাম হবে অনেক বড় । স্কুল-কলেজ, স্বাস্থ্য সেবা, মসজিদ, মন্দির, ব্যাংক, বীমা, খেলার মাঠ, আন্তঃ এবং আভ্যন্তরিণ যোগাযোগ, বাজার, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, সমাজ-সংগঠন ও বহুমূখী মিলনায়তন থাকবে । গ্রামের এক পাশে বা মাঝে থাকবে বহু পুকুর । পুকুর বা নদী খননের মাটি দিয়েই এ গ্রাম তৈরী হবে । পুকুরের পানির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন প্রজাতির দামী হাঁস-মাছ, মুক্তা চাষ হবে । পাড়ে থাকবে মূল্যমান বহু স্তর বিশিষ্ট ফলফলাদির গাছ, শাক সব্জী, গবাদি পশু, পালনের ব্যবস্থা । এর ফলে জলবায়ূ পরিবর্তন সকল পেশার আর ধর্মের মানুষের সমন্বিত সহবাস হতে পারে সমন্বিত এ গ্রামে । উপার্জনের ব্যবস্থা না করে দূরে বিরান ভূমিতে ‘আবাসন প্রকল্প বা গুচ্ছ গ্রাম‘ সৃজন মানুষের তেমন উপকারে আসে না । সমন্বিত গ্রামে পরিকল্পিত এবং সুবিন্যস্থ বহুতলা বিশিষ্ট আবাসন গড়ে তোলা যেতে পারে । একটি বিল্ডিং এ অনেকগুলো পরিবার; কুটির শিল্পের ব্যবস্থা থাকবে । সমন্বিত গ্রামের পাশে থাকতে পারে ‘বিসিক শিল্প’ এলাকা । এতে হাওরের চারিপাড় হতে আহরিত প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের ব্যবস্থা থাকতে হবে । এ গ্রামকে পর্যটনের ‘স্বপ্নপুরী’তেও রুপদান সম্ভব । সারা বছর ব্যাপী এ গ্রামে কর্মসংস্থানের বিরাট-বিশাল মহা-কর্মযজ্ঞের সূচনা হবে । আসবে হাওরের রুপ সাগরে অবগাহণে শত শহস্র পর্যটক বা কর্মোপলক্ষ্যে বইবে হাওর মূখী অভিবাসনের স্রোত ।
হাওর মহা-পরিকল্পণায় আছে, নদীগুলোর খননকৃত মাটি দিয়ে এ রকম তিন শতাধিক উচুঁ ভূমি তৈরীর । এগুলোকে একটু পরিকল্পিতভাবে পুকুররে ব্যবস্থা রেখে প্রতিরক্ষা দেয়াল দিয়ে বানালে খুবই কাজের লাগবে বলে আমার বিশ্বাস । কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, কিশোরগঞ্জের হাওরে উচুঁ বসত ভিটা/গ্রাম তৈরী করা হবে । এনজিও গুলোর হাওরে ‘আফালের তাফালিং’ হতে গ্রাম রক্ষায় বিভিন্নমূখী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে । আমার প্রস্তাব হচ্ছে, সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে খাস জমিতে বা সুবিধা জনক স্থানে এ রকম ‘সস্মন্বিত গ্রাম’ সৃজন করতে পারে । তাঁরা মাটি কেটে পুকুর তৈরী, ভরাট করে বসত ভিটা সৃজন, অবাসন ব্যবস্থা, অবকাঠামো এবং প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরী করে দেবেন । সরকার নাগরিক সুবিধাদি সৃজন করে দেবেন । আগ্রহী এবং উপযুক্ত পরিবারের কাছে ভূর্তকী মূল্যে লাগোয়া পুকুরসহ আবাসন ব্যবস্থা সম্বলিত প্লট হস্থান্তর করা যেতে পারে । কিছু প্লট গরীব এবং কিছু পেশাজীবীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা যেতে পারে । আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে এটি একটি লাভজনক ব্যবসা খাত হবে, এটি আমি হলপ করে বলতে পারি । মিঠা পানিকে কেন্দ্র করে হাওরে পর্যটনের সুস্থ্য ‘বিনোদণ কেন্দ্র’ এর অবকাঠামোও গড়ে উঠতে পারে। আমাদের দাবী, সব মিলে ‘সমন্বিত গ্রাম’ হবে হাওরবাসির ‘স্বস্থি আর শান্তির নীড়’ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ ।