হাওর বার্তা ডেস্কঃ নাজাহাত আর মনিরার কাঁখে পানির কলস। প্রায় তিন কিলোমিটার দূর থেকে তারা অ্যালুমিনিয়ামের কলস ভরে পানি আনছিল উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাঁড়ির পাশে কলস নামিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। সেই ফাঁকেই তাদের সঙ্গে কথা বলা।
তাদের দুজনেরই বয়স আট থেকে দশ বছর। পুটিবুনিয়া পাহাড়ের ঢালে নীল রঙের প্লাস্টিক সিট দিয়ে ছাউনি করে তাদের ঘর। গত ১২ দিন থেকে এখানেই আছে তারা। মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা এখনো হয়নি। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের এই নতুন রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো নলকূপ বসানো হয়নি। তাই প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামে তাদের যেতে হচ্ছে নলকূপ থেকে বিশুদ্ধ পানি আনার জন্য।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা গেল, নতুন রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। সাংসারিক কাজকর্ম, রান্নাবান্না করা বা গোসলের পানিরও সংকট রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ, কিন্তু তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা হয়নি। দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে শিশুরা ডায়রিয়া ও পেটের পীড়ায় ভুগছে। এ ছাড়া শৌচাগারের ব্যবস্থাও নেই। খোলা আকাশের নিচে, ঝোপঝাড় বা পাহাড়ি জঙ্গলে তাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে।
টেকনাফ ও উখিয়া প্রশাসনের হিসাবে টেকনাফে নতুন প্রায় দেড় লাখ ও উখিয়ায় সাড়ে চার লাখ—এই প্রায় ছয় লাখ নতুন রোহিঙ্গা ঢুকেছে। এদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। তাদের প্রায় ৮০ ভাগই জ্বর ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। কক্সবাজার সিভিল সার্জন আবদুস সালাম জানান, রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৩২টি মেডিকেল ক্যাম্প কাজ করছে। এসব ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহম্মেদ আনোয়ারি বলেন, বর্ষা ছাড়া এখানে পানির তীব্র সংকট থাকে। এত মানুষ আসায় পানির সংকট আরও বেড়েছে। পানির জন্য রোহিঙ্গারা হাহাকার করছে।
টেকনাফের উত্তরের শেষ প্রান্তে পুটিবুনিয়া পাহাড়ের ওপর এই নতুন আশ্রয়কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছে বিজিবির তত্ত্বাবধানে। এখানে এখন আশ্রিতের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি। ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেল আশ্রয়কেন্দ্রের কিছুটা ভেতরে গিয়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে একটি স্রোতোধারা ক্রমশ চওড়া হয়ে খাঁড়ির মতো করে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। সমতলভূমিতে এসে সেটি অনেকটা সরু খালের মতো হয়েছে। তাতে পানিও আছে। হয়তো একসময় সে পানি পরিষ্কারও ছিল। তবে এখন কাদায় মাখামাখি। খাঁড়ির বিভিন্ন স্থান থেকে সেই কাদামাখা ঘোলা পানি প্লাস্টিকের বোতল, বালতি, হাঁড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে শত শত শিশু-নর-নারী।
এখান থেকে বালতিতে পানি ভরছিলেন আতিকুর রহমানের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। মিয়ানমারের মংডুর কুয়ার বিলে ছিল তাদের বাড়ি। ঈদের দুই দিন পরে চার ছেলেমেয়েসহ ছয়জন এসে উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। এই ঘোলা পানিতে কী করবেন, জানতে চাইলে তিনি জানালেন, এতে ধোয়ামোছার কাজ হবে। তবে এই পানিতে চাল ধোয়ার পরে রান্না করা ভাত খেতে বালু কিচকিচ করে। কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায়ও নেই।
আশ্রয়কেন্দ্রে পানির মতোই সংকট শৌচাগারের। শিশুরা খালের পাড়েই মলমূত্র ত্যাগ করছে। বয়স্করা যাচ্ছেন পাহাড়ের ঝোপে-ঝাড়ে। মংডুর তুলাতুলি গ্রাম থেকে আসা ৬৫ বছরের রুহুল আমিন বললেন, এমন অভিজ্ঞতা কখনো ছিল না। তিনি বেশ অবস্থাপন্ন মানুষ। বাড়িতে প্রায় চার একর জমি ছিল, দুটো কাঠের ঘর। ভালো গোসলখানা, শৌচাগার এসব ছিল। এখন এসে পড়তে হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। এ ক্ষেত্রে নারীদের অসুবিধাই হচ্ছে বেশি। অস্থায়ীভাবে এক সারিতে ১০-১৫টি প্লাস্টিক শিটে ঘেরা শৌচাগার করে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো এখন লোকের চাপে ব্যবহারের অযোগ্য।
টেকনাফ-২ বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর শরিফুল ইসলাম জোমাদ্দার বলেন, নতুন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখনো পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা যায়নি। কিছু কিছু এনজিও জরুরি ভিত্তিতে খাওয়ার পানি সরবরাহ করছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
পুটিবুনিয়ার এই বড় আশ্রয়কেন্দ্রটি ছাড়াও টেকনাফে অনেকগুলো মাঝারি ও ছোট ছোট রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে নেচার পার্কের বস্তিটি বেশ বড়। এখানে লোকসংখ্যা আনুমানিক ৫০ হাজারের ওপরে। এ ধরনের আরেকটি বস্তি হয়েছে বাহারছড়ায়। ছোট ছোট বস্তি হয়েছে জাদিমুড়া, মোচনি, দমদমিয়া এসব এলাকায়। আর সড়কের পাশ দিয়ে খানিক পরপর একটি-দুটি করে ঝুপড়িঘর রয়েছে অনেক। এসব ছোট-বড় বস্তি-ঝুপড়ির বাসিন্দারও সুপেয় পানি বা শৌচাগারের কোনো সুবিধা নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উখিয়ার নতুন আশ্রয়কেন্দ্র থাইংখালিতেও সুপেয় পানি ও শৌচাগারের সুব্যবস্থা করা যায়নি। এখানেও লোকসংখ্যা দেড় লাখের ওপরে। এ ছাড়া টেংখালি, বাগগুনা, দক্ষিণ বাগগুনা, মক্কার বিল, মোচার খেলা এসব এলাকায় পাঁচ থেকে কুড়ি হাজার লোকের বস্তি গড়ে উঠেছে।
টেকনাফ ও উখিয়ার সরকারি নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত পুরোনো আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পানি ও শৌচাগারের সুবিধা আছে। তবে এসব আশ্রয়কেন্দ্রেও বাড়তি লোকের চাপ, তাই এসব সুবিধার সংকট দেখা দিয়েছে।